শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

এম কে দোলন বিশ্বাস ঢাকা
  ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বাঙালি এ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কলকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান। তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি মায়ের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া সেখানে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯১৮ সালে 'গ্রেস ইন' হতে 'বার এট ল' ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে এসে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯২০ সালে তিনি বেগম নেয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করেন। নেয়াজ ফাতেমা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আবদুর রহিমের কন্যা।

একটি অভিজাত ও ঐতিহ্যমন্ডিত পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি জনসেবামূলক রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাতারে সামিল হন। অল্প সময়ের মধ্যে গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দীর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীকে পরিণত হন। ক্ষমতার মোহ কখনো তাকে তার আরাধ্য জীবন দর্শন ও আদর্শ হতে বিচু্যত করতে পারেনি। পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অগ্রণী নেতা হয়েও তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দাঙ্গা-পীড়িত কলকাতা শহরে থেকে গিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য। ওই সময় আর্ত-মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যে শান্তি মিশন পরিচালনা করেন, একদিন না একদিন ইতিহাস তার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চয়ই করবে। আজীবন জনগণের রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবরণসহ তাকে একাধিকবার হত্যারও চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তান আমলে তাকে রাজনীতি থেকে উচ্ছেদ করা ও নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা ইত্যাদি সবই ছিল তৎকালীন স্বৈরশাসকদের জঘন্য ষড়যন্ত্র ও অপরাজনীতির ফল। নির্বাসনে হতোদ্যম জীবনের একপর্যায়ে তার নিঃসঙ্গ মৃতৃ্য হলেও এখনো তিনি গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের অন্তরে সমুজ্জ্বল ও স্থায়ী আসনে সমাসীন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। আর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়ন এবং স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি এ দেশের জনগণকে সোচ্চার ও সংগঠিত করেছিলেন। তিনি আজীবন দেশবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। এজন্যই দেশবাসী তাকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবেই জানে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অবিস্মরণীয় বিজয়। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকায় সুধী সমাজের কাছে তিনি 'গণতন্ত্রের মানসপুত্র' হিসেবে আখ্যায়িত হন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এ দেশের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কও। তার প্রচেষ্টার ফল হিসেবেই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। ওই সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যাতে বাঙালি দেখতে পায় আশার আলো। এতেই তার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। তবে তিনি শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও জনমতের প্রতি ছিলেন আজীবন শ্রদ্ধাশীল ও একনিষ্ঠ। তাই সুধী সমাজ তাকে 'গণতন্ত্রের মানসপুত্র' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার নেতৃত্বের অসাধারণ বলিষ্ঠতা, দৃঢ়তা ও গুণাবলি জাতিকে সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা দেয়। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতি যুগে যুগে তাকে স্মরণ করবে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইংরেজি ও আইন শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। রাজনৈতিক জীবনে খেলাফত আন্দোলনকারী ভ্রাতৃদ্বয় মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী, স্বরাজ পার্টির নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ রাজনীতিবিদ ও মনীষীর সংস্পর্শে আসেন। আর এভাবেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুসলমানদের প্রতি দরদ এবং অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মানস গড়ে ওঠে। তার মতে, 'যে জাতি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে না, সে জাতি আসলে নিজেকেও রক্ষা করতে পারে না।' আবার ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক স্থায়িত্ব নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর- অবাধে গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণের সুযোগ প্রদান, অক্ষরে অক্ষরে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান মেনে চলা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা।' তার ভাষায়, 'রাজনীতি একটি শক্তিশালী অস্ত্র, এর ন্যায্য উদ্দেশ্য ও সম্মানজনক লক্ষ্য সাধনের জন্য সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে।' এ মহান নেতার এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক ও বিশেষভাবে অনুসরণীয়। তরুণ প্রজন্মের জন্যও তিনি অনুকরণীয় এক মহান পুরুষ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও এ অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তার জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও জনগণের সার্বিক কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79012 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1