শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আততায়ী আগস্ট: এখনো উদ্ধ্যত ঘাতক বুলেট

বাঙালি আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেÑ এক দলে আছে লাঠিয়াল বাঙালি, আরেক দলে লড়াকু বাঙালি। লাঠিয়ালরা দেশি-বিদেশি প্রভুদের পদলেহী ও প্রভুদের হুকুম পালনে সদাব্যস্ত। নিভীর্ক, সত্যসন্ধ্যানী লড়াকু বাঙালিরাই আজ স্বাধীন বাংলার একমাত্র ভরসা। ঘাতকের উদ্ধ্যত বুলেট যতই প্রাণঘাতী হোক, ঘরের ছাদ, সিঁড়িঘর, পবিত্র মাটি, যতই স্নাত হোক না কেন পিতার বুকের রক্তিম শিশিরেÑ আলোকাভিসারী লড়াকু বাঙালি সূযির্করণ পান করে হবে সূযর্সন্তান।
সৈয়দ জাহিদ হাসান
  ১৪ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

বাঙালি লড়াকু জাতি। সত্যিকার অথের্ লড়াকু না হলেও নিজের নামের সঙ্গে লড়াকু যুক্ত করে বাঙালি এখন সবর্ত্র লড়াকু জাতি বলেই পরিচিত। একটি লড়াকু জাতির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যেমনÑ (ক) তারা স্বাধীনচেতা হয়, (খ) বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ বা সহ্য করে না, (গ) স্বদেশের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, (ঘ) অন্যায়-দুনীির্ত ও পীড়নের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ইত্যাদি। বাঙালির রক্তে স্বাধীনচেতনা নেই, বাঙালি বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ করে এবং বিশ্বাসঘাতকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতেও ভালোবাসে। বাঙালি কোনো কালেই দেশপ্রেমিক ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না, কেননা বাঙালির নিজস্ব ভ‚মি থাকলেও তার কোনো স্বাধীন দেশ ছিল না, স্বাধীন দেশের ধারণা বাঙালির কাছে অতীতে অস্পষ্ট ছিল, বতর্মানেও অনেকটা তাই। বাঙালির চরিত্রে অন্যায়কে, দুনীির্তকে, পীড়নকে প্রশ্রয় দেয়ার একটা ঐতিহাসিক প্রবণতা আছে। সুতরাং যুক্তির আলো ফেলে বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায় বাঙালি লড়াকু নয়, বাঙালি মূলত লাঠিয়াল। লাঠিয়াল আর লড়াকুÑ এ দুটি শব্দ কখনো এক অথর্ বহন করে না। ‘বল’ আর ‘বেল’-এর মধ্যে যে পাথর্ক্য ‘লাঠিয়াল’ আর ‘লড়াকু’র মধ্যে ঠিক ততখানিই ব্যবধান।

পরাধীনতাই ছিল বাঙালির আজন্মের অধিকার। অতীত ইতিহাস অন্তত এমনটাই সাক্ষ্য দেয়। বাঙালি কখনো বুক ফুলিয়ে স্বীয় স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে বলে তেমন কোনো প্রমাণ নেইÑ একটি-দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির প্রথম স্বপ্ন জাগানিয়া সন্তান। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসজর্ন দিয়ে অন্যকে সুখী করার অভ্যাস ছোটবেলায়ই রপ্ত করেছিলেন তিনি। শৈশবেই তার চরিত্রে সমাবেশ ঘটেছিল স্বাধীনচিন্তা, দেশপ্রেম, অন্যায় ও পীড়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদের সাহস। চির ন্যুব্জ বাঙালির ঘরে শেখ মুজিবই একমাত্র বাঙালি সন্তানÑ যিনি ব্যক্তিগত অনমনীয় মনোবল, সীমাহীন ত্যাগ, দেশপ্রেমের আবেগ, সমষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। তার অপূবর্ আবেগ ও আচরণ প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতিকে লাঠিয়াল থেকে লড়াকু করেছিল। শেখ মুুজিব শুধু স্বাধীন বাংলাদেশেরই স্থপতি নন, তিনিই নতমুখী বাঙালিকে ঊধ্বর্মুখী করার প্রথম প্রেরণা।

শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকে প্রথমে লন্ডন, পরে দিল্লি এবং অবশেষে স্বাধীন বাংলার মাটিতে এসে ভাষণ দেন ঐতিহাসিক রেসকোসর্ ময়দানে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে।’ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যে বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু ‘মানুষ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সেই বাঙালি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রমাণ করে দিয়েছে তারা ‘মানুষ’ নয়, তারা ‘বিশ্বাসঘাতক-হন্তারক’। বিশ্বাসঘাতকতা যাদের রক্তের প্রতিটি কণিকায় বহমান, প্রতারণা আর স্বাথর্পরতা যাদের মজ্জাগত ব্যাধি, সেই ব্যাধিগ্রস্ত বাঙালিকে শেখ মুজিব পরিপূণর্ভাবে সুস্থতা দান করতে পারেননি। শেখ মুজিবের ক্ষমাপরায়ণ দৃষ্টি বাঙালির মসৃণ চামড়া দেখতে পেলেও চামড়ার নিচের বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষতকে দেখতে পায়নি। বাঙালির মুখের কথাকে মনের কথা ভেবে তিনি শুধু ভুলই করলেন নাÑ সপরিবারে শহিদ হয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা উপহার দেয়ার মমাির্ন্তক মাসুল দিয়ে গেলেন। নিজের বুকের রক্ত দিয়ে লিখে গেলেন এমন এক অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্য গল্প পৃথিবীর ইতিহাসে যার সমতুল্য আর কিছু নেই।

শেখ মুজিবের মৃত্যুর পরে স্বাধীন বাংলা আবার চলে যায় ঘাতকদের দখলে। চারদিকে আজ ঘাতকরা সক্রিয়। আজ বাংলার উপাসনালয় ঘাতকের দখলে, শিক্ষাঙ্গন ঘাতকের দখলে, রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেখছি ঘাতকের হষর্ধ্বনি। ঘাতকরাই আজ শক্তিশালী বাংলার জমিনে। চতুদিের্ক ষড়যন্ত্রের জটিল জাল বিস্তার করে বাংলা ও বাঙালিকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছে ঘাতকরা। এত ঘাতক, এত প্রতারক, এত ষড়যন্ত্রকারী কীভাবে জন্ম নিল বাংলার পবিত্র মাটিতে? যে মাটিতে সোনা ফলেÑ সেই মাটিতে কী করে এত শয়তান উৎপাদন হলো? যে দেশের বাতাসে বাতাসে ওড়ে মন্ত্রপূত মধুরেণু, সে দেশের বাতাসে শঁাই শঁাই শব্দে কীভাবে আজ উড়ে চলে ঘাতক-বুলেট? আমরা একটি শান্তির স্বগর্ চেয়েছিলাম। নিবির্ঘœ জীবন প্রত্যাশা করে উৎসগর্ করেছিলাম স্বজনের উষ্ণ রুধির। অথচ আমরা স্বগর্ সুখের বদলে আজ কেবল শাস্তিই পাচ্ছি, পবিত্র রক্তের বদলে পাচ্ছি ষড়যন্ত্রের ফঁাস। তাহলে কি কোনোই ভবিষ্যৎ নেই আমাদের? আমাদের যাত্রা পথের শেষ বিন্দুতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে শুধুই অন্ধকার, গøানি আর বধ্যভ‚মির নৃশংসতা?

বাঙালি আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেÑ এক দলে আছে লাঠিয়াল বাঙালি, আরেক দলে লড়াকু বাঙালি। লাঠিয়ালরা দেশি-বিদেশি প্রভুদের পদলেহী ও প্রভুদের হুকুম পালনে সদাব্যস্ত। নিভীর্ক, সত্যসন্ধ্যানী লড়াকু বাঙালিরাই আজ স্বাধীন বাংলার একমাত্র ভরসা। ঘাতকের উদ্ধ্যত বুলেট যতই প্রাণঘাতী হোক, ঘরের ছাদ, সিঁড়িঘর, পবিত্র মাটি, যতই স্নাত হোক না কেন পিতার বুকের রক্তিম শিশিরেÑ আলোকাভিসারী লড়াকু বাঙালি সূযির্করণ পান করে হবে সূযর্সন্তান। পিতলের বুলেট বড় জোর পিতাকে হত্যা করতে পারে, কিন্তু পিতার আদশের্ক হত্যা করতে পারে না।

সৈয়দ জাহিদ হাসান: শিক্ষক ও কলাম লেখক

ংুবফলধযরফযধংধহ২৯@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<7829 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1