উন্নয়ন প্রকল্পে কী পরিমাণ টাকার অপচয় বা লুটপাট হচ্ছে তা বালিশ, বালিশের কভার বা পর্দা ক্রয়ের ঘটনা থেকে আমরা অনুভব করলাম। অন্যদিকে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি, কারিগরি ত্রম্নটি, সিস্টেম লস বা অন্যান্য অনেক মামুলী কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে আমাদের। অপচয়ের একটি দিক আমাদের কাছে ধরা পড়ে কিন্তু এর গভীরতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অনেক সময় আঁচ করতে পারি না। যেমন- এককাপ কফি ফেলে দেয়া মানে ১৪০ লিটার পানি ফেলে দেয়া! কারণ এই অল্প পরিমাণ কফি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১৪০ লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। ঢাকার কাওরান বাজারে একটি কেসস্টাডিতে দেখলাম প্রতিদিন ওই বাজারে ১৫০ টন শাক-সবজি অপচয় হচ্ছে যা সম্পূর্ণ খাবারের উপযোগী। কিন্তু এই অপচয়কৃত খাদ্য যখন বর্জ্যে রূপান্তরিত হয়, তখন তা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মোট বর্জ্যের ১৮%, যা অপসারণ করতে ব্যাপক লোকবল, জায়গা, গাড়ি ও তেলের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের যে পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদার পণ্য অপচয় হয় তা কল্পনাতীত। ডঋঙ-এর তথ্য মতে প্রতি বছর ১.৩ বিলিয়ন টন খাদ্যের অপচয় হয়। যা কিনা পুরো আফ্রিকা মহাদেশের খাদ্য উৎপাদনের সমান। গার্ডিয়ান পত্রিকার গবেষণা প্রতিবেদন মতে বিশ্বের খাদ্যের অর্ধেকই অপচয় হয়। অথচ এই অপচয় কমিয়ে মিতব্যয়িতার নীতি অবলম্বন করে বিশ্বে অর্থনীতির উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত, চীনসহ আরও অনেক দেশ। বাংলাদেশেও প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ব্যাপক অপচয় পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে বাংলাদেশে রাস্তা তৈরিতে প্রতি কিলেমিটারের জন্য খরচ হয় ৬.৬-১১.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে খরচ ১.৩-১.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং চীনে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে খরচ হয় মাত্র ১.১-১.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া ২০১৯-এর শেষ হিসাব মতে বিদেশে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি কর্মরত, যাদের বেশির ভাগই অদক্ষ এবং এদের মোট আয় গড়ে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বাংলাদেশে বিদেশি দক্ষ লোকবল কর্মরত আছে প্রায় ২,৫০,০০০। যারা প্রতি বছর দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ শুধু দক্ষতার কারণে তারা আমাদের লোকবল থেকে প্রতিজন প্রায় ১৬ গুণ বেশি আয় করছে। অর্থাৎ অদক্ষতার জন্য আমাদের কোটি কোটি মার্কিন ডলার অপচয় হয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা ত্রম্নটির কারণে বোরো ও আমন বাবদ ২.৩ বিলিয়ন টাকার ক্ষতি হয়। এ ছাড়া ঋঅঙ-এর তথ্য মতে বাংলাদেশে চঈঋ বাবদ (চবৎ ঈধঢ়রঃধ ঋড়ড়ফ) ১২০ থেকে ১৭০ কেজি খাদ্য অপচয় হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অভিমতে গত বছর সামান্য কিছু টাকা ব্যয়ে ১ কোটি ২৮ লাখ ৯৩ হাজারটি ইঁদুর মেরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ফসল রক্ষা করা হয়েছিল অর্থাৎ অল্প ব্যয়ে বিশাল সঞ্চয়।
বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অথচ এই দুটির অভাবে বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ লাখের ও বেশি শিশু মারা যায়। মৃতু্যর আগে তাদের চিকিৎসা বাবদ যে ব্যয় হয় তা বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন করার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।
