শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইন প্রয়োগ হোক সবার জন্য সমান

যতটুকু ধারণা করা যায়, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২০-এর খসড়াটি একটি অনন্য আইন হতে পারে। আইনটি পাস বা এর প্রয়োগ শুরু হলে এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসতে বাধ্য। কিন্তু যারা এই শৃঙ্খলা আনার কাজটি করবেন তারা কতটা শৃঙ্খলা ধারণ করেন তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশে ভূরি ভূরি আইন আছে এবং সেসব আইনে অনেক সংকট সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া আছে কিন্তু প্রয়োগকারীরা এসব আইন নিয়ে লুকোচুরি করেন বলে কোনো কাজ হয় না। সে জন্য আইন প্রণয়নের পাশাপাশি প্রয়োগকারীদের অপপ্রয়োগ বা দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তির বিধান রাখতে হবে। আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধানের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আইনের প্রয়োগ, বিশেষভাবে কাউকে ছাড় দেওয়া বা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্যও আইন থাকা দরকার। তাহলে আইনটি যেমন শক্তিশালী হবে তেমনি এর প্রতি মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।
সোহেল হায়দার চৌধুরী
  ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২০-এর খসড়া দেখে দেশের মানুষের মধ্যে নতুন আশা জেগেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এ খসড়া থেকে জানা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিরা পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক কোনো পদে থাকতে পারবেন না। তারা বিদেশ ভ্রমণ ও বাড়ি-গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন না। তাদের বা তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে ট্রেড লাইসেন্স ইসু্য হবে না, কোম্পানি নিবন্ধনও করা যাবে না। তারা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কোনো সম্মাননা পাবেন না। রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আইনের এ খসড়াটিকে এক কথায় অসাধারণ বলা চলে। রাষ্ট্র বা সরকার এ ধরনের কঠোর আইন শেষ পর্যন্ত করতে পারলে এবং প্রয়োগ দৃশ্যমান ও দৃষ্টান্তমূলক হলে সত্যিকার অর্থে কিছু শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে আস্থার পাশাপাশি কিছুটা সংশয়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এ আইন কীভাবে চূড়ান্ত হবে এবং আর্থিক খাতে চলমান সব ধরনের বিশৃঙ্খলা এর মাধ্যমে নিরসন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আইনটি পাস হলেও বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে সেটি নিয়েও সংশয় রয়েছে।

এ সংশয়ের পেছনে রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণই দায়ী। দেশে রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে যাওয়ার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, অনিয়ম-অন্যায়-অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় সাধারণ মানুষ অনেক ভালো পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও নানা প্রশ্ন তোলে। যখন নানা ধরনের অপরাধের পরেও প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যান তখন সাধারণ মানুষ ভালো উদ্যোগকেও সন্দেহের চোখে দেখে। জনগণের এই মানসিক অবস্থান বা ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা উল্টোদিকে খুব একটা দেখা যায়নি। দেশে বহু মানুষ বিনা অপরাধে বা বিনা বিচারে আইনের গেঁড়াকলে আটকে আছেন, আবার অনেক মানুষ বেআইনি কাজ করেও দিব্যি বুক উঁচিয়ে চলছেন। সে কারণে আইন ভাঙার অপসংস্কৃতির ধারাটি সতেজ হয়েছে দিনে দিনে।

তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অদম্য সাহস, অব্যাহত দূরদর্শিতা মানুষের মনে আস্থার জন্ম দেয়, হতাশামুক্ত করে দেয় কিছুটা হলেও। সে কারণেই দেশের ৮৬ ভাগ মানুষ শেখ হাসিনার ওপর এবং ৮৫ শতাংশ মানুষ এই সরকারের ওপর আস্থা রাখেন। এই আস্থার ধারা অব্যাহত রাখতে হলে শেখ হাসিনাকেব আরও কঠোর হতে হবে। বিশেষ কোনো মহল বা ব্যক্তি তাকে যাতে কোনোভাবে পথভ্রষ্ট করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কিছুদিন আগে দেশব্যাপী চলমান শুদ্ধি অভিযান নিয়ে সরকার ও শেখ হাসিনার জন্য শুভকামনা ছিল দেশবাসীর। কিন্তু হঠাৎ করে শুদ্ধি অভিযানের উত্তাপ না থাকায় মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে। দেশের মানুষ মনে করে এখনো বিভিন্ন সেক্টরে যে বিশৃঙ্খলা চলমান তার অবসান ঘটাতে পারেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেজন্য মানুষ শুদ্ধি অভিযানের ধারাবাহিকতার অপেক্ষায়। বারবার শেয়ারবাজারে কারসাজি, ব্যাংকিং খাতে গভীর সঙ্কট দেখে জনগণের আস্থায় চিড় ধরে। বিশেষ করে শেয়ারবাজার কারসাজি চক্রের হোতারা যখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়, ব্যাংকিং সেক্টরের কারসাজি চক্র যখন আইনের ফাঁক-ফোকরে পার পেয়ে যান অথবা পেঁয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা আইনের আওতায় আসেন না তখন নানা প্রশ্ন ওঠে।

একথা সত্যি যে, টানা প্রায় ১২ বছর ধরে দেশের শাসনক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারের ব্যাপক সাফল্য রয়েছে। দেশ অর্থনৈতিক ও মানবসূচকে অনেক এগিয়েছে। উন্নয়ন শুধু মুখের বুলি নয়, বাস্তবতা সেটা মানুষ বিশ্বাস করে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সেক্টর ভালো আছে সেটা বলা যাবে না। বিশেষ করে ব্যাংক খাত, শেয়ারবাজার ও আর্থিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে রয়েছে তা দূর করতে এখনো সমর্থ হয়নি সরকার। বরং শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাত সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দু-চারজন ব্যক্তির জন্য শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি অব্যাহত রয়েছে। এই চক্রটি বারবার শেয়ারবাজার লুট করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আর ব্যাংকিং খাতের অপকর্ম ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরাও সরকারের বিভিন্ন মহলের ছায়ায় নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখছেন। এসব মহল বা ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে শেখ হাসিনার ওপর জনগণের আস্থা আরও বাড়বে।

জনগণ ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২০-এর খসড়া নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ বোধ করলেও শেষ পর্যন্ত আইনটি অবিকৃতভাবে থাকবে কিনা সে প্রশ্ন স্বাভাবিক। এ প্রশ্নটি আরও বিস্তৃত হয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়ী মহলের গভীর সম্পৃক্ততার কারণে। রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনার কাজটি করলেও নানাভাবে এখন ব্যবসায়ীরা রাজনীতি পরিচালনা করছেন। প্রায় সব দলেই ব্যবসায়ীদের প্রভাব। একজন রাজনীতিবিদ নানা ঝড়-ঝাপটা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে উঠে আসেন। কিন্তু একজন ব্যবসায়ী কোনো ত্যাগ না করেও শুধু অর্থ-বিত্তের জোরে রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রী-এমপি বনে যাচ্ছেন। এমনকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও ব্যবসা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন। সঙ্কটটি এখানে। রাজনীতি যখন ব্যবসায়ীদের হাতের মুঠোয় বৃত্তবন্দি হচ্ছে, যখন রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেন অর্থ-বিত্তের প্রভাবে তখনই সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। আর এই সঙ্কটের সূত্র ধরে অনেকক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে আইন থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগটি হচ্ছে না।

