বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাইবার ক্রাইমে অপ্রাপ্তবয়স্করা, প্রয়োজন সবার সচেতনতা

আমাদের সন্তানদের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সন্তান যেন তার সব কথা মা-বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে সেই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে অভিভাবকদেরই। তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারব শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যৎ।
সাহাদাৎ রানা
  ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, অন্ধকার ঘরে আগুনের কাজ কি? উত্তর- ঘর আলো করা। আবার যদি প্রশ্ন করা হয় আগুনে হাত দেয়ার অর্থ কি? উত্তর- হাত পুড়ে যাওয়া। অর্থাৎ আমরা এখানে আগুনকে পাচ্ছি দুই ভাবে। ভালো এবং মন্দ। মানে এখানে আগুনের ব্যবহারের ওপর ভালো ও মন্দ নির্ভর করে। আমরা আগুনকে যে যেভাবে ব্যবহার করি আগুনও প্রতিদান হিসেবে তাই দেয়। যেখানে আগুনের কোনো দোষ নেই। এখানে ব্যবহারকারীদের দায়। আগুন আবিষ্কারের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আগুন ছাড়া আমরা একটি মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। সম্ভবও নয়। কারণ বেঁচে থাকতে হলে নিত্যদিন আগুনের প্রয়োজন।

বর্তমানে আগুনের মতো আরও একটি জিনিস রয়েছে- যা আমাদের ক্রমশ শঙ্কিত করে তুলছে। মূলত আমরা নিজেরা নিজেদের শঙ্কিত করে তুলছি আমাদের অপব্যবহারের কারণে। বিষয়টি ইন্টারনেট। ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর আমাদের জীবন ব্যবস্থায় এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। বিশ্বটা চলে এসেছে আমাদের হাতের মুঠোয়। খবর পেয়ে যাচ্ছি মুহূর্তে। বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন। নিত্যদিন নাগরিক জীবনে আমাদের প্রয়োজন ইন্টারনেট। এই প্রয়োজনীয়তা বাস্তবতার নিরিখে। কারণ ইন্টারনেট আমাদের সামনে আজ অসীম তথ্য ভান্ডারের দ্বার উন্মোচন করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করেছে সহজতর। বিশেষ করে মুঠোফোনে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিস্থিতি আরো বিস্তৃত হয়েছে। এখন শুধু একটি নির্দিষ্ট বয়সের মানুষই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। বরং এখন শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়স সবাই যার যার প্রয়োজন মিটিয়ে থাকেন ইন্টারনেটকে মাধ্যম করে। যুক্ত থাকেন দিনের অনেকটা সময়। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে। একদিকে এর যেমন সুফল আছে তেমনি রয়েছে কুফলও। তবে এর বিপরীতে কিছু নেতিবাচক ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের অপব্যবহারের বিষয়ে। এখন ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধ। এর কুফলটা বর্তমান সময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে ইন্টারনেটের নয়, এর ব্যবহারকারীদের অপব্যবহারই দায়ী।

একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমাদের দেশে ইন্টারনেট প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। যদিও সে সময় এ বিষয়ে অপরাধ ছিল না বললেই চলে। তবে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের পরিমাণও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসহনীয়। প্রথমে ব্যক্তি পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে অপরাধ সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার যত বিকাশ হয়েছে এই অপরাধেরও ততটাই বিকাশ ঘটেছে। এর প্রসার এতটাই বেড়েছে যে, সরকারকে সাইবার ক্রাইম রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ ফোর্স গঠন করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও অপরাধীদের রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন শুধু ব্যক্তি নয়, সংগঠিত বহু গ্রম্নপ এই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করছে। আবার কেউ সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়ের খবর হলো আমাদের তরুণ সমাজ ইন্টারনেটে আসক্তি হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে আমাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহার রীতিমতো আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। ইন্টারনেট ব্যবহারে দোষের কিছু নেই। তবে সম্প্রতি আমাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের ইন্টারনেটের প্রতি অতি আসক্তি রীতিমতো ঝুঁকি তৈরি করছে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইন্টারনেট আমাদের সবার কাছে অসীম তথ্যভান্ডার- যা আমাদের সন্তানদের জন্য যেমন শিক্ষা ও বিনোদনের দ্বার উন্মোচিত করেছে, তেমনি ফেলেছে অস্বস্তিতেও। এখন আমরা আমাদের কর্মব্যস্ততার কারণে আমাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছি মোবাইল ফোন। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো ইতিবাচক দিক। বিশেষ করে কর্মজীবী পিতামাতা যেন তাদের সন্তানদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখতে পারেন। এ ছাড়া সন্তানদের দেয়া হচ্ছে কম্পিউটার। যাতে তারা দ্রম্নত পৃথিবী সম্পর্কে জানতে পারে। এতে একদিকে সন্তানের মানসিক বিকাশ যেমন হচ্ছে, তেমনি নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে সক্ষম হচ্ছে। কারণ, শিশুরা এই দুনিয়ার বাইরের কেউ নয়। প্রতিযোগিতার বাজারে এগিয়ে যেতে হলে এটা প্রয়োজন; সময়ের দাবিও। কিন্তু নেতিবাচক কিছু কর্মকান্ডে এসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা জড়িয়ে পড়ায় উঠেছে প্রশ্ন।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটের অপব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতিসহ নানা বয়সী মানুষ আজ অনেকটা হুমকির মুখে। বিশেষ করে প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারে সমাজে বাড়ছে ধর্ষণ, নির্যাতন ও যৌন হয়রানির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এর জন্য ইন্টারনেট বা প্রযুক্তি কোনোভাবেই দায়ী নয়। দায়ী আমরা। আমাদের সচেতনতার অভাব প্রধানত মূল কারণ। এটা সত্যি তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রযুক্তি ছাড়া আমরা ভাবতে পারি না একটি মুহূর্তও। এর থেকে প্রতিকারের জন্য তাই নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে অবগত হওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা ব্যবহার করছে ইন্টারনেট।

