শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পেডাগোজি, ডিজিটাল নেটিভ এবং জাতীয় শোক দিবসের অভিজ্ঞতা

এবারের জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে সবর্স্তরের মানুষের উপস্থিতি বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দেখা গিয়েছে। শোকাতর্ মানুষের ঢল নেমেছিল। এ ব্যাপারে আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের মন্তব্য জানতে চেয়েছি। কেউ কেউ বলছেন এবারের ১৫ আগস্ট বৃষ্টি না হওয়ায় এই উপস্থিতি সম্ভব হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূবের্ বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে যে শক্তি অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল সেই শক্তি এখন ক্ষমতার লোভে বতর্মান সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে চলছে।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
  ১৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

বতর্মান যুগ হচ্ছে ডিজিটাল যুগ। ডিজিটাল যুগে যারা জন্মগ্রহণ করেছে তাদের ‘ডিজিটাল নেটিভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, শিক্ষাদানের তত্ত¡ এবং অনুশীলন এবং কীভাবে এগুলো শিক্ষাথীের্দর শিখনকে প্রভাবিত করে তাই হচ্ছে পেডাগোজি। শিখনের তত্ত¡সমূহ বিবেচনায় নিয়ে পেডাগোজি শিক্ষকদের ক্রিয়াকাÐ, বিচার-বিবেচনা এবং শিখন কৌশল, শিক্ষাথীের্দর বোঝাপড়া এবং তাদের চাহিদা, এবং প্রত্যেক শিক্ষাথীের্দর পটভ‚মি এবং আগ্রহ প্রভৃতি অবগত করে থাকে। শিক্ষক-শিক্ষাথীর্ মিথস্ক্রিয়া এবং শিক্ষকরা যে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী এসবও পেডাগোজির অন্তভুর্ক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাথীের্দর নিয়ে কোন বিষয়ে মিথস্ক্রিয়ামূলক পাঠচক্র, বিতকর্ বা সেমিনারের আয়োজন করা পেডাগোজিক্যাল কালচারের অংশ। উচ্চশিক্ষার গুণগতমান সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এখন যে উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত গুণগত সংস্কৃৃতি গড়ে তুলতে চাইছে সেটি আসলে পেডাগোজিক্যাল কালচার।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার এই পেডাগোজিক্যাল অনুষঙ্গের প্রয়োজনে এবারে জাতীয় শোক দিবস ২০১৮ উপলক্ষে দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এ ধরনের সেমিনারগুলোতে সচরাচর একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু আলোচিত সেমিনারে একটি গবেষণা প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। পরে তার ওপর উপস্থিতির মধ্য থেকে কয়েকজন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, গতবারের মতো এবারেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা কাজে বরাদ্দ দেয়ার লক্ষ্যে গবেষণা প্রস্তাব আহŸান করা হয়েছিল। এই গবেষণা প্রস্তাবটি ছিল সেই সব গবেষণা প্রস্তাবের একটি। যতগুলো গবেষণা প্রস্তাব জমা পড়েছে সেগুলোর মধ্যে শুধু এই একটি গবেষণা প্রস্তাবই ৪৩তম জাতীয় শোক দিবসে আলোচনার বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসম্পকের্ আরও আলোচনার আগে এবারের জাতীয় শোক দিবস সম্পকের্ কিছু আলোকপাত করা সঙ্গত হবে।

এবারের জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে সবর্স্তরের মানুষের উপস্থিতি বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দেখা গিয়েছে। শোকাতর্ মানুষের ঢল নেমেছিল। এ ব্যাপারে আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের মন্তব্য জানতে চেয়েছি। কেউ কেউ বলছেন এবারের ১৫ আগস্ট বৃষ্টি না হওয়ায় এই উপস্থিতি সম্ভব হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূবের্ বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে যে শক্তি অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল সেই শক্তি এখন ক্ষমতার লোভে বতর্মান সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে চলছে।

