শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা যুদ্ধ: আমরা জয়ী হবই

চীনের ডাক্তার-নার্সরা মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য -এই মানবতাবাদে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তারা সব ধরনের ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে রোগীর সেবা করেছেন, অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। তবুও তারা দমে যাননি কিংবা থেমে থাকেননি। তাদের মনবলে ধস নামেনি। ফলে করোনা আক্রান্ত বিশ্বে অন্যরকম এক চীনকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদেরও চীনের পথ অনুসরণ করা উচিত। সবার আগে ডাক্তার-নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করতে হবে এবং দিতে হবে ঝুঁকি ভাতা। এই ক্রান্তিকালে যারা জরুরি সেবা দিচ্ছেন, জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০১ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী এক মহা আতঙ্কের নাম। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৪টি দেশ ও অঞ্চল আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ, মৃতু্যর সংখ্যা ৩৪ হাজারের বেশি। সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা আমেরিকায় ১ লাখ ৬৫ হাজার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমেরিকার পর আক্রান্তের দিক ইতালি এরপর চীন। ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার। স্পেন ও ফ্রান্সের অবস্থাও ভয়াবহ। বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি যখন এমন নাজুক, তখন বাংলাদেশ কোনোভাবেই শঙ্কামুক্ত নয়। যদিও গত তিন দিনে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা একজন। ৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৫১ জন, সুস্থ হয়েছেন ২৫ জন এবং মৃতু্য হয়েছে ৫ জনের। যদিও অবিশ্বস্ত বিরুদ্ধবাদীরা বলছে, এই পরিসংখ্যান সত্য নয়। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এও বলছে ভাইরাস সংক্রমণ কমিউনিটিতে শুরু হয়েছে। অনুমাননির্ভর মন্তব্য করা উচিত নয়। এর ফলে জনমনে ভয়ের সঞ্চার হবে। এটা অপরাধ। এ ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা ও নজরদারি জরুরি। এ ছাড়াও বিদেশফেরত শুনে বাড়িতে ঢুকতে বাধা, গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে চাপ দেওয়া, কোভিড-১৯ এর লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে বাধা, সম্ভাব্য রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ায় হাসপাতাল ভাঙচুর, অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরিতে বাধা- বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকেই এমন অনেক ঘটনার খবর মিলছে নিয়মিতই। মূলত এই ভাইরাস নিয়ে গুজবনির্ভর ভুল ধারণার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক এবং অমূলক এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষ নিজেদেরই ক্ষতি করছে।

করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) মোকাবিলায় গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে হোম কোয়ারেন্টিন, হাসপাতাল ও অন্যান্য কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৮৯০ জনকে। ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪ হাজার একজন। ২১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে ৫৫ হাজার ৫৮৩ জনকে। এদের মধ্যে ছাড়পত্র নিয়েছেন ২৯ হাজার ৫৬০ জন। বর্তমানে কোয়ারেন্টিনে আছেন ২৬ হাজার ২৩ জন।

দেশের যে সব এলাকায় আক্রান্ত্রের খবর পাওয়া যাচ্ছে সে সব এলাকা সঙ্গে সঙ্গে লকডাউন করা হচ্ছে। এটি ভালো দিক। তবে পর্যাপ্ত চিকিৎিসাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনো। চিকিৎসা সঙ্কট রয়েছে, রয়েছে অন্যান্য সঙ্কটও। আগের লেখায় বলেছিলাম কোনো আলাদা ভবন করোনা চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হোক, যেটা আগেই করা উচিত ছিল। এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও একই কথা বলছেন। এখনো সময় আছে, সরকার উদ্যোগ নিলেই পারবে। যদিও মহাখালির সিটি করপোরেশনের মার্কেটটির কথা শোনা যাচ্ছে। আকিজ গ্রম্নপ তেজগাঁও এলাকায় করোনা হাসপাতাল তৈরি করছে। স্থানীয়রা প্রথমে বাধা দিয়েছিল, পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কাজ শুরু হয়েছে।

গত বছর যখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শতাধিক মানুষ মারা গেল, এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হলো তখন থেকেই আমাদের বোঝা উচিত ছিল, এ ধরনের বা অন্য কোনো ভাইরাস মহামারি আকারে আঘাত হানতে পারে। আরও একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। এ কারণে তারা রোগী ভর্তি করতে অনীহা প্রকাশ করছে। বেশ কয়েকটি এমন ঘটনা ঘটেছে, রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি করাতে পারেনি। মিরপুরের টোলারবাগে যে রোগীর করোনা সংক্রমণে মৃতু্য হলো তার ব্যাংকার পুত্র ফেসবুকে এমন স্টেটাসই দিয়েছিলেন, যা অত্যন্ত অমানবিক। অথচ

চীনের ডাক্তার-নার্সরা মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য- এই মানবতাবাদে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তারা সব ধরনের ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে রোগীর সেবা করেছেন, অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। তবুও তারা দমে যাননি কিংবা থেমে থাকেননি। তাদের মনবলে ধস নামেনি। ফলে করোনা আক্রান্ত বিশ্বে অন্যরকম এক চীনকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদেরও চীনের পথ অনুসরণ করা উচিত। সবার আগে ডাক্তার-নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করতে হবে এবং দিতে হবে ঝুঁকি ভাতা। এই ক্রান্তিকালে যারা জরুরি সেবা দিচ্ছেন, জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় রয়েছে। যদিও প্রশাসন মানুষকে সচেতন করার ব্যাপারে তৎপর ও মনোযোগী। অবশ্য কোথাও কোথাও বাড়াবাড়িও হচ্ছে। হোম কোয়ারেন্টিনে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখার পাশাপাশি জনগণকে সামাজিক দূরত্ব নিয়ে চলতে বাধ্য করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ যাতে ঘরের বাইরে বের না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে স্থানী প্রশাসনকেই, তবে তা বুঝিয়ে হয়রানি বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করে নয়।

এটা মেনে নিতেই হবে যে দেশের জনগণ করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ে তেমন সচেতন নয়। বিশেষ করে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ এবং একশ্রেণির তরুণ। তারা এ ব্যাপারে গা করছে না। রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে তাদের অবাধে ঘুরতে দেখা যায়, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করেই। এমনকি কেনাকাটার সময়ও তারা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে চলে না। তিন দিন আগে চট্টগ্রামের বাজারের একটি ছবি প্রকাশ করেছে একটি জাতীয় দৈনিক। তাতে দেখা গেছে ক্রেতারা গাঘেঁষে কেনাকাটা করছে। এমন চিত্র রাজধানীর কোনো বাজারেও চোখে পড়ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানেই ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সরবরাহ করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে ভিড় জমিয়েছেন ক্রেতারা। কিন্তু পণ্য কিনতে এসে নির্দিষ্ট তিন ফুটের দূরত্ব মানছে না তারা। কেবল তাই নয়- বস্তিবাসীরা কোনো ধরনের সামাজিক দূরত্ব মানছে না। তারা আগের মতোই খোশগল্পে মত্ত থাকছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। আবার কেউ কেউ এও বলছে 'মউত আসলে মারা যামু'। গ্রামের নিরীহ মানুষের ধারণাও এমন। মরতে তো একদিন সবাইকেই হবে, এটা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত ও অবধারিত। সে জন্য ট্রাক বা বাসের নিচে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয়া সঙ্গত ও যৌক্তিক নয়। করোনাভাইরাস সম্পর্কে অসাবধনতা বা অসতর্কতা আত্মহননের শামিল।

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনগণের উদ্দেশে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার করোনাভাইরাস মোকাবিলায় পরামর্শ ও আহ্বান সংবলিত চারটি বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও বার্তাগুলো হচ্ছে- করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আপনার করণীয় প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না। বাইরে বের হলে মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলুন। যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিদেশ থেকে ফিরেছেন, তারা ১৪ দিন সম্পূর্ণ আলাদা থাকুন। ঘন ঘন সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। হাঁচি-কাশি দিতে হলে রুমাল বা টিসু্য পেপার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নিন। যেখানে-সেখানে কফ-থুতু ফেলবেন না। করমর্দন বা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন। মুসলমান ভাইয়েরা ঘরেই নামাজ আদায় করুন। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ঘরে বসে প্রার্থনা করুন। পরিবার, পাড়াপ্রতিবেশী এবং দেশের মানুষের জীবন রক্ষার্থে এসব পরামর্শ মেনে চলা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। সুরক্ষা ও চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতি নেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পিপিই-সহ পর্যাপ্ত পরিমাণ সুরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত কিট মজুত রয়েছে। ঢাকায় চারটি স্থানে এবং চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্য ছয়টি বিভাগে করোনাভাইরাস পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ চলছে। কেউ গুজব ছড়াবেন না। গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অসহায় তিনি মানুষের সহায়তায় বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান। এটা সত্য করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশে ১০ দিনের অঘোষিত 'লকডাউন' জারি করেছে সরকার। এর ফলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন দরিদ্র দিনমজুররা। কর্মহীন হয়ে পড়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের। নভেল করোনাভাইরাসের মহামারিতে দেশে প্রায় অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে দৈনিক উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে ধনী ও বিত্তবানদের।

সরকার যদি দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দেশের হতদরিদ্রদের খাবার বিতরণ নিশ্চিত করতে পারে তা হলে, গরিব মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা থাকতে হবে। দেশের কর্মহীন হতদরিদ্ররা যদি খাদ্য না পায় তা হলে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেবে এ কথা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্মরণে রাখতে হবে। এও মনে রাখতে হবে একদিকে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে অন্যদিকে তারা যদি খাবার না পায় তা হলে এর চেয়ে দুঃখ ও হতাশাজনক ঘটনা আর কী হতে পারে। সুতরাং সরকারের কার্যকর উদ্যোগই বিত্তহীন শ্রমজীবী মানুষকে পরিত্রাণ দিতে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাসও এসেছে। করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রতিঘাত মোকাবিলায় সরকারের বিশেষ প্রণোদনাব্যবস্থা ও দরিদ্র মানুষের সাহায্যের ব্যাপারে সরকার মনোযোগী। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ দেশবাসীর মেনে চলা উচিত। মনে রাখতে হবে এটা প্রধানমন্ত্রীর একার যুদ্ধ নয়, আমাদেরও যুদ্ধ। আমরা সচেতন ও সতর্ক হলে করোনাভাইরাস থেকে আমরা মুক্ত থাকব। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জয়ী আমাদের হতেই হবে। সৃষ্টিকর্তা সহায়।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94769 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1