বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবদান

৩ ডিসেম্বর অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রথম অপারেশন চালানো হয়। হেলিকপ্টারটির পাইলট ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। সঙ্গে ছিলেন মেশিনগান চালানোর মতো একজন গানার। সাহসী বৈমানিকদ্বয় ওইদিন রাতে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে তেল ডিপোতে রকেট হামলা করে তেল ডিপো জ্বালিয়ে দেন।
নূর ইসলাম হাবিব
  ২১ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি বৈমানিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত ও উদ্দীপ্ত করে। যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙালি বৈমানিকরা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেকে পালিয়ে আসার সময় পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম মতিউর রহমান পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের চেষ্টাকালে উক্ত বিমান দুর্ঘটনায় শাহাদত বরণ করেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বাঙালি বৈমানিকরাও পালিয়ে ভারতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ১৯৭১ সালের মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের মদুনাঘাট এলাকায় বৈদু্যতিক সাব-স্টেশন ধ্বংস ও চট্টগ্রাম এলাকার বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে তার একক কৃতিত্ব রয়েছে। তা ছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ইউনিট কিলো ফ্লাইটের প্রথম অধিনায়ক।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম মতিউর রহমান ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দুই মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে আসেন। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলেন এবং বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। তিনি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন এবং বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সদস্য হয়েও তিনি গভীর দেশপ্রেম বোধ থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম মতিউর রহমান ৯ মে সপরিবারের পাকিস্তানের করাচি চলে যান এবং একটি বিমান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি পাইলট রাশেদ মিনহাজ একটি বিমান নিয়ে একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময়ে রানওয়েতে ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্বরত মতিউর রহমান তার ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। এসময়ে রাশেদ মিনহাজ বিমানের ক্যানোপি খুলে বিমান থামানের কারণ জিজ্ঞাসা করে। এসময়ে মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে বিমানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তবে মিনহাজ অচেতন হওয়ার আগেই কন্ট্রোল টাওয়ারে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হন, বিমানটি তিনিসহ ছিনতাই হয়েছে। এই বার্তা পাওয়ার পর চারটি যুদ্ধবিমান ছিনতাইকৃত বিমানটিকে ধাওয়া করে। একসময় পাকিস্তানি পাইলট মিনহাজ চেতনা ফিরে পায় এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য মতিউরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে। এ সময় বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয় এবং মতিউর রহমান শাহাদত বরণ করেন। এ ঘটনায় মিনহাজও নিহত হয়। দিনটি ছিল ২০ আগস্ট ১৯৭১। মতিউর রহমানের অসীম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। পাকিস্তানে তাকে চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল এবং মাশরুর বিমানঘাঁটির গেটে মতিউরের ছবি টাঙিয়ে তাতে লিখে রেখেছিল গাদ্দার শব্দটি।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম পাকিস্তানি বিমানবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দি অবস্থায় তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এ জন্য তাকে বীর-উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।

ঢাকা থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান গ্রম্নপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ রেজা (অব.), ইউং কমান্ডার শামসুর রহমান মির্জা (অব.), ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম এবং স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। তারা এভাবে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক, স্কোয়াড্রন লিডার হাবিবুর রহমান এবং ফ্লাইং অফিসার জিএইচ মির্জা পালাতে গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ডিমাপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ইউনিট কিলো ফ্লাইট গঠনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। ভারতের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া তিনটি এয়ার ক্রাফট নিয়ে গঠিত হয় কিলো ফ্লাইট। এগুলো হলো- অ্যালুয়েট-ওওও হেলিকপ্টার, অটার ডিএইচসি-৩ এবং সিসি-৩ ডাকোটা বিমান। এগুলো ছিল সম্পূর্ণই নন-কমব্যাট এয়ার ক্রাফট। অ্যালুয়েট-ওওও হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন- স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ (পিআইএ পাইলট), এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। ডিএইচসি-৩ অটার বিমানের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (পিআইএ পাইলট) এবং ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ (বেসরকারি কোম্পনির পাইলট)। ডিসি-৩ ডাকোটা বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক (পিআইএ পাইলট), ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত (পিআইএ পাইলট) এবং ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার (পিআইএ পাইলট)।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর টেকনিশিয়ানরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে তিনটি নন-কমব্যাট এয়ার ক্রাফটকে যুদ্ধ উপযোগী বিমানে রূপান্তর করেন। এ কাজে সাহায্য করেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর গ্রম্নপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। 'কিলো ফ্লাইটের' অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে। কিলো ফ্লাইটে অফিসারের সংখ্যা ছিল ৯ জন এবং বিমান সেনার সংখ্যা ছিল ৩৮ জন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গ্রম্নপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক, ঊইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার ৬নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুলস্নাহ খান ১১নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

৩ ডিসেম্বর অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রথম অপারেশন চালানো হয়। হেলিকপ্টারটির পাইলট ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। সঙ্গে ছিলেন মেশিনগান চালানোর মতো একজন গানার। সাহসী বৈমানিকদ্বয় ওইদিন রাতে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে তেল ডিপোতে রকেট হামলা করে তেল ডিপো জ্বালিয়ে দেন।

৩ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বোমা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ অটার বিমান দিয়ে এ হামলা চালান রাত ১১টা ৪০ মিনিটে উড্ডয়ন করে রাত ১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের লক্ষবস্তুুর কাছে পৌঁছান। তারা এসময় ১৪টি রকেট ফায়ার করে তেল ডিপোতে আগুন ধরিয়ে দেন। সব অভিযান শেষে তারা ভোর রাত ৩টা ১০ মিনিটে শিলচরে ফিরে আসেন।

নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের দুটি অভিযানই ছিল দুঃসাহসী এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাডার ফাঁকি দিয়ে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে নন-কমব্যাট বিমান দিয়ে এরকম সফল হামলা ছিল অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। কিলো ফ্লাইটের সদস্যরা এর ধারাবাহিকতায় সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকায় অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করে। ডাকোটা বিমানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান সেনাপতির যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনটি বিমানের প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষাল এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কে সি সিংলা।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ১ হাজার ১৩১ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য একজন বীর-শ্রেষ্ঠ, ৬ জন বীর-উত্তম, একজন বীর-বিক্রম এবং ১৫ জন বীর-প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন (মোট ২৩ জন)। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ৬ জন অফিসারসহ মোট ৫০ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও গ্রম্নপ ক্যাপ্টেন (অব.) শামসুল আলমকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১১ সালে এয়ার ভাইস মার্শাল ( অব. ) এ কে খন্দকারকে এবং স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলমকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে যুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকার জন্য এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সুলতান মাহমুদকেও স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

কিলো ফ্লাইটের অন্যতম বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ বলেন, নতুন প্রজন্মের তরুণদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। তিনি বলেন, 'আমরা যুদ্ধ করেছি গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। তরুণদের স্বাধীনতার এই আদর্শ অনুসরণ করে শোষণমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে।

নূর ইসলাম হাবিব: সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76359 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1