সরকার বা আইন প্রণেতারা আইন তৈরি করে থাকেন ঠিকই, কিন্তু প্রয়োগের কাজটি করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। সে প্রশাসনেও নানা ধরনের ভূতের আছর থাকে বা ভূত থাকে। এরাই নানা লাভালাভের আশায় বা উৎকোচের বিনিময়ে আইনের সঠিক প্রয়োগ করে না। তাই নানা সঙ্কট বাসা বাঁধে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে অনেক অপরাধী পার পেয়ে যান নানা কৌশলে। আবার প্রশাসনের কেউ কেউ আইনের কৌশলী প্রয়োগ ঘটিয়ে অপরাধীকে মুক্ত করার পাশাপাশি নতুন অপরাধের পথটি তৈরি করে দেন। অব্যাহত আইন ভঙ্গ করার পরেও টিকিটি স্পর্শ করা যায়নি এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের সামনে রয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে একটি নতুন আইন নিয়ে জনগণের মধ্যে আশার আলো দেখা দেয়ার পাশাপাশি সংশয়ও ডানা মেলে।

যতটুকু ধারণা করা যায়, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২০-এর খসড়াটি একটি অনন্য আইন হতে পারে। আইনটি পাস বা এর প্রয়োগ শুরু হলে এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসতে বাধ্য। কিন্তু যারা এই শৃঙ্খলা আনার কাজটি করবেন তারা কতটা শৃঙ্খলা ধারণ করেন তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশে ভূরি ভূরি আইন আছে এবং সেসব আইনে অনেক সংকট সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া আছে কিন্তু প্রয়োগকারীরা এসব আইন নিয়ে লুকোচুরি করেন বলে কোনো কাজ হয় না। সে জন্য আইন প্রণয়নের পাশাপাশি প্রয়োগকারীদের অপপ্রয়োগ বা দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তির বিধান রাখতে হবে। আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির বিধানের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আইনের প্রয়োগ, বিশেষভাবে কাউকে ছাড় দেওয়া বা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্যও আইন থাকা দরকার। তাহলে আইনটি যেমন শক্তিশালী হবে তেমনি এর প্রতি মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।

দেশের অধিকাংশ মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রভাবশালী মহলই কেবল আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় বা আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর সে ক্ষেত্রে উঁচুমহল বরাবরই প্রভাবশালীমহলকে সহযোগিতা করে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে। বাংলাদেশে আজকের বাস্তবতায় আর্থিক সেক্টর ও ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের যে গাঁটছড়া তা যথেষ্ট শক্তিশালী। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে সরকারের অনেক উদ্যোগ বা পদক্ষেপ থমকে গেছে এ গোষ্ঠীর কারণে। অতি সম্প্রতি পেঁয়াজকান্ডের ঘটনাবলিতে মনে হয়েছে সরকারের চেয়ে এ গোষ্ঠীটি অনেক বেশি শক্তিশালী। এটা হয়েছে, পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতার অভাব আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারার কারণে। বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যারা আইন ভাঙবেন বা অব্যাহতভাবে আইন অমান্য করবেন তাদের রাষ্ট্রীয় বা সামায়িকভাবে বয়কট করার কথাটি বহুবার উচ্চারণ করেছি। এবার তার কিছুটা বাস্তবায়িত করা গেলে জনগণ খুশি হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে আইনের বহু প্রয়োগ আমরা যেমন দেখতে পেয়েছি, তেমনি আইন প্রয়োগে বিচূ্যতি বা সদিচ্ছার অভাবও দেখা গেছে প্রয়োগকারীদের মধ্যে। আর সে কারণেই মানুষের অবিশ্বাস-হতাশা দেখা দেয়। এই হতাশা বা সংশয় থেকে মুক্তি দিতে হলে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে কোনো আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তার প্রয়োগের উপরে কার্যকারিতা নির্ভর করে। শুধু আইন করে অপরাধীদের হুমকি-ধমকি বা মানসিক চাপে রাখার দিন প্রায় শেষ। আইনের দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগই কেবল পারে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে। সে জায়গাটিতে আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। এবার তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নেই। আর সেটি পারবেন একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সে কারণেই বাংলাদেশের বাতিঘর শেখ হাসিনার দিকেই এখন বাঙালি ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নিবন্ধিত।

সোহেল হায়দার চৌধুরী: বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক যায়যায়দিন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<86212 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1