অনেকে আবার ছাত্রদল, ছাত্র শিবির প্রভৃতি করত কিন্তু এখন সুযোগ-সুবিধার আশায় ভোল পাল্টিয়ে এই কাতারে সামিল হয়েছে। যেভাবেই হোক, জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য লাখো মানুষের শোকাতর্ উপস্থিতি আমাকে স্মৃতিকাতর করে তুলেছিল।

এবারে (২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট) আমরা কয়জন কলাবাগানের লাজ ফামার্র সামনে লাইনে দঁাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। সে সময়ে মানসপটে ভেসে উঠেছিল ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্টের স্মৃতি। মাত্র এক বছর পূবের্ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ববর্রতম ও নৃশংস হত্যাকাÐের শিকার হয়েছিলেন সবর্কালের সবের্শ্রষ্ঠ বাঙালি জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই কলঙ্কজনক ঘটনার পরের বছর (১৯৭৬) আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির্ হয়েছিলাম। জুলাই মাসে ভতির্ হওয়ার পরের মাসই জাতির পিতা হত্যাকাÐের শোকাবহ আগস্ট। বলা বাহুল্য, তখনও জাতীয় ছাত্রলীগের অস্তিত্ব বহাল ছিল। ১৯৭৬ সালের ১৪ আগস্ট গভীর রাতে জাতীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা আমরা যে কক্ষের ফ্লোরে ঘুমাতাম জগন্নাথ হলের সাউথ হাউসের ২৬৪ নম্বর কক্ষে কড়া নেড়ে আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন। তারা পরের দিন ১৫ আগস্ট ভোরে ধানমÐি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য যাওয়ার কমর্সূচির কথা জানিয়েছিলেন। সে কথা অনুযায়ী খুব ভোরে হল থেকে আমরা রওনা দিই। এখন যেমন ফুল কিনতে পাওয়া যায় তখন এরকম কোনো আয়োজন ঢাকা শহরে ছিল না। মনে আছে, আগের দিন বিকালে গুলিস্তান থেকে আমি একটি কাপড়ের ব্যাগ কিনেছিলাম। কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় সেই ব্যাগটি নিয়ে বের হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল হলের বাগান থেকে কিছু ফুল নেয়া। সেই অনুযায়ী বেশ কিছু ফুল তুলে ব্যাগ ভতির্ করলাম। তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে এবং জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে ঢাকা-আরিচা বাস চলাচল করত। আমরা মাত্র ৪-৫ জন মেডিকেলের পাশ থেকে সেরকম একটি বাসে উঠলাম। বাসটি কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে থামার পর আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমার কঁাধে ছিল ফুলের ব্যাগ। বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে পুলিশের একটি জিপ কড়া ব্রেক চেপে সেখানে থেমেছিল। জিপ থেকে লাফিয়ে কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ আমাদের উদ্দেশ্যে ধাওয়া করেছিল। সবাই দৌড়ে চলে যেতে পারলেও, কঁাধের ব্যাগে পুলিশের হ্যাচকা টানে আমি মাটিতে পড়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার পিঠে, হঁাটুতে এবং হাতে পুলিশের লাঠির আঘাত পড়তে থাকে। ফুটপাথে ধুলোবালির মধ্যে শোয়া অবস্থায় রেখে পুলিশ আমার ফুলসহ ব্যাগটি নিয়ে চলে গিয়েছিল। আমি ওভাবেই শোয়া অবস্থায় ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ফুটপাথের পানের দোকানদার এবং পাশের হোটেলের কয়েকজন বয় আমাকে টেনে তুলে রাস্তার ওপাশে নিয়ে গুলিস্তানের অভিমুখে চলমান একটি বাস থামিয়ে তাতে আমাকে উঠিয়ে দিয়েছিল। এসে দেখি যারা দৌড়ে এসেছিল, বেশ কিছুক্ষণ আগেই তারা হলে এসে পেঁৗছেছে। আমাদের জগন্নাথ হলে তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতাকমীর্রা আত্মগোপন করে থাকতেন। মাদারীপুর জেলার আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা হারুন-উর রশীদ মোল্লা এবং কৃষক লীগ নেতা আব্দুল লতিফ খানও তখন ওখানেই থাকতেন। মনে আছে, তখন তারা দুজনেই বলেছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর জন্য আঘাত পাওয়াতে আমার জীবন ধন্য হয়েছে! ২০১৮’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনাথের্ কলাবাগানের লাজ ফামার্র সামনে দঁাড়িয়ে থাকাকালে ৪৩ বছর আগের সেই স্মৃতি আমাকে তাড়া করছিল। যাহোক, এবারে ৪৩তম জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনার প্রসঙ্গে আসা যাক।

