শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রীতির বন্ধনই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মূলভিত্তি তাপস হালদার

দেশের সাধারণ মানুষ মোটেও সাম্প্রদায়িক নয়। তাদের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা। এ ধরনের অপচেষ্টা রুখতে সম্প্রীতি বাংলাদেশের সম্প্রীতি সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তাপস হালদার: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
  ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

হাজার বছর ধরে এই ভূখন্ডে জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এ দেশের মানুষের সুমহান ঐতিহ্য। বিশ্বে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি ধর্মপরায়ণ বলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সর্বদাই সহনশীল। বাংলাদেশের মূল শক্তিই হলো বাঙালি জাতিসত্তা। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি। সবার ভাষাই বাংলা। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ স্ব-স্ব ধর্ম পালন করলেও উৎসবের আনন্দ সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে উদযাপন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যথার্থ বলেছেন, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।

ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার্থে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। সংবিধান ও বিদ্যমান আইনে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন বহুবিদ কারণে বিঘ্ন হয়। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে বারবার বাধা সৃষ্টি করছে। জামায়াত-বিএনপির মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলোর অবস্থান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে এখনো বড় বাধা।

এখনো বিশ্বে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম উদাহরণ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর সংহতি ও জাতীয় ঐক্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। হিন্দু- মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানসহ সব ধর্ম এবং বর্ণের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছিল- যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সে জন্যই ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেই থেকে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পথ চলতে শুরু করে। তারই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আদর্শ ভূমিতে পরিণত হতে চলছে।

সম্প্রীতি বাংলাদেশের সঙ্গে গ্রোগাম করতে গিয়ে দেখেছি, বাগেরহাটের পিসি কলেজে মসজিদ মন্দির পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে। তবে অবাক করার বিষয় হলো- মন্দির তৈরিতে অনেক মুসলিম ছাত্র-শিক্ষক অবদান রেখেছেন। তাদের নাম খোদাই করা আছে। এটাই সম্প্রীতির বাংলাদেশ।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় 'গাহি সাম্যর গান' স্স্নোগানকে ধারণ করে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে আত্মপ্রকাশ করে 'সম্প্রীতির বাংলাদেশ' নামে একটি সামাজিক সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ- যারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সংগঠনটির জন্ম হয়। বিশ্বে সম্ভবত প্রথম কোনো সংগঠন যেখানে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে নিয়ে সংগঠনটি করা হয়েছে।

বর্তমান সময়ে সারাবিশ্ব সন্ত্রাসবাদ ও জাতিগত দ্বন্দ্বে অস্থির টালমাটাল। আমেরিকায় চলছে সাদা-কালোর লড়াই, আরব দেশগুলোতে শিয়া-সুন্নির লড়াই, ইউরোপের প্রতিটি দেশও রয়েছে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিতে; জাতিগত দ্বন্দ্বে মিয়ানমারে চলছে সংখ্যালঘু মুসলিম নিধন, ভারত-পাকিস্তানে চলছে যুদ্ধের মহড়া। বাংলাদেশেও কয়েকটি উগ্রপন্থি ইসলামী সংগঠন রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে গুজব সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার পরিবেশ তৈরি করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা তার পিতার মতোই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে বিধায় তিনি সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে কঠোর হস্তে দমন করেন। সে জন্য উগ্র সন্ত্রাসবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না; কিন্তু ঝুঁকিতে নেই সে কথা বলা যাবে না। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজের সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী পস্নাটফরমের খুব প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম পুরোধা, সর্বজন শ্রদ্ধেয় বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাবের নেতৃত্বে প্রগতিশীল ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হলো সম্প্রীতি বাংলাদেশ। যাদের মূল উদ্দেশ্যে হলো, বাংলাদেশ হবে একটি অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাষ্ট্র।

মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাস বলেছেন, সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে ধর্ম বর্ণ ও জাতি দিয়ে পার্থক্য করে দেখার নামই সাম্প্রদায়িকতা। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। পৃথিবীর সব ধর্মের মূল কথা প্রেম, মৈত্রী, শান্তি ও সম্প্রীতি। অথচ এই উপমহাদেশেও বিভিন্ন শাসকরা রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। ব্রিটিশরা তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে রাখত। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত এ অঞ্চলে অসংখ্য দাঙ্গা হয়েছে, নিহত হয়েছে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ। যার ফলে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান আমলেও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৭১ সালে সার্বজনীন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুসলমান হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষ সমন্বিতভাবে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। আমরা পেয়েছিলাম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ। মুসলমান হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান যার যার ধর্ম সেই সেই পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।

অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দুই সামরিক শাসকই রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে নষ্ট করে সাম্প্রদায়িকতার বীজবপন করে। আবার বাংলাদেশে বিভক্তির রাজনীতির শুরু হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়। এখনো তাদের প্রেতাত্মারা বিভিন্ন ইসু্য তৈরি করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়। রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, নাসির নগরে হিন্দু পলস্নীতে হামলা, পাবনার সাঁথিয়ায় হামলা, নওগাঁয় সাওতাল কৃষকদের হত্যা অন্যতম। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপে দ্রম্নত দমন করা হয়েছে।

এ দেশের সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু হলে উগ্রপন্থী নয়। বিছিন্নভাবে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে তা অনেক সময় রাজনৈতিক আবার কখনো ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না বরং একে অপরের সহযোহিতায় এগিয়ে এসেছে এরকম উদাহরণ অনেক আছে। অতি সাম্প্রতিক কালে ভোলার বোরহানউদ্দিনের ঘটনায় চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মাদ্রাসার মসজিদের পাশেই শ্রী শ্রী সীতা কালী মন্দিরে কয়েকজন দুষ্কৃতকারী ইট-পাটকেল ছুড়ে মারছিল, তখন মাদ্রাসার ছাত্ররাই তাদের রুখে দিয়ে মন্দিরের চারিদিকে মানব প্রাচীর করে দাঁড়িয়ে ছিল। সুপ্রাচীনকাল থেকে মুসলিম-হিন্দুর মিলিত সংস্কৃতিই বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে যেমন আযানের ধ্বনিতে ভোরে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে, তেমনি সূর্যাস্তের সময় উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি শোনা যায়।

সম্প্রীতি বাংলাদেশ সংগঠনটি দেশব্যাপী সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনের জেলা সফরে কয়েকটি জায়গায় আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, পেশাজীবীর, সরকারি কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলা ও তাদের বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিনিধিদের বক্তব্যগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে- যারা ধর্ম সম্পর্কে বেশি জানে তারা তত বেশি অসাম্প্রদায়িক। প্রত্যেক ধর্মের মূল কথাই হলো শান্তি। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করা। ধর্মীয় প্রতিনিধিরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা করছেন।

দেশের সাধারণ মানুষ মোটেও সাম্প্রদায়িক নয়। তাদের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য যে সব ঘটনা ঘটেছে তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা। এ ধরনের অপচেষ্টা রুখতে সম্প্রীতি বাংলাদেশের সম্প্রীতি সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশ্ব যখন আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষফোড়ায় আক্রান্ত, এমন একটি সময় আশার আলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ। বিগত নির্বাচনের পূর্বে 'পথ হারাবে না বাংলাদেশ' স্স্নোগানকে ধারণ করে সারাদেশে সমাবেশ করে একটি বার্তা দিয়েছিল, 'আমার ভোট আমি দেব, অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে দিব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যদায় নিয়ে যাচ্ছেন। সে জন্য দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রয়োজন। সম্প্রীতি বাংলাদেশ সেই বার্তাটি নিয়েই সারাদেশে কাজ করে যাচ্ছে। যদি সম্প্রীতির বন্ধনটা দৃঢ় হয় তাহলেই অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

যধষফবৎঃধঢ়ধং৮০@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<86040 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1