যখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে অশান্তি, সংঘাত আর বিদ্বেষের বাষ্প, ঠিক তখনই আমরা পারি পৃথিবীতে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়ে এক স্বগীর্য় পরিবেশ তৈরি করতে। সামাজিক বন্ধন যেখানে প্রায় ভঙ্গুর, সেখানেই হোক আমাদের ভঙ্গুরতাকে ভালোবাসায় জুড়ে দিবার এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। আপনার এক একটি ভালো কাজ এবং এক একটি মহৎ উদ্দ্যোগ পারে একটি সমাজের কল্যাণ সাধনে কাজ করে যেতে। এরূপ একটি কল্যাণকর কাজ হলো ‘রক্তদান’। আমরা জানি, ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। রক্তদান এমনই একটি প্রক্রিয়া, যেখানে অথর্ ছাড়াই শারীরিকভাবে সুস্থ একজন পূণর্ বয়স্ক ব্যক্তি পারেন পরম সুখের অধিকারী হতে। তবে এ জন্য প্রয়োজন হবে, তার স্বইচ্ছা। ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তজাির্তকভাবে সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ১৪-ই জুন ‘রক্তদাতা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই দিবসটি উৎসগর্ করা হয় সেই সব বীরদের উদ্দেশ্যে যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে তাদের রক্তদান করে থাকেন। ১৪ জুন দিবসটি পালনের আরেকটি তাৎপযর্ রয়েছে। এদিনে জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞানী কালর্ ল্যান্ডস্টিনার। এই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন রক্তের গ্রæপ: এ, বি, ও, এবং এবি।
পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান করা হয়। অথচ এর ৩৮% সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশ থেকে, যেখানে বসবাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২% মানুষ। আবার অনেক দেশে পেশাদারী রক্তদাতা খুঁজে পাওয়া যায়, যারা অথের্র বিনিময়ে রক্ত বিক্রি করে থাকে। তবে এদের সংখ্যাটা খুবই অল্প।
হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য পরিমাণ মানুষের রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে কিন্তু তারা রক্তের অভাবে তাদের চিকিৎসা বা অপারেশন করাতে পারছেন না। হয়তো যারা ধনী তারা অন্যত্র থেকে অথের্র বিনিময়ে কিনতে পারছেন কিন্তু যারা গরিব তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, আর আপনার আমার মতো মানুষের দিকে চেয়ে আছেন। তবে আশার বিষয় হলো, রক্তদানে সহায়তা করে এরূপ মানুষের জীবন বঁাচাতে এগিয়ে আসছে অসংখ্য সামাজিক সংগঠন। যেমন: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাজ করে যাচ্ছে ‘বঁাধন’, এ ছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে কাজ করছে ‘সন্ধানী’ সংগঠনটি। আপনারাও পারেন আপনার এলাকাতে এরূপ স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলতে। যা থেকে আপনি এবং আপনার এলাকাবাসী পেতে পারে বিবিধ উপকারসহ একটি ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধন। আসুন আমরা একের রক্তে অন্যের জীবন বঁাচাতে এগিয়ে আসি। এভাবেই আমরা পারি স্বীকৃতি দিতে ভূপেন হাজারির সেই বিখ্যাত গানটির :-
‘মানুষ মানুষের জন্য
জীবন জীবনের জন্য’
আপনি কি জানেন আপনার রক্তদানের মাধ্যমে সমাজেরসহ আপনার নিজেরও উপকার করছেন? আসুন জেনে নিই রক্তদানের উপকারিতা:-
* মানসিক তৃপ্তি: আমি একজনের জীবন বঁাচাতে সাহায্য করেছি, আমি অবশ্যই একটি ভালো কাজ করেছি।
* বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষার রিপোটর্: এইচ আইভি, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস-বি ও সি, সিফিলিস ইত্যাদি রোগের রিপোটর্।
* গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তদানের ফলে লোহিত রক্ত কনিকা তৈরির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, হাড়ের অস্থিমজ্জার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
* রক্তদানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শ্বেত কনিকা এবং ৪ মাসের মধ্যে লোহিত কনিকা পূরণ হয়ে যায়।
রক্তদানকারীর নিম্নোক্ত যোগ্যতা থাকতে হবে:-
*বয়স : ১৮-৫৭
* ওজন : পুরুষ-৪৭, নারী-৪৫ কেজি।
* রক্তচাপ (১৫০/১০০-১০০/৫০) স্বাভাবিক হতে হবে।
* মোটকথা, শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।
* রক্তদাতা প্রতি চার মাস অন্তর রক্ত দিতে পারবে।
রক্তদানের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবেন:-
* জ্বর : ভাইরাস জ্বর সুস্থ হওয়ার ৭ দিন পর।
* ডেঙ্গু : সুস্থ হওয়ার কমপক্ষে ৬ মাস পর।
* ম্যালেরিয়া: সুস্থ হওয়ার ১ বছর পর।
* টাইফয়েড, বসন্ত : সুস্থ হওয়ার ৬ মাস পর।
* রক্তস্বল্পতা, মৃগীরোগ, একজিমা : দেয়া যাবে না।
* নারীদের ক্ষেত্রে: অন্তঃসত্ত¡¡া ও মাসিক চলাকালীন দেয়া যাবে না।
কখনোই রক্ত দিতে পারবে না:-
* এইচআইভি পজেটিভ।
* সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক নিলে।
* ক্যান্সার।
* হৃদরোগ।
* বাতজ্বর।
* সিফিলিস (যৌনরোগ)।
* কুষ বা শ্বেতী ও
* যে কোন রক্তবাহিত রোগ।
মনে রাখতে হবে:-
* খালি পেটে রক্ত দেয়া যাবে না।
* রক্তদানের পূবের্ ও পরে পানি পান করতে হবে।
* রক্তদানের পর ২০-৩০ মিনিট বিশ্রাম নিন।
* রক্তদানের পর ১ ঘণ্টার মধ্যে ভারী খাবার না খাওয়া।
রক্তদান পৃথিবীর পুণ্য কাজগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম। আমার শরীরের ৫০০ মি.লি. রক্তে আরেকটি জীবন রক্ষা হচ্ছে। পৃথিবীর আলো, বাতাস উপভোগের অপার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। মোট কথা, আপনি জীবনে জীবন সরবরাহ করছেন। এর থেকে বড় কমর্ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। কত বিরাট পাওয়া, কত বিশাল অজর্ন। পরোপকারই হোক আমাদের জীবনের ব্রত। ‘একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বঁাধন।’