এ ছাড়া শুধু প্রশিক্ষিত ধাত্রীর অভাবে প্রসবকালীন জটিলতা বিশ্বে প্রতিদিন ১ হাজার নারী ও ২ হাজার শিশুর মৃতু্য ঘটে। ইথিওপিয়ায় এই হার ৯৪% আর ব্রিটেনে এই হার মাত্র ১%। প্রশিক্ষিত ৩ লাখ ধাত্রীর মাধ্যমে বছরে দশ লাখের বেশি শিশুকে অপ্রত্যাশিত মৃতু্য থেকে রক্ষা করা সম্ভব। ওই শিশুদের মৃতু্যকালিন চিকিৎসা ব্যয় ৩ লাখ ধাত্রী নিয়োগ থেকে অনেক বেশি। তা ছাড়া একজন মায়ের মৃতু্যতে সন্তানসহ ওই পরিবারটিতে ভাঙনের সৃষ্টি হয়, যার অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক দিকে পড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যানজটের কারণে যে কি পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার একটি বাস্তবচিত্র তুলে ধরলাম। বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় যানজটের শহরের (ওয়াল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স ২০১৮ প্রতিবেদন অনুযায়ী) অন্যতম কারণ প্রায় ১০,২১০০০ (দশ লাখ একুশ হাজার) রিকশা। অথচ এই রিকশা সম্পূর্ণ উঠিয়ে নিলে কয়েক দিকে আমরা লাভবান হব। যেমন-
(১) স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যেতে বাধ্য হবো। কি লাভ হবে এতে? বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৩.৩৬% লোক নিম্নোক্ত রোগ আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করে যেমন: হৃদরোগ-৭%, ডায়াবেটিকস-৩.৮%, স্ট্রোক-৬.৮%, রক্তচাপ-২.২৪%, কিডনি রোগ-৩.৪৮%। যার চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল অথচ প্রতিদিন আমরা স্বল্প সময়ের জন্য হাঁটাহাঁটি করলে যে শারীরিক পরিশ্রম হবে তাতে এই রোগগুলো ব্যাপকভাবে কমে আসবে।
(২) যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২,০০,০০০ (বত্রিশ লাখ) শ্রম ঘণ্টা নষ্ট হয় এবং প্রতিবছর যানজটের কারণে ক্ষতি হয় ৩৮,০০০ কোটি টাকা। তা ছাড়া যানজটের কারণে মানসিক ও শারীরিক অস্থিরতার ফলে পারিবারিক ভাঙন ও কলহ এবং সামাজিক অরাজকতা বৃদ্ধি পায়।
(৪) যানজটের জন্য অন্যতম দায়ী ১০ লাখ ২১ হাজার রিকশা চালকের সঙ্গে পরিবারসহ প্রায় ৪০ লাখ লোক বস্তি স্থাপন করে ঢাকায় থাকছে। যে বস্তিগুলোতে অবাধে মাদক বেচাকেনা হচ্ছে এ ছাড়া মাদকের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৯৫ লাখের বেশি যুবক যারা শুধু মাদক সেবনে ব্যয় করে ৪০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩২০০০ কোটি টাকা। এই মাদকের ৬০-৭০% আসে মিয়ানমারের ইয়াবার মাধ্যমে। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত মাত্র ৫৪ কিলোমিটার। উপরে উলিস্নখিত রিকশাচালকদের সবাইকে যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাদকের প্রতিরোধ বাহিনী হিসাবে সীমান্তে ব্যবহার করা হয়। তবে প্রত্যেকজনকে বছরে প্রায় ৩,৫০,০০০ টাকায় বেতনভুক্ত করা যাবে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২৯ জন ব্যক্তি নিহত হয় এবং আর্থিক ক্ষতি হয় ৩৪ হাজার কোটি টাকা এবং যানজটে জ্বালানি বাবদ অপচয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশে বর্তমান বেকার যুবকের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। এদের সবাইকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে যানজট ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ বাহিনী হিসেবে নিয়োগ দিলে প্রত্যেককে প্রায় ২ লাখ টাকায় বেতনভুক্ত করা যাবে। তা ছাড়া রাজধানী ঢাকা যানজটমুক্ত হলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ৭%-এর বেশি নিশ্চিত হবে।
এনবিআরের তথ্য মতে, গত ৩ বছরে ৬৩,০০৩,৮১৮ কোটি মোবাইল ফোন বাংলাদেশে এসেছে। যদিও বেসরকারি তথ্য মতে এই সংখ্যা ১২ কোটিরও বেশি। তা ছাড়া বিটিআরসির হিসাব মতে প্রতি বছর ৩ কোটি মোবাইল আমদানি হয় এবং বাংলাদেশে আমদানিকৃত ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, গাড়ি অন্যান্য বিলাসবহুল পণ্য যে টাকায় আমরা আমদানি করি, তাতে আমাদের কষ্টার্জিত আয় ও রেমিট্যান্সের বেশির ভাগই বিদেশে চলে যায়। কিন্তু যদি আমরা নিজ দেশে এগুলো উৎপাদন করতে পারি, তবে বাংলাদেশে ব্যাপক কর্মস্থানের সৃষ্টি হবে এবং অপচয় রোধের মাধ্যমে খুব দ্রম্নত উন্নয়ন সম্ভব হবে। ১৯৯৭- ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে বিদু্যতের সিস্টেম লস ছিল ৪৭% যা কমতে কমতে বর্তমানে ২%-এ পৌঁছেছে। কিন্তু অন্যান্য সেক্টরে অপচয়ের মাত্রা তেমন কমে নাই, তবে চেষ্টা করলে তা সম্ভব এটি এখন প্রমাণিত।
নাজমুল হক
শাহজাদপুর, গুলশান, ঢাকা