গবেষণা প্রস্তাবটির শিরোনাম খরনবৎধঃরড়হ ধিৎ ড়ভ ১৯৭১ ধহফ ইধহমষধফবংয রহ ২১ংঃ ঈবহঃঁৎু : অহ ঊহয়ঁরৎু রহঃড় ঃযব ঝঃধঃব ড়ভ ঘধঃরড়হ ধহফ এবহবৎধঃরড়হ. । এতে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের বতর্মান উন্নয়নের গতি প্রভৃতি সম্পকের্ একাত্তর পরবতীর্ প্রজন্মের ধারণা বা মনোভাব অনুসন্ধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি উপস্থাপনের শুরুতেই নিউ ইয়কের্র সোশ্যাল সায়েন্স রিসাসর্ কাউন্সিল কতৃর্ক প্রকাশিত, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডাম প্রেজেরস্কি এবং উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাঙ্ক সলোমন কতৃর্ক লিখিত ‘অন দ্যা আটর্ অব রাইটিং প্রোপোজালস্’-এর অংশ বিশেষ ¯øাইডে দেখানো হয়। যেখানে একটি প্রশ্ন দিয়ে গবেষণা প্রস্তাব শুরুকে ‘এক্সিলেন্ট’ এবং সেন্ট্রাল পয়েন্ট বা হাইপোথিসিস বা ব্যাখ্যামূলক কোনো বিবরণ দিয়ে গবেষণা প্রস্তাব শুরুকে ‘গুড’ (উত্তম) বলা হয়েছে। সেমিনারে উপস্থাপিত গবেষণা প্রস্তাবটি একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা হয়েছে, ঐড়ি ঃযব ঢ়ড়ংঃ-১৯৭১ মবহবৎধঃরড়হ ারবি ঃযব ষরনবৎধঃরড়হ ধিৎ ড়ভ ১৯৭১ রহ ২১ংঃ পবহঃঁৎু ইধহমষধফবংয?

উপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে দু’একজন বাদে সেমিনারের প্রধান আলোচক একজন অধ্যাপকসহ প্রায় সবাই এবারে গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। সেমিনারের আলোচক ‘অধ্যাপকের’ গবেষণা প্রস্তাবটি দেখেছেন এবং পড়েছেন এমন একজন সহকমীর্ বলছেন, ‘আলোচক অধ্যাপক’ তার নিজের প্রণীত প্রস্তাবটি কোন প্রশ্ন বা সেন্ট্রাল পয়েন্ট বা হাইপোথিসিস বা একটি ব্যাখ্যা কোনো কিছু দিয়েই শুরু করেন নাই। যেটি আলোচনার সময় তিনি বলেন নাই। অথচ এই তথ্যটি গোপন না করে তা সেমিনারে শেয়ার করলে কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না। বরং তা আলোচনাকে আরও খোলামেলা প্রাণবন্ত করে তুলতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। খোলামেলাভাবে নিজের একাডেমিক গবেষণার কাজ সম্পকির্ত বিষয় শেয়ার না করার এই মানসিকতা প্লাজিয়ারিজমকে উৎসাহিত করে। আমাদের দেশে প্রচলিত সংস্কৃতির একটি অংশ যে ঠাট বজায় রাখতে নিজের অনেক দুবর্লতা বা অন্য অনেক কিছুই গোপন করে বা কখনো কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। এই মানসিকতা প্লাজিয়ারিজমের উৎস। শিক্ষাথীের্দর উন্নত মানের গবেষণায় পারদশীর্ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই মন-মানসিকতাই বাংলাদেশর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

