শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক বিজ্ঞানও প্রয়োজন

এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক বিজ্ঞানীদের বিশেষ করে নৃবিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগানো যেতে পারে।
ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন
  ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

দুর্যোগতাড়িত ঝুঁকি ও ভোগান্তি নিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানীরা বহুযুগ ধরে গবেষণা করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ অধ্যয়নকারী সামাজিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ভূগোলবিদ বেন উইজনার, টেরি ক্যানন ও পিয়ারস বেস্নইকি এবং নৃবিজ্ঞানী এন্থনি অলিভার-স্মিথ ও সুসানা হফম্যান। বাংলাদেশের চরাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এদের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন বহু সামাজিক বিজ্ঞানী। তন্মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত ও নৃবিজ্ঞানী এম কিউ জামান। সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকান্ড দুর্যোগ বা ঝুঁকিকে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা 'সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত' হিসেবে বোঝে না। বরং, দুর্যোগতাড়িত মানুষের ভোগান্তি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্মিত। আকস্মিক ঝুঁকিতে তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয় যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় যথেষ্ট কার্যকর নয়। অর্থাৎ সমাজের প্রান্তিক কিংবা নিম্নআয়ের মানুষই সবচেয়ে আগে ও বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটি ঘটে এসেছে। দুর্যোগ নৃবিজ্ঞানী সুসানা হফম্যান বলেন, 'দুর্যোগ হচ্ছে প্রকাশকারী। এটি প্রকাশ করে যে সমাজে নীরবে কি চলছে এবং তা কাকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন করছে।' অন্যভাবে বললে, দুর্যোগ আসার আগেই সমাজে বৈষম্য ছিল ও বিরাজমান আছে যা নির্ধারণ করে দেয় যে নিম্ন আয়ের ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ দুর্যোগকালীন সময়ে বেশি মাত্রায় ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।

করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি যেন না ঘটে সে জন্য বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলোকে সীমিত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, দিনমজুররা ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না; কাজ করতে পারছে না ও মজুরি পাচ্ছে না। এতে তাদের মতো মানুষকে দুই ধরনের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। প্রথমত, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ত, দরিদ্রতার বিরুদ্ধে। বস্তিবাসী বা দিন আনে দিন খায় এমন পরিবারগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন- সাবান ও খাদ্যদ্রব্য কেনা এক ধরনের অর্থনৈতিক চাপ হিসেবে দেখা দেয়। তা ছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ (বিশুদ্ধ পানি) ও বস্তুগত সম্পদে (অর্থ) নিম্ন আয়ের মানুষের প্রবেশাধিকার কাঠামোগতভাবেই সীমিত। করোনাভাইরাস দুর্যোগকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জরুরি সেবা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। তন্মধ্যে রসায়নবিদ ও চিকিৎসকরা অন্যতম। তবে এ ক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞানীদের অবদানও উলেস্নখযোগ্য; যেমন- অর্থনীতিবিদরা দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি অর্থের পরিমাপে হিসাব করে দেখান যে দুর্যোগপরবর্তী সময়ে কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন যা দিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জরুরি সেবা প্রদান করা যেতে পারে। দুর্যোগপরবর্তী সময়ে আরও কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যেগুলো প্রেক্ষিতনির্ভর, জটিল, মানুষের সাংস্কৃতিক আচরণ, বোধ ও শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। এক কথায়, এগুলো পৃথক বা স্বতন্ত্র কোনো বিষয় নয়। এ বিষয়গুলোর আন্তঃসম্পর্কিত। সরল কিংবা অপ্রশিক্ষিত দৃষ্টিতে সেগুলো ধরা পড়ে না। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত পর্যবেক্ষণমূলক দক্ষতা ও সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকান্ডের ভূমিকা উলেস্নখযোগ্য।

দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ টেরি ক্যানন বলেন, সাধারণত দুর্যোগতাড়িত মানুষের বিপদাপন্নতাকে এড়িয়ে চলা হয় এই পূর্বানুমানের ভিত্তিতে যে তা 'বিজ্ঞানের সাথে অপ্রাসঙ্গিক' অথবা 'এগুলো নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন।' নৃবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখান যে দুর্যোগপরবর্তী সময়ে মানুষের মনে, সংস্কৃতিতে, সমাজে ও ব্যক্তিজীবনে বিভিন্ন ধরনের জটিল পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন- দুর্যোগকালে হতাশা ও উদ্বিগ্নতা মানুষের স্বাভাবিক আচরণে ব্যাঘাত ঘটায়। এ ছাড়া দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী রাষ্ট্র থেকে তৎক্ষণাৎ সেবা পেতে চায়, কারণ তাদের ইন্সু্যরেন্স কিংবা সঞ্চয় করার সামর্থ্য নেই। দুর্যোগের পরিস্থিতিতে তারা সাধারণত সামাজিক পুঁজি তথা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা কাল্পনিক আত্মীয়দের সহায়তার ওপর ভরসা করে। এরূপ জটিল পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে বিপদাপন্ন মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা। পুলিশের লাঠির আঘাত কিংবা অপমানজনক আচরণের মাধ্যমে জনগণের চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় বটে, তবে এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এরূপ আচরণ প্রশাসনের ওপর জনসাধারণের আস্থাকে কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বিপদাপন্ন মানুষকে আরও অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যা মানবাধিকার পরিপন্থি। প্রশাসনের উচিত হবে করোনাভাইরাস দুর্যোগ পরিস্থিতিকে উন্নয়নের জন্য মানুষে স্থানীয় স্বাস্থ্য-চর্চা ও স্বাস্থ্য-জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করা সত্যিই কষ্টসাধ্য হবে। এমনটি ভাবা ভুল হবে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস দুর্যোগ সাময়িক এবং কিছুদিনের মধ্যেই তা চলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশেও এর ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জনসমাগম হয় এমন স্থানগুলোতে মানুষের চলাচলকে সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু মসজিদে মানুষের চলাচলকে কীভাবে সীমিত করা যায় তা নিয়ে উলেস্নখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সরকার যদি ঘোষণা দেয় যে নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়া বন্ধ, তাহলে এটি সহজে অনুমান করা যায়, জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে মুসলমানদের দিক থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসবে। কারণ ধর্ম বিষয়টি আমাদের সমাজে খুবই স্পর্শকাতর। আবার বেশি মানুষ একসঙ্গে হওয়াটাও এই দুর্যোগকালে কাম্য নয়।

\হতাই সরকারের উচিত হবে সামাজিক বিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেওয়া যে কীভাবে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত কার্যক্রমগুলোকে সাময়িক সময়ের জন্য সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সরকারি আদেশ কি ভাষায় ও মাধ্যমে ঘোষিত হবে তা শুধু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সরকারি প্রশাসক বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষাতেই ঘোষিত হওয়া যথেষ্ট নয়। বরং উচিত হবে, এসব বিষয়ে ধর্মবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক, সামাজিক বিজ্ঞানী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সরকার বেশকিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন- আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনসাধারণকে অযথা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে অনাগ্রহী করছে। চিকিৎসকরা নিজ স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দিচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীরা গরিবদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। যেহেতু এই ভাইরাস মানুষের জীবনে দুর্যোগ নিয়ে এসেছে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তথা সমাজিক জীবনে ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তাই

\হ

ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95355 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1