সম্প্রতি আরও কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে। বিশেষত ফেসবুক ও ভিডিও গেমস আসক্তি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্ধ করে দিচ্ছে তরুণদের। ভুলে যাচ্ছে হিতাহিত জ্ঞান। ফেসবুকে যা ইচ্ছে লিখছে, শেয়ার করছে। আবার কখনো এমন কিছু করছে- যাতে নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র। আর এটা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো বয়সের মধ্যে ফেসবুক নিবন্ধনের নিয়মনীতি না থাকায়। আর এই সুযোগে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু-কিশোররা যুক্ত হচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য সামাজিক মাধ্যম। এসব সাইটে কিশোরদের সম্পৃক্ততা তাদের নানাবিধ ঝুঁকিতে ফেলছে। অকারণে অপরিচিত মানুষ আপন হয়ে নানা ক্ষতিসাধন করছে। অপরাধে পথে পা রাখতে উৎসাহিত করছে। তাদের ব্যবহার করছে টোপ হিসেবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে সারা দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর সাইবার অপরাধের দিকে এখন বেশি ঝুঁকছে ১৮ বছরের কম বয়সীরা। এর কারণ আর কিছুই নয়, এই বয়সটা আসলে ভীষণভাবে রোমাঞ্চমুখী। ফলে তারা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই ভুল পথে পা রাখে। এটা সত্যিই আমাদের জন্য শঙ্কার কথা।

এ ছাড়া আমাদের সন্তানরা দিন দিন কম্পিউটার গেমসেও আসক্ত হয়ে পড়ছে। আগে দোকানে গিয়ে ভিডিও গেমস খেলার সুযোগ থাকলেও এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অতি সহজে তা করতে পারছে। আর এটা বেশির ভাগ সময় অভিভাবকদের সামনেই হয়ে থাকে। অভিভাবকরা চিন্তা করেন তার সন্তান যেন কোনো একটি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই তারা এটা নিয়ে সেভাবে মাথা ঘামান না। কিন্তু এমন নীরব সম্মতি দিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের কি ভয়ানক ক্ষতি করছি তা নিয়ে আমরা একবারও ভাবছি না। তাই এখানে অভিভাবকদের দায় সবার আগে। কেননা, আমাদের সামনে সন্তানরা দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে আছে, তারা বুঝতে পারে না যে এর মাঝে সতর্ক হওয়া কতটা জরুরি। গবেষণায় প্রকাশ দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহার করলে মানুষের মস্তিষ্কে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। তবে বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও বেশি। তাই এ বিষয়ে একটু বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে। কারণ আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই আমাদের কোমলমতি শিশু-সন্তান থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের এসব ব্যবহারে আমাদের আরও সচেতন হওয়ার এখনই সময়।

তবে এর জন্য সন্তানদের ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে সরিয়ে আনতে হবে তা এমন নয়। বরং সন্তানদের ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে সরিয়ে না এনে সময়োপযোগী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে অভিভাবকদের।

আমাদের সন্তানদের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সন্তান যেন তার সব কথা মা-বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে সেই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে অভিভাবকদেরই। তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারব শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যৎ।

তাই সব অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। কারণ এখনই সময়। আর পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই।

\হ

সাহাদাৎ রানা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79518 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1