মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রসঙ্গ পেঁয়াজ: কৃষকের দেশে কৃষিপণ্য কেন আমদানি করতে হবে?

এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, ভারতে বছরে দুইবার পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। একবার শীতকালে আর একবার গ্রীষ্মকালে। বাংলাদেশে শীতকালেই অধিকাংশ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে তেমন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় না বললেই চলে। যদিও গ্রীষ্মকালে চাষ করার মতো উন্নতজাতের বারি পেঁয়াজ-২ ও বারি পেঁয়াজ-৫ নামের দুটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে মসলা গবেষণা কেন্দ্র। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। আমি মনে করি, পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেদিকেই বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত। যে করেই হোক সরকারকে দ্রম্নত বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে সবার আগে অসৎ ও অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো জরুরি।
আর কে চৌধুরী
  ১০ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
প্রসঙ্গ পেঁয়াজ: কৃষকের দেশে কৃষিপণ্য কেন আমদানি করতে হবে?
প্রসঙ্গ পেঁয়াজ: কৃষকের দেশে কৃষিপণ্য কেন আমদানি করতে হবে?

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোসহ অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আটঘাট বেঁধে একেবারে মাঠে নেমে পড়েছেন পেঁয়াজের দেশীয় আড়তদার, আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। একে রীতিমতো বস্ন্যাকমেল তথা জনসাধারণকে প্রায় জিম্মি করে ব্যবসা করা ছাড়া আর কি বলা যায়? অথচ প্রায় প্রতিদিনই দেশে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত দিয়ে স্থল ও নৌপথে দেশে ঢুকছে শত শত টন পেঁয়াজ। এমনকি মিসর থেকেও পেঁয়াজ আসার খবর আছে। পেঁয়াজের অভ্যন্তরীণ মজুদও সন্তোষজনক।

সরকার নিজেই বলেছে, দেশে প্রায় তিন লাখ টন পেঁয়াজ মজুদ আছে- যা দিয়ে আগামী ৫০-৫৫ দিন চলার কথা। অথচ পেঁয়াজের দাম একলাফে বেড়ে ৮০ থেকে রাতারাতি হয়েছিল ১৩০ টাকা প্রতি কেজি। যদিও বর্তমানে দাম কমে প্রতি কেজি ৮০ টাকা হয়েছে। এমতাবস্থায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিরূপণসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি দেশেই বাড়াতে হবে আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাসহ পেঁয়াজের চাষাবাদ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রমসহ এগিয়ে আসতে পারে।

দেশে প্রতি মাসে পেঁয়াজের গড় চাহিদা এক লাখ ২০ হাজার টন। শীত মৌসুমে চাহিদা কিছু বেশি থাকে। রমজান ও কোরবানিতে পেঁয়াজের চাহিদা সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় আরও দেড়-দুই লাখ টন। এর ৬০ শতাংশ মেটানো যায় স্থানীয় উৎপাদন থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ পেঁয়াজের চাহিদা মেটানো হয় প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করে। দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা কম-বেশি ২৪ লাখ টন। উৎপন্ন হয় ১৮ লাখ টন। অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে হয় প্রধানত ভারত এবং আংশিক মিয়ানমার থেকে আমদানি করে। তবে বাস্তবতা হলো, ব্যবসায়ী মহল যদি আন্তরিক হন এবং সদিচ্ছা পোষণ করেন, তাহলে আপাতত অভ্যন্তরীণ মজুদ থেকে পেঁয়াজ ছেড়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন। কেননা, এই পেঁয়াজ তারা আমদানি করেছেন আগের দামে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেই সততা ও নীতি-নৈতিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

এ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। কৃষকের দেশে কৃষিপণ্য কেন আমদানি করতে হবে সেই ভাবনা আগে ভাবা উচিত। কিন্তু আমরা তা না ভেবে সংকট মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দিতে বড় বড় বুলি আওড়াই। কিন্তু আসল কাজ কিছুই হয় না।

\হচলতি বছর বন্যার কারণে ভারতের মহারাষ্ট্র ও কর্নাটে পেঁয়াজের উৎপাদন বড় ধাক্কা খায়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দিলিস্নর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ রুপিতে, যা এক মাস আগেও ২০ থেকে ৩০ রুপি ছিল। ভারত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের পেঁয়াজ রপ্তানি করেছে, যার একটি বড় অংশ এসেছে বাংলাদেশে। রপ্তানিকারক দেশ ভারতেই যদি পেঁয়াজ সংকট থাকে তাহলে রপ্তানি করবে কীভাবে? এবার নিজেদের বাজারে ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। এর ফলে আমাদের দেশে দিনাজপুরের হিলি ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে দেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। পরে অবশ্য শোনা গেছে ভারত থেকে কিছু পেঁয়াজ এসেছে।

সরকারি এক দায়িত্বশীলের তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজভর্তি দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। মিসর ও তুরস্ক থেকেও পেঁয়াজ আসার পথে। দেশি পেঁয়াজের মজুদও সন্তোষজনক। তাই যদি হয়, তাহলে তারপরও কেন পেঁয়াজ সংকট? তাহলে কি এই সংকট মুনাফাখোর মজুদদারদের তৈরি করা? চট্টগ্রামের কিছু ব্যবসায়ীর আচরণ অন্তত তাই প্রমাণ করে। তাহলে চলমান পেঁয়াজ সংকট মোকাবিলা করতে এখনই দেশজুড়ে মজুদদারদের গোপন গোডাউনগুলোয় সরকারি বাহিনীর অভিযান চালানো দরকার। উদ্ধার করা দরকার মজুদ করা পেঁয়াজ। আর পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্য সৃষ্টি করার জন্য সেই দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।

মাসখানেক পরই দেশের বাজারে আসবে শীতকালীন পেঁয়াজ। এই সময়টায় সংকট মোকাবিলা করতে প্রয়োজনে আমদানি করা পেঁয়াজ টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে বিক্রি করতে হবে। পাশাপাশি আগামী দিনের প্রস্তুতি হিসেবে ভাবতে হবে দেশেই বর্ধিত উৎপাদনের কথা। তাহলেই আসতে পারে পেঁয়াজ সংকটের স্থায়ী সমাধান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি রাঁধুনিকে বলে দিয়েছি পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করতে। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও বলছি, আসুন আমরা কিছুদিনের জন্য পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ করি। তাহলে দেখবেন সিন্ডিকেট চক্র পেঁয়াজ আপনাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিতে বাধ্য হবে।

এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, ভারতে বছরে দুইবার পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। একবার শীতকালে আর একবার গ্রীষ্মকালে। বাংলাদেশে শীতকালেই অধিকাংশ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে তেমন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় না বললেই চলে। যদিও গ্রীষ্মকালে চাষ করার মতো উন্নতজাতের বারি পেঁয়াজ-২ ও বারি পেঁয়াজ-৫ নামের দুটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে মসলা গবেষণা কেন্দ্র। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। আমি মনে করি, পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেদিকেই বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত। যে করেই হোক সরকারকে দ্রম্নত বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে সবার আগে অসৎ ও অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো জরুরি।

তাদের মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না ঘটবে ততদিন পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির থাকবেই এবং দেশের জনগণও তাদের কাছে জিম্মি থাকবে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর ও কঠোর উদ্যোগই পারে জনগণতে হয়রানি ও দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে।

আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশন, সদস্য এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে