শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে কতটা সাংঘর্ষিক?

রাষ্ট্রের একক সার্বভৌম ক্ষমতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দল ও সংস্থার সমর্থনে প্রচারিত মতবাদকে সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদ বলা হয়। বহুত্ববাদের মূলকথা হলো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বহুবিধ সংঘ ও সংস্থাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্মলাভ করে এবং মানুষের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণ করে। তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের এমন এক ক্ষমতাকে বোঝায় যার ঊর্ধ্বে আর কোনো ক্ষমতা নেই। উইলোবির মতে 'রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই সার্বভৌমত্ব।' সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের চূড়ান্ত, স্থায়ী, অবিভাজ্য, অহস্তান্তরযোগ্য এবং সার্বজনীন ক্ষমতা। এ ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দান করে এবং প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারা আনুগত্য আদায় করে। মধ্যযুগে সার্বভৌমত্বের ধারণা সৃষ্টি হয় এবং আধুনিকযুগে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়। প্রকৃত সার্বভৌমত্ব, নামমাত্র সার্বভৌমত্ব, বাস্তব সার্বভৌমত্ব, আইনানুমোদিত সার্বভৌমত্ব, আইনগত সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব এগুলো সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন বাস্তবমুখী প্রকাশ। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্ব কথাটি সবার কাছে পরিচিত। জনগণই শাসক নির্বাচন করে, শাসক পরিবর্তন করে এবং প্রয়োজনে উৎখাত করে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যেহেতু জনগণের শাসন সেহেতু রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং জনগণের কাছে শাসকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

সার্বভৌমত্বের ধারণা মধ্যযুগে আত্মপ্রকাশ করে এবং আধুনিক যুগের শুরুতে পরিপূর্ণতা অর্জন করে। মধ্যযুগে ইউরোপে রাজা ও পোপের লড়াইয়ে রাজা জয়ী হলে বণিকরা তাদের ব্যবসায়ের নিরাপত্তার জন্য রাজার প্রতি আনুগত্য দিতে শুরু করে, ফলে রাজার শক্তি বৃদ্ধি হয়। নবজাগরণের ফলে সাম্রাজ্যের পরিবর্তে রাজাদের কর্তৃত্বে বেশ কয়েকটি জাতীয় রাষ্ট্রের সূচনা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে টিউডর রাজবংশ, স্পেনে পঞ্চম চার্লস এবং ফ্রান্সে চতুর্দশ লুইয়ের কর্তৃত্বাধীনে চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এ সময়ে রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে। তবে ওই সময়ে সার্বভৌমত্ব বলতে শাসক বা রাজার চরম ক্ষমতাকে মনে করা হতো। পরে লক ও রুশোর লেখনীতে যথা- মে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ও গণসার্বভৌমত্বের ধারণা বিকশিত হয়। আধুনিককালে সার্বভৌমত্ব আর রাজার বা কোনো ব্যক্তির অসীম ক্ষমতা নয়, বরং এটি জনগণের চরম ক্ষমতা যা রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে থেকে সরকারের মাধ্যমে প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়।

সমাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী, সংগঠন ও কার্যকলাপের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে নিজ সামাজিক প্রকৃতি প্রকাশ করে। সমাজ বিভিন্ন সংঘের যৌথ প্রকাশ। মানুষের জীবনের বহুবিধ চাহিদা পূরণের জন্য সমাজে বিভিন্ন প্রকার সংঘ গড়ে ওঠে। প্রত্যেক সংঘের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক সংঘ। তার উদ্দেশ্যও আইনগত এবং রাজনৈতিক। একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যেই নাগরিকের সামাজিক সত্তা বিকশিত করা সম্ভব নয়। একাত্মবাদের প্রবক্তারা রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে কোনো প্রকার সীমারেখা না টেনে উভয়কেই অভিন্ন রূপে চিহ্নিত করেছেন। বহুত্ববাদীরা এই মতের বিরোধিতা করেন। তাদের মতে সমাজ সংঘমূলক। লাস্কি উলেস্নখ করেছেন, 'কোনো সমাজের চরিত্র যথার্থভাবে অনুধাবনের জন্য যে বিষয়টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তা হলো সমাজের চরিত্র মূলত যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং সংঘমূলক'। বিভিন্ন সামাজিক সংঘ বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্য সাধন করে এবং তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তুলনায় কম সার্বভৌম নয়। সামাজিক মানুষ কেবল রাষ্ট্রের প্রতিই আনুগত্য প্রকাশ করে না; তারা অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের প্রতিও সমভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে। সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্র বল প্রয়োগের অধিকারী হলেও এই ক্ষমতা কোনোক্রমেই তাকে অসাধারণত্ব দান করে না। অন্যান্য সংঘ যেমন- নিজ নিজ ক্ষেত্রে সার্বভৌম, রাষ্ট্র ঠিক তেমনি নিজ ক্ষেত্রে সার্বভৌম। সুতরাং অন্যান্য সংঘের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের কোনো ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। বহুত্ববাদীরা সার্বভৌমত্বের অবিভাজ্যতার তত্ত্ব অস্বীকার করেন। তারা রাষ্ট্রকে চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীরূপে গণ্য করেন না। গিয়ার্কে, ম্যাকল্যান্ড, ফিগিজ সামাজিক সংগঠনের নিজস্ব সত্তা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বহুত্ববাদীরা আরও উলেস্নখ করেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কোনো প্রকারেই অসীম ও অবাধ নয়। প্রত্যেক সংগঠনের ক্ষমতা তার কাজের দ্বারা সীমিত। সামাজিক সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাও তার কাজের এখতিয়ার দ্বারা সীমিত। রাষ্ট্র মানুষের বাহ্যিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বার্কারের মতে এমন অনেক কাজ আছে যা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই কাজের ক্ষেত্র হলো সুন্দর জীবনের কামনায় মানুষের মানসিক প্রয়াস। এই প্রয়াস কেবল কোনো বিশেষ ব্যক্তির বিবেচ্য বিষয় নয়, সমবেতভাবে সমাজবদ্ধ সব ব্যক্তি আলোচ্য বিষয়। সুন্দর জীবনের জন্য মানসিক প্রয়াস একদিকে সামাজিক, অন্যদিকে ব্যক্তিগত। তার জন্য প্রয়োজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সামাজিক সহযোগিতা। তিনি আরও মনে করেন, কেবল মানসিক বা অভ্যন্তরীণ জীবনের ক্ষেত্রেই নয়- বরং মানুষের বাহ্যিক জীবনের ক্ষেত্রেও এই সহযোগিতা প্রয়োজন।

আরও অনেক সমাজতত্ত্ববিদ ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ সামাজিক সংগঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা খর্বের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। এমিল ডুর্কহাইম অভিমত প্রকাশ করেছেন, মানুষের অর্থনৈতিক জীবন জটিল আকার ধারণ করার ফলে রাষ্ট্রের পক্ষে অর্থনৈতিক জীবনের সব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব নয়। তার মতে, বিভিন্ন পেশাদারিগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেওয়া উচিত। তা ছাড়া কোল, হসবন প্রমুখ সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তারাও রাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস এবং সংঘের হাতে ক্ষমতা অর্পণের দাবি করেছেন। একাত্মবাদের বিরুদ্ধে বহুত্ববাদীদের এই আক্রমণের মূল কারণ হলো, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন অর্থনৈতিকগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। এই প্রয়াস ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত। সেই জন্যই বহুত্ববাদের প্রবক্তারা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংগঠনের দাবি তুলেছেন। কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বহুবিধ ব্যাপারে অন্য রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভরশীল থাকতে হয়। প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার এবং বিরোধের পরিবর্তে বন্ধুত্ব আধুনিক জগতের মর্ম বস্তুতেই পরিণত হয়েছে। লাস্কি মনে করেন, পৃথিবী এত বেশি পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে, কোনো একটি রাষ্ট্রের অবাধ ইচ্ছা মানবজাতির পক্ষে মারাত্মক হুমকি হতে পারে। তার মতে, রোমান আইন যেমন বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাও তেমনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। আনবিক মারণাস্ত্রের প্রসার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে সীমিত করার প্রয়োজনীয়তা নতুনভাবে উপস্থাপিত করেছেন। আনবিক মারণাস্ত্রের অধিকারী কোনো রাষ্ট্রের হঠকারী উদ্যোগ সমগ্র মানবসভ্যতাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। বর্তমানে সমগ্র মানবজাতির সম্মুখে দুটি বিকল্প পথ আছে- সামগ্রিকভাবে মানবজাতির অস্তিত্ব বজায় রাখা অথবা বিনাশপ্রাপ্তির পথ ত্বরান্বিত করা। মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সংকোচন আবশ্যক।

