শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সীমাবদ্ধতাকে সৃজনশীলতায় রূপান্তরিত করলেই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব

মানুষের চাহিদার সীমা নেই। যার যত বেশি সুযোগ সুবিধা থাকে তার চাহিদা ততই ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। কাজেই আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকবেই। সেই সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে শিখতে হবে। থাকতে হবে সৎসাহস, প্রচেষ্টা, ধৈর্য, মনোবল, স্বপ্ন ও স্বপ্ন পূরণের তাড়না, করতে হবে পরিশ্রম। খুঁজে বের করতে হবে সৃজনশীল পথ, সৃজনী প্রক্রিয়া।
ইসমতআরা ভূঁইয়া ইলা
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বিখ্যাত মার্কিন বাস্কেটবল খেলোয়াড় মাইকেল জর্ডান বলেছিলেন, 'আমি ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারি কিন্তু চেষ্টা না করাকে মেনে নিতে পারি না।' অন্যত্র, এ পি জে আব্দুল কালাম মনে করেন, 'স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।' আমারও স্বপ্ন ছিল, চেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে নাট্যকলা বিষয়ে অধ্যয়ন করি। অধ্যয়ন শেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ (টিপিএস) বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করি। গত ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে টিপিএস বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বগ্রহণ করতে হয় আমাকে। কিন্তু বিভাগের প্রত্যাশা পূরণে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা (ব্যবহারিক ক্লাসরুম, মঞ্চ, শিক্ষক সংকট প্রভৃতি) বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়- যা প্রতিনিয়ত তাড়া করতে থাকে বিভাগকে। কেননা, এই বিভাগে বিএ ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে প্রথম ভর্তি হওয়া ব্যাচটির তখনও অনার্সের রেজাল্ট হয়নি, কিন্তু তারা ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে এমএ প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করেছিল। অর্থাৎ তখন বিভাগে ৭টি ব্যাচ অধ্যয়ন করে। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের এমএ পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে তাদের আরও ১ বছর বাকি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে আরও একটি ব্যাচ বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ তখন ব্যাচ সংখ্যা হলো ৮টি, যেখানে সাধারণভাবে থাকার কথা ৫টি। এমতবস্থায় সেশনজটের দুঃসহ কবলে পড়ে শিক্ষার্থীরা, চরম হতাশা দানা বাঁধতে থাকে তাদের মনে। এ বিষয়টি আমরা ভালোভাবে অনুধাবন করতে থাকি। আমরা বিভাগের শিক্ষকমন্ডলী মিলে সেশনজট নিরসনের নিমিত্তে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করি। সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের নিজ নিজ কার্যক্রম সম্পাদন করায় বর্তমানে সেশনজট নিরসন অনেকটাই সম্ভব হয়েছে। বিগত প্রায় আড়াই বছরে স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পর্ব সম্পন্ন করেছে ৪টি ব্যাচ, স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হয়েছে ৩টি ব্যাচের এবং আগামী ডিসেম্বর/জানুয়ারিতে আরও ১টি ব্যাচের পরীক্ষা সম্পন্ন হবে আশা করি। বর্তমানে বিভাগে চলমান ব্যাচ সংখ্যা ৬টি। আমাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে হয়তো আর ১ বছরের মধ্যে এর সংখ্যা কমে হবে ৫টি। প্রত্যাশা করি, নির্মূল হবে বিভাগের সেশনজট।

যে কারণে সেশনজট কমানো সম্ভব হয়েছে: বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকদের নিরলস পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথা প্রথমেই উলেস্নখ করতে হয়। কখনো আমাদের ক্লাস শুরু করতে হয়েছে সকাল ৭টায় এবং শেষ করতে হয়েছে রাত ৯টা/১০টায়। এতে কখনো ব্যক্তিগত কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেইনি আমরা, সবাই মিলে হাতে হাত রেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। আমরা সর্বদা ভেবেছি আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের কথা। তারা আমাদের এই কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিভাগের কর্মকর্তা ও অফিস সহায়করাও কঠোর পরিশ্রম করেছেন বিভাগের স্বার্থে। সেশনজট নিরসনে মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান মহোদয়ের সদিচ্ছা ও পরামর্শ আমাদের আরও অনুপ্রাণিত করেছে।

সেশনজট কমানোর জন্য আমাদের বিভাগে বিগত প্রায় আড়াই বছরে অনেকগুলো পরীক্ষা নিতে হয়েছে, দ্রম্নত দিতে হয়েছে সেগুলোর ফলাফল। যেখানে আমাদের প্রচেষ্টা ও নিয়মিত যোগাযোগের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর। জরুরি ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা প্রশংসনীয়। আমাদের বিভাগের ব্যবহারিক কোর্সের সংখ্যা অধিক হওয়ায় বেশিরভাগ ব্যবহারিক পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্নের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। অনেক জরুরি ফাইলের সঠিক পরামর্শ এবং দ্রম্নত অর্থ প্রদান করেছে অর্থ ও হিসাব দপ্তর। তাদের ভূমিকাও আমাদের এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে।

অধিক পরীক্ষা গ্রহণ করার জন্য কখনো গাছতলায়, কখনো বারান্দায়, কখনো মাঠে, কখনো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সম্মুখে, কখনো চুরুলিয়া মঞ্চে, কখনো গাহি সাম্যের গান মঞ্চে আমরা তত্ত্বীয় ক্লাস, মহড়া ও পরীক্ষার কার্যক্রম সম্পন্ন করে চলেছি, কখনো সহযোগিতা নিয়েছি প্রকৌশল দপ্তরের। তত্ত্বীয় পরীক্ষা গ্রহণের জন্য রুমের সহযোগিতা পেয়েছি সঙ্গীত বিভাগ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের। এ ছাড়াও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন বর্তমান কলা অনুষদের সম্মানিত ডিন মহোদয়, প্রক্টর মহোদয়, শিক্ষক সমিতির সভাপতি মহোদয় এবং রেজিস্ট্রার মহোদয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান মহোদয় আমাদের কখনোই হতাশ করেননি, বরং তার শত ব্যস্ততার মাঝেও সর্বদা তিনি অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। গরমে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কষ্ট দেখে সম্প্রতি তিনি নিজ প্রচেষ্টায় আমাদের স্টুডিও থিয়েটার ও মহড়া কক্ষকে সংস্কার করে এসি সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন, ব্যবস্থা করেছেন আরও দুইটি ক্লাস রুমের। এ কাজটি সম্ভব হয়েছে মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের আন্তরিক সদিচ্ছার ফলে। এ ক্ষেত্রে উপাচার্য মহোদয়কে সহযোগিতা করেছেন মাননীয় ট্রেজারার প্রফেসর মো. জালাল উদ্দিন মহোদয় এবং প্রকৌশল দপ্তর। এ ছাড়াও মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের কাছে থেকে আশ্বাস পেয়েছি পারফর্মিং আর্টের জন্য হবে স্বতন্ত্র ভবন। তাই আমরাও স্বপ্ন দেখি থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ একদিন আলাদা অনুষদে রূপান্তরিত হবে। যার প্রাথমিক সূত্রপাত করেছেন বিভাগের শিক্ষকমন্ডলী, স্নাতকোত্তর ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে দুটি শাখা (১) অভিনয় এবং (২) প্রায়োগিক নাট্যকলা চালু করার মাধ্যমে।

সীমাবদ্ধতাকে গুরুত্ব না দিয়ে শত প্রতিকূলতার মাঝেও টিপিএস বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলীর উদ্যোগে এবং বিভাগীয় প্রধানের সম্পাদনায় বিভাগের গবেষণা জার্নাল 'নাট্যবিদ্যা'র দুটি সংখ্যা (ডিসেম্বর ২০১৭ ও ডিসেম্বর ২০১৮) প্রকাশিত হয়েছে এবং কাজ চলছে তৃতীয় সংখ্যার। নিয়মিত একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এর বাইরে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করে থাকি। সম্প্রতি দুটি বড় ইভেন্ট সম্পন্ন করেছে থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ। একটি হচ্ছে- মাননীয় উপাচার্য মহোদয়সহ টিপিএস বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার সহযোগিতায় গত ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের 'মহান বিজয় দিবস' উদযাপন উপলক্ষে বিভাগের প্রভাষক মাজহারুল হোসেন তোকদারের নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্ববৃহৎ আকারে মঞ্চস্থ হয় নাটক 'কোর্ট মার্শাল'। অন্যদিকে- বিভাগীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মাননীয় উপাচার্য এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে 'শম্ভুমিত্র ও বিজন ভট্টাচার্য আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব-২০১৯'-এ মঞ্চস্থ করা হয় বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীনের নির্দেশনায় নাটক 'লোককইন্যা রূপবান'। নিয়মিত একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি গবেষণা জার্নাল প্রকাশ ও বড় ইভেন্টগুলো গ্রহণ করার পূর্বে সম্ভাবনার চেয়ে সীমাবদ্ধতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু বিভাগের সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনোবল সীমাবদ্ধতাকে গুরুত্ব দেননি, গুরুত্ব দিয়েছেন মহৎ কাজগুলোকে, করেছেন নিