শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্য বেকারত্ব ও বিদেশিদের কর্মসংস্থানের বাজার

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও বেকার সংখ্যাধিক্যের দেশে লাখ লাখ বিদেশি অবৈধ অবস্থান করে বিনা ওয়ার্ক পারমিটে কাজের, বেতন-ভাতা বেআইনি পথে দেশে পাচারের সুযোগ দেশ-জাতির স্বার্র্থেই বন্ধ করা দরকার। দরিদ্র ও বেকার কিলবিল করা দেশ-বিদেশিদের কর্মসংস্থানের বাজারে পরিণত হয়েছে- এর ফল ভালো হচ্ছে না।
জহির চৌধুরী
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা, আয়, আয়ের অর্থ নিজ দেশে প্রেরণের তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে 'বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক একটি প্রতিবেদেন তৈরি করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে গত ৬ ফেব্রম্নয়ারি। প্রতিবেদনেটিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের ২১ খাতে কমবেশি ৪৪ দেশের ২ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি কাজ করছেন। এদের মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, মালেয়শিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীনের নাগরিক উলেস্নখযোগ্য। বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়। দেশে কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে ২ লাখ ৪১ হাজারই অবৈধ এবং কর প্রদানকারীর সংখ্যা মাত্র ৯ হাজার ৫০০ জন। দেশে কর্মরত বিদেশিরা বেতনের নামে দেশ থেকে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করছেন- যা পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের সমান। কর্মানুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) না নিয়ে পর্যটক ভিসায় এসে বাংলাদেশে কাজ করেন ১ লাখ ৬০ হাজার বিদেশি। এরা কোনো কর না দিয়েই আয়ের অর্থ দেশে পাঠান। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা। বৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর বেতন প্রাতিষ্ঠানিক নথিপত্রে প্রকৃত বেতন অপেক্ষা কম দেখানো হয়। এদের বেতনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বৈধভাবে ব্যাংক হিসাবে পরিশোধ করা হয় এবং বাকি টাকা অবৈধভাবে নগদ দেয়া হয়। অবৈধভাবে কর্মরত কর্মীর শতভাগ বেতন নগদ বা অন্য কোনো দেশের (দুবাই বা সিঙ্গাপুর) ব্যাংক হিসাবে দেয়া হয়। নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি কর্মীর নিয়মিত হাত খরচ, আবাসন ও পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে।

বৈধ-অবৈধ উভয়ভাবে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক বিদেশির কাজ করা, কাজের আয় বাবদ প্রাপ্ত অর্থ পাচার ওপেনসিক্রেট। কত সংখ্যক বিদেশি বাংলাদেশে কর্মরত আছেন, কত টাকা তারা বেতন-ভাতা বাবদ পান, কি পরিমাণ অর্থ তারা দেশে পাঠান তা সুনিদিষ্ট করে বলা কঠিন। বিদেশিদের বাংলাদেশে প্রবেশের ভিসা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশিরা দেশে কতদিন থাকছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে- তা দেখভাল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশিদের কাজের অনুমতি স্বরূপ ওয়ার্ক পারমিট দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের অধীন বিনিয়োগ বোর্ড, বিদেশিদের কর্মক্ষেত্রের সুযোগ-সুবিধা দেখে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিদেশিদের উপার্জিত অর্থের আয়কর আদায়ের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের (এনবিআর)। পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিনিয়োগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাংলাদেশে অবস্থানকারী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা ও আয়ের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে বিরাজমান অবস্থায় জানাতে পারবে কী না তা নিয়েও সংশয় আছে। ২০১৫ সালের শেষের দিকে রাজধানীর গুলশান ও রংপুরে দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যাকান্ডের পর দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের তালিকা তৈরির একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সে উদ্যোগ একপর্যায়ে হিমঘরে চলে গেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১২ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। বাংলাদেশে কত সংখ্যক বিদেশি অবস্থান করছেন, এদের মধ্যে কতজন অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, অবৈধ অবস্থান করা বিদেশিদের কতজন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, বৈধ-অবৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বেতন-ভাতা বাবদ কত টাকা আয় করেন, আয়ের কত টাকা দেশে পাঠান তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না হলেও নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক বিদেশি বৈধ-অবৈধভাবে অবস্থান করছেন এবং বিপুল অংকের অর্থ দেশে পাচার করেন। বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশিদের বড় অংশ ভারতীয় তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ স্থল সীমান্ত থাকায় বিপুলসংখ্যক ভারতীয় ভিসা ছাড়াই চোরাপথে বাংলাদেশে আসেন এবং এদের একটা অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয়রা সহজলভ্য- তুলনামূলক সাশ্রয়ী হওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধিকসংখ্যক ভারতীয় নিয়োগ পান। পৃথিবীর সবদেশেই বিদেশিদের কাজের সুযোগ দেয়া হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিদেশিরা কাজ করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওয়ার্ক পারমিট নিতে হয়; ওয়ার্ক পারমিট নেয়া বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও এ নিয়ম কার্যকর। তবে বাংলাদেশে এ নিয়মের তেমন একটা তোয়াক্কা করা হয় না। ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশিদের কাজের সুযোগ থাকাতে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা এবং বিদেশিদের আয় সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট তথ্য অজানা থাকে। পৃথিবীর সবদেশেই বিদেশিদের গতি-বিধি, অবস্থান আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থা পর্যবেক্ষণে রাখে। বাংলাদেশে বিদেশিরা নির্বিঘ্নে যেভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে কাজ করে তাতে মনে হয় আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এ ক্ষেত্রে কোনো দায়িত্ব নেই। বাংলাদেশে পার্লারে, বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, সংবাদ মাধ্যমে, শো-রুমেও বিপুলসংখ্যক বিদেশি ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া প্রকাশ্যে কাজ করতে দেখা যায়। অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায়ও বিদেশি নিয়োগের তথ্য বেরিয়ে এসেছে গত বছর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের পর। সরকারের 'উদার মনোভাব' দেশে বিপুলসংখ্যক বিদেশির অবৈধ অবস্থান এবং অবৈধভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই।