গবেষণা কৌশলে দক্ষতার ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার জন্য খোলামেলাভাবে নিজের দুবর্লতাগুলোকে দূর করার জন্য পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ামূলক কমর্কাÐ বাড়ানো প্রয়োজন। আর এভাবেই ‘পেডাগোজিক্যাল কালচারের’ প্রসঙ্গ এসে যায়। পেডাগোজিক্যাল কালচার হচ্ছে ব্যক্তিত্বের একটি সৎ বৈশিষ্ট্য এবং এর জন্য প্রয়োজন হয় পেশাদারি এবং পেডাগোজিক্যাল মূল্যবোধের নিদির্ষ্ট মাত্রার ওস্তাদি। বৈজ্ঞানিকরা প্রমাণ করেছেন যে ভবিষ্যৎ শিক্ষকদের পেডাগোজিক্যাল কালচার হচ্ছে তার ব্যক্তিত্বের একটি জটিল সামাজিক বৈশিষ্ট্য, যা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের পেডাগোজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। একই সঙ্গে, এটি আধ্যাত্মিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন স্তরের সূচক; পাশাপাশি এটি বিশেষজ্ঞ-শিক্ষকের জ্ঞান, দক্ষতা, উচ্চ পেশাদারিত্ব, পেশাগতভাবে গুরুত্বপূণর্ গুণাবলি সংযুক্ত করে যা পেডাগোজিক্যাল দায়িত্বাবলি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বতর্মান অথর্নীতি ১৯৭১ থেকে ২০০১ পযর্ন্ত যে অবস্থায় ছিল তা থেকে সম্পূণর্ আলাদা। মাঝখানে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পযর্ন্ত এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পযর্ন্ত সময়গুলো বাদে সামরিক বেসামরিক শাসনের অবশিষ্ট সময়গুলো অথৈর্নতিক স্থবিরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অতিবাহিত করেছে। ২০১৭ সালেই প্রথমবারের মতো দেশটি উন্নয়নশীল দেশের মযার্দা লাভ করেছে। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, ১৯৭১ থেকে ২০০১ পযর্ন্ত যেসব তথ্য বা উপকরণ ব্যবহার করে বা যে পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষা দানের কাজটি সম্পন্ন করা হতো, তা এখন সম্পূণর্ অচল। এই মাত্র সেদিন আমাদের এক জ্যেষ্ঠ সহকমীর্ তার মাস্টাসর্ পড়াকালে একটি বইয়ের নাম বলে সেটি সংগ্রহের জন্য বলছিলেন। তার মাস্টাসের্র কাল হচ্ছে ১৯৭৮ সাল। আর তিনি যে বিষয়ের বইয়ের কথা বলছিলেন সেটি হচ্ছে ‘সামাজিক পরিবতর্ন’। অতএব, বলা বাহুল্য তিনি যে বইটির নাম বলছিলেন, জানার জন্য তা পড়া গেলেও পরিবতির্ত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কোসের্র শিক্ষাদানের উপকরণ হিসেবে তা একেবারেই অচল এবং সেকেলে। আর এজন্যই সব বিষয়ের বা সব কোসের্র সাম্প্রতিকতম তথ্য সম্পকের্ শিক্ষকদের মধ্যে বা শিক্ষক ও শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন অনস্বীকাযর্। এটিই পেডাগোজিক্যাল কালচারের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের জন্য জাতিকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসার আহŸান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন বাংলাদেশ এখন অথৈর্নতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সরকার অথর্ বরাদ্দ দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্ব খুব দ্রæতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিদিনই তা অধিকহারে প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান উন্নত করার জন্য উন্নত শিক্ষা সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সে হিসেবে, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আলোচিত সেমিনারের এই আয়োজনটিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূণর্।

