শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং ড্রপ আউট রোধকল্পে 'মিড ডে মিল'-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে রোল মডেল। এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের বর্তমান নবীন প্রজন্মকে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে।
মুহাম্মাদ হেলাল হোসেন
  ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

একটি জাতির উন্নয়নের কারিগর দক্ষ মানবসম্পদ। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা মুখ্য নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার সব স্তরেই কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিকল্পিত উন্নয়নসাধন সার্বিক শিক্ষার অগ্রগতির জন্য অত্যাবশ্যক। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ সময়ের দাবি; কেননা প্রাথমিক পর্যায়েই শিশুর মানসিক, মানবিক, স্বাস্থ্যগত ও চারিত্রিক বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তাই একদিকে যেমন শিশুদের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে; একই সঙ্গে শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও স্বাস্থ্যগত বিকাশের দিকেও বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করতে হবে। আর এজন্যই 'জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯'-এর আওতায় প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে 'মিড ডে মিল' চালুকরণ এবং দীর্ঘমেয়াদে এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা অব্যাহত রাখতে হবে।

\হ'মিড ডে মিল' চালুকরণের প্রেক্ষাপট : বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে বিশ্বের প্রায় সব দেশের চুক্তির ভিত্তিতে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং) এর অভীষ্ঠ-০৪ (এড়ধষ-০৪) এর আওতায় মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং একই সঙ্গে অভীষ্ট-০৩ (এড়ধষ-০৩) এর আওতায় সব বয়সের জনগণের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণকল্পে 'মিড ডে মিল' উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা শিশুদের জন্য দুপুরবেলা মানসম্মত ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার সরবরাহ করা হলে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশুদের স্কুলে উপস্থিতির আগ্রহ ও হার যুগপৎ বেড়ে যাবে; একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে শিশুদের ড্রপ আউট হার উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। পাশাপাশি এ কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের পুষ্টিস্তর বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার জোগান দেয়াও সম্ভব হবে।

১৯৯৫ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতে 'মিড ডে মিল' চালু হলেও বাংলাদেশে দীর্ঘদিন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এ ব্যাপারে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। অবশেষে বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে এ কর্মসূচির ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে সব প্রাইমারি স্কুলকে এ প্রকল্পের আওতায় আনার এবং বিত্তশালীদের এ প্রকল্পের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। গবেষণায় দেখা যায়, 'মিড ডে মিল' কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউট উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ১০০ শিশুর মধ্যে ঝরেপড়া শিশুর হার ১৮.৬% (উৎস : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়)। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হ্রাসকরণে সরকার শুরুতে ১০৭ উপজেলায় 'মিড ডে মিল' পাইলটিং কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করে এবং অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। বরগুনার বামনা উপজেলা এ কার্যক্রমের ফলে ঝরেপড়া শিক্ষর্থীর হার ১.০২%-তে নেমে আসে, যেখানে অন্যান্য উপজেলাতে এ হার ৭.৮%। এই ঝরেপড়া হ্রাসের পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদা পূরণেও এ কর্মসূচির ভূমিকা অনস্বীকার্য। 'মিডডে মিল' ৩-১২ বছরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ৩০% ক্যালোরি এবং ৫০% পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারে। (উৎস : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন)।

এ সব গবেষণার প্রেক্ষিতেই মন্ত্রিসভায় ২০২৩ সালের মধ্যে সব প্রাইমারি স্কুলে এ ব্যবস্থা চালুকরণের লক্ষ্যে 'জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯'-এ অনুমোদিত হয়েছে। যেহেতু আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ; তাই মেধাবী, দক্ষ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিনির্মাণে 'মিড ডে মিল'-এর সুপরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ ও ড্রপ আউট রোধে 'মিড ডে মিল'-এর গুরুত্ব :

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, দুপুরের পর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা ও অসুস্থতার অজুহাত হ্রাসকরণের লক্ষ্যে 'মিড ডে মিল' চালুর বিকল্প নেই।

দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশসহ মেধার বিকাশে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী মানবসম্পদ গড়ে উঠতে পারে না।

শহরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে সুবিধাবঞ্চিত ও বাস্তহারা শিশুরা পড়াশোনা করে সেগুলোতে 'মিড ডে মিল' কর্মসূচির আওতায় পুষ্টিসম্পন্ন উন্নত খাবার পরিবেশন করা গেলে বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থিতির হার বৃদ্ধি ও ড্রপ আউট হার উলেস্নখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে।

গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন দরিদ্র পরিবারের শিশুরা যাদের পেটের দায়ে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার প্রবণতা বেশি, তাদের ওই কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী এবং ড্রপ আউট হার হ্রাস পেতে পারে।

খুলনার মতো উপকূলীয় জেলার দূরবর্তী উপজেলাগুলোতে শতভাগ স্কুলে 'মিড ডে মিল' সরবরাহ করা গেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলে আসার প্রবণতা ও ঝরেপড়ার হার স্বভাবতই কমে যাবে। একই সঙ্গে তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণও সম্ভব হবে।

প্রাথমিক শিক্ষার টেকসই মানোন্নয়নে শিশুদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহীকরণের বিকল্প নেই। কেননা, রান্না করা পুষ্টিসম্মত গরম খাবার পরিবেশন করা গেলে শিশুদের স্কুলে আসার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে এবং স্বাস্থ্যগত উন্নতিও সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তাদের স্কুলমুখী হওয়ার প্রবণতা বাড়বে, ফলে ড্রপ আউট হার হ্রাস পাবে।

'মিড ডে মিল' কর্মসূচির টেকসই বাস্তবায়নে প্রায়োগিক সুপারিশসমূহ :

'জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯'-এ বিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত খাবার সরবরাহের বিস্তারিত নীতিমালা উলিস্নখিত হয়েছে। এরই আওতায় 'মিড ডে মিল' কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নে সব অংশীজনের (ঝঃধশবযড়ষফবৎং) কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এ কর্মসূচির অগ্রগতি সম্পর্কে নিয়মিত মাসিক মনিটরিং ও সে সম্পর্কিত প্রতিবেদন উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে প্রেরণ করতে পারেন।

শিশুদের মিড ডে মিল হিসেবে মানসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে কিনা এবং উপরোলিস্নখিত নীতিমালার নির্দেশনা অনুসারে রান্না করা গরম খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে বিশেষ খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগ করা যেতে পারে।

'মিড ডে মিল' কর্মসূচিতে বিভিন্ন ঘএঙ এবং উবাবষড়ঢ়সবহঃ চধৎঃহবৎ-দের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে এবং জাপান ও রাশিয়ায় সরবরাহকৃত উন্নত 'মিড ডে মিল'-এর আদলে আমাদের দেশেও সরবরাহকৃত খাদ্যের মান বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন বিত্তশালী ও ব্যবসায়ীগোষ্ঠীকে এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এতে এ কর্মসূচির মান এবং দীর্ঘমেয়াদে এর কার্যকারিতা টেকসই হবে বলে ধারণা করা যায়।

বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে রোল মডেল। এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের বর্তমান নবীন প্রজন্মকে যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে।

টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিশুদের বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা এবং উপযুক্ত শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। 'মিড ডে মিল' কর্মসূচি এ দুই অভিলক্ষ্যের যুগপৎ বাস্তবায়নে এক কার্যকর উদ্যোগ; যা কিনা প্রাথমিকপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউট হ্রাস এবং শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে কার্যকর অবদান রাখতে পারে। তাই সব অংশীজনের যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে 'মিড ডে মিল' কর্মসূচির দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়ন বর্তমান সময়ের অন্যতম চাহিদা। আর এ ধরনের কার্যকর কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই বিনির্মিত হবে আগামী দিনের স্বপ্নের 'সোনার বাংলা'।

মুহাম্মাদ হেলাল হোসেন: জেলা প্রশাসক খুলনা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<86213 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1