মার্কসীয় দর্শনের প্রবক্তারা সম্পূর্ণ নতুন এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বভৌমিকতার চরিত্র প্রয়োগের পদ্ধতি আলোচনা করেন। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র একটি শ্রেণি শাসনের যন্ত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী এবং উৎপাদনের উপকরণের নিয়ন্ত্রণকারী শ্রেণি। নিজের শ্রেণি স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে। সুতরাং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা সার্বভৌমিকতা কীভাবে প্রয়োগ করা হবে বা তার চরিত্র কী হবে তা নির্ভর করে সমাজে অর্থনৈতিক শক্তি বিন্যাসের ওপর অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের ওপর। সার্বভৈৗমত্ব বা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র অনুধাবন করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রের মাধ্যমেই সার্বভৌমত্বকে অনুধাবন ও উপস্থিত করা সম্ভব। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রত্যেক শোষিত সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা উৎপাদনের উপকরণের মালিকদের অর্থাৎ অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রাধান্য বিস্তারকারী শ্রেণি রক্ষক হিসেবে কাজ করে। শোষিত সমাজে রাষ্ট্র ক্ষমতা কখনোই শ্রেণি নিরপেক্ষ নয়। সার্বভৌমিকতাকে যদি রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রকাশ বলে অভিহিত করা যায়, তাহলে সার্বভৌমিকতাও কোনো অবস্থায়ই শ্রেণি নিরপেক্ষ হতে পারে না। শোষিত সমাজের ইতিহাস থেকেই তার যথার্থতা প্রমাণ করা সম্ভব।

বুর্জোয়া বিপস্নবের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বুর্জোয়াব্যবস্থা ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা বজায় রাখে। সেই কারণেই বুর্জোয়া সমাজে জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব, সার্বজনীন ভোটাধিকার, জনসাধারণের কল্যাণে পরিচালনা ইত্যাদি আদর্শের কথা ঘোষিত হলেও বুর্জোয়া রাষ্ট্র বুর্জোয়া শ্রেণি স্বার্থের পরিচালকরূপে কাজ করে থাকে। বুর্জোয়া শ্রেণি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে যাতে শোষিত মানুষ প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারে। বুর্জোয়াব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে যে সীমিত অধিকার জনসাধারণকে দেওয়া হয় তার মাধ্যমে যদি শোষকশ্রেণির স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা যায়। বুর্জোয়া শ্রেণি সেই অধিকারকেও পদদলিত করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সর্বপ্রথম জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের মাধ্যমেই সর্বহারা শ্রেণি মুষ্টিমেয় শোষকের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভুত্বের অবসান ঘটিয়ে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। সমাজতান্ত্রিক বিপস্নব গুণগত দিক থেকে এক নতুন ধরনের বিপস্নব। তার প্রধান লক্ষ্য হলো, ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে উৎপাদনের উপকরণের সামাজিকীকরণ, শ্রেণি শোষণের অবসান ঘটানো, শোষণের হাতিয়ার হিসেবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ভূমিকার অবসান ঘটানো এবং সংখ্যাগুরু মানুষের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ন্যস্ত করা। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানায়ই শোষণের উৎস এবং শোষিত সমাজে রাষ্ট্র ক্ষমতা শোষণের স্বার্থে কাজ করে। তাই পূর্বতন সব শোষিত সমাজে রাষ্ট্র শোষক শ্রেণির শোষণের যন্ত্রে পরিণত হওয়ার ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতাও মুষ্টিমেয় শোষকের রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিণত হয়েছিল।

রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বাস্তব ও নীতিগত কারণে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র একটি অবশ্যম্ভাবী সংগঠন হলেও নৈতিক দিক দিয়ে তার কোনো স্বীকৃতি নেই। লাস্কির মতে, রাষ্ট্র নাগরিক জীবনের পরিস্ফুটন ও প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম। সেই সম্ভাবনাকে রাষ্ট্রকে কীভাবে বিকশিত করতে পারে তার উপরে তার ক্ষমতা ও আনুগত্যের দাবি নির্ভরশীল। তিনি এই মত পোষণ করেন যে, ক্ষমতার ওপর রাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী দাবি থাকতে পারে না। সরকার চূড়ান্তভাবে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে, যাদের ওপর তার কাজের ফলাফল প্রতিফলিত হয়ে থাকে। ইতিহাস এই শিক্ষাই দেয় চূড়ান্তভাবে অবাধ ক্ষমতার প্রয়োগ শাসিতের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।

বহুত্ববাদের দুর্বলতা তার প্রভাব হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও বহুত্ববাদী দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আঙিনা থেকে নির্বাসিত হয়নি। আর্থার বেন্টলে, ডেভিড ট্রম্যান প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা গোষ্ঠীগত দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে রাষ্ট্র বিজ্ঞান পর্যালোচনার চেষ্টা করেছেন। রবার্ট ডাল, লিপসেট, রিচার্ড হফ্‌স্টার্ডটার প্রমুখ মার্কিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা উদার ও নৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোতে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংঘের প্রয়োজনীয়তার কথা উলেস্নখ করেছেন। অনেকের মতে পুঁজিবাদী দেশে পরস্পরবিরোধী সামাজিক শ্রেণির অবস্থানের জন্য এবং পুঁজিপতিদের অন্তঃবিরোধের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক সংঘ ও গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন সামাজিক সংঘ গড়ে উঠলেও তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের বন্ধন বিদ্যমান। সমাজতান্ত্রিক দেশে পরস্পরবিরোধী শ্রেণির অনুপস্থিতির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক সংঘ গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। আধুনিক জগতে সামাজিক সংঘের প্রয়োজনীয়তা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। কিন্তু বহুত্ববাদী দাবি অনুযায়ী কোথাও তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের অথবা রাষ্ট্রের সমতুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয় আইনের সীমানার মধ্যে তারা দায়িত্ব পালন করে থাকে। রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক সংঘ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। রাষ্ট্র তাদের অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক।

রাষ্ট্রের একক সার্বভৌম ক্ষমতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দল ও সংস্থার সমর্থনে প্রচারিত মতবাদকে সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদ বলা হয়। বহুত্ববাদের মূলকথা হলো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বহুবিধ সংঘ ও সংস্থাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্মলাভ করে এবং মানুষের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণ করে। তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।

এসব কাজ করতে গিয়ে তারা সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে। সুতরাং রাষ্ট্রের হাতে সার্বভৌমত্ব একচেটিয়াভাবে অবস্থান করে সেকথা ঠিক নয়। বহুত্ববাদীদের মতে সমাজের সংঘ ও সংস্থাগুলো সার্বভৌম। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক এবং তা প্রয়োগ করে সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং সার্বভৌম ক্ষমতা সব সংঘ ও সংস্থার মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। লিন্ডসে, বার্কার, লাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা বহুত্ববাদের সমর্থক। অন্যদিকে বহুত্ববাদীদের মতবাদের ফলেই ব্যক্তির অধিকার এবং বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের বিকাশের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। রাষ্ট্রের একচেটিয়া ও অসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রচারিত বহুত্ববাদী মতবাদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহাবস্থানের নীতিকে জোরদার করেছে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<78416 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1