হাঙ্গেরির মিসকোল্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমরি কèাউস্জ ‘অন পেডাগোজিক্যাল কালচার’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একটি ‘অগাির্নজম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ‘অগাির্নজম’-এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বাংলা অথর্ করা যেতে পারে, ‘সবর্ অঙ্গ নিয়ে কমর্শীল একটি প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে। উচ্চশিক্ষার গুণগত মান সম্প্রসারণে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘প্যারাডাইম শিফ্ট’ সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিখন-শিক্ষা এবং গবেষণার গুণগত মানবৃদ্ধি এবং তা টেকসই করা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি অন্যতম দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। ইউজিসি বুলেটিনের জানুয়ারি-মাচর্ ২০১৭ সংখ্যায় সম্পাদকীয় লিখেছেন সম্মানীয় সদস্য প্রফেসর মোহাম্মদ ইউসুফ আলী মোল্লা। তিনি বলছেন, বতর্মানের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সব স্তরে বিশেষত উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষার গুণগতমান সম্প্রসারণ করা অধিকতর গুরুত্বপূণর্ হয়ে দঁাড়িয়েছে। আর এ লক্ষ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল (কিউএসি) প্রতিষ্ঠা করেছে। এ পযর্ন্ত ৬৩টি পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইন্টারনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল’ (আইকিউএসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর আগে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে শিক্ষা দিয়ে থাকে সেগুলোর ‘কোয়ালিটি অ্যাসেস’ করার কোনো কমর্-কৌশল বা পদ্ধতি কোনোটিই ছিল না। আইকিউএসি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে কোয়ালিটি অ্যাসেস করা এখন বাধ্যতামূলক কাজে পরিণত হয়েছে। জাতীয় সংসদে সম্প্রতি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল আইন পাস করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের ‘সনদ’ প্রাপ্ত হতে হবে। আর তাই পেডাগোজিক্যাল কালচারের দিকে আমাদের অবশ্যই সতকর্তার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

উপরোল্লিখিত, সেমিনারের গবেষণা প্রস্তাবটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে একাত্তর পরবতীর্ প্রজন্ম একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে দঁাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পকের্ কী মনোভাব পোষণ করে, সে সম্পকের্ অনুসন্ধান করা। ‘জেনারেশন হু কেয়ারস জেনারেশন’ শিরোনামে নঈম নিজাম যে প্রজন্মের কথা বলেছেন তারা মূলত একাত্তর পরবতীর্ই নয়Ñ শুধু তারা ১৯৭৫ পরবতীর্ প্রজন্ম। তাদের মধ্যে এখন যারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্ তারা আবার ‘ডিজিটাল নেটিভ’। এই ডিজিটাল নেটিভদের তিনি বলেছেন, ‘হু কেয়ারস জেনারেশন’। তার মতে, ‘এই প্রজন্মকে নিয়ে কেউ রাজনীতি না করাই ভালো। কারণ এই জেনারেশন ¯েøাগান দিয়েছে, ‘যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ। যদি তুমি রুখে দঁাড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ।’ বলতে দ্বিধা নেই এই প্রজন্মকে নিয়ে কেউ রাজনীতি করতে পারছে বলে মনে হয় না। বরঞ্চ এই প্রজন্মই হচ্ছে রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই জেনারেশন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বতর্মান বাংলাদেশ সম্পকের্ যে চিন্তা-ভাবনা করে তা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূণর্ বিষয়।

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সাকের্ল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<8176 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1