\হঅবৈধ অবস্থানকারী বিদেশিরা বেআইনিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আয় করা মোটা অংকের অর্থ চোরাপথে দেশে নিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনেই। বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ের (রেমিট্যান্স) সুফল থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বিদেশিদের বিপুল অংকের অর্থ পাচারের কারণে। বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আয় করে তার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি দেশে নিয়ে যায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা। ২০১৮ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক বিদেশি কাজ করে, এতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক তথ্যমতে, গড়ে ২২ জন প্রবাসীর আয় নিয়ে যায় বাংলাদেশে কর্মরত একজন বিদেশি। ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। ব্যাঙ্গালুরভিত্তিক একটি নিউজ পোর্টাল ২০১৩ সালে ' ফিফটিন নেশনস সেন্ডিং হাইয়েস্ট রেমিট্যান্স টু ইন্ডিয়া' শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ৫ লাখ ভারতীয় অবস্থানের তথ্য দিয়েছে।

\হবলা যায়, দরিদ্র ও বেকার মানুষ কিলবিল করে বাংলাদেশে। বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১১ কোটি এবং বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখের বেশি। প্রতি বছর নতুন ২০ লাখ শ্রমশক্তি শ্রমবাজারে যোগ হয়। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। প্রতি বছর দেশে ৬ লাখের বেশি গ্র্যাজুয়েট বেরিয়ে আসে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ হাজারের কর্মস্থান করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার প্রায় ৩৭ শতাংশ। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ৩৪ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করা তরুণ-তরুণীর মধ্যে বেকারের হার যথাক্রমে ২৭ ও ২৮ শতাংশ। এমন দেশে বিপুলসংখ্যক বিদেশি বেআইনিভাবে অবস্থান করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের, বেতন-ভাতা বাবদ প্রাপ্ত বিপুল অংকের অর্থ পাচারের অবারিত সুযোগ রাখা হয়েছে- এতে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। অবৈধ অবস্থানকারী বিদেশিরা প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা সংস্থার নাকের ডগাতেই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। বিদেশিদের অবৈধ অবস্থান, ওয়ার্ক পারমিট না নিয়ে কাজ করা, অবৈধ অবস্থানকারী বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজের সুযোগ দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধ কারো চোখে পড়ে না। বিদেশি নাগরিকদের অবৈধ অবস্থান, ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজের সুযোগ দেশের অর্থনীতি, স্থানীয়দের কর্মসংস্থানেরই শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যও অনিষ্টকর হচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশিদের রাষ্ট্রবিরোধীসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বিভিন্ন সময় চাউরও হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদেশি নিয়োগ দেয়া হয় জাতীয় স্বার্থে। স্থানীয় লোকবল সংকট, দক্ষ লোকবলের অভাবজনিত কারণে, মেধাবী বিদেশি নাগরিকের সেবা প্রয়োজন মনে করে বিভিন্ন দেশ বিদেশি নিয়োগ দেয়। বিদেশিদের ঢালাও নিয়োগ দুনিয়ার কোনো দেশ দেয় না। বাংলাদেশেও বিদেশিদের কাজের সুযোগ দেয়া যেতে পারে প্রয়োজনে। কোনো পদে বিদেশি নিয়োগের আগে ওই পদে বিদেশি নিয়োগের প্রয়োজন কতটা আছে তা দেখে প্রয়োজন থাকলে ওয়ার্ক পারমিট ইসু্য করে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। ঢালাওভাবে বিদেশি নিয়োগের সুযোগ দেয়া যেতে পারে না। অতিমাত্রায় বিদেশি নিয়োগ দেয়ার সপক্ষে বলা হয়, দেশের নিম্নমানের শিক্ষার কারণে স্থানীয় উচ্চশিক্ষিতরা গুণগত মানের দিক থেকে বিদেশিদের সমকক্ষ নয়; এ কারণে প্রতিষ্ঠানে বিদেশি নিয়োগ না দিয়ে উপায় থাকে না। দেশের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক মানের বিচারে নিম্নমানের তা অস্বীকারের জো নেই। নিম্নমানের শিক্ষায় শিক্ষিতদের নিয়োগ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় টিকে থাকা সম্ভব নয়- এটা ঠিক। শিক্ষার মানবৃদ্ধি করে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও বেকার সংখ্যাধিক্যের দেশে লাখ লাখ বিদেশি অবৈধ অবস্থান করে বিনা ওয়ার্ক পারমিটে কাজের, বেতন-ভাতা বেআইনি পথে দেশে পাচারের সুযোগ দেশ-জাতির স্বার্র্থেই বন্ধ করা দরকার। দরিদ্র ও বেকার কিলবিল করা দেশ বিদেশিদের কর্মসংস্থানের বাজারে পরিণত হয়েছে- এর ফল ভালো হচ্ছে না।

জহির চৌধুরী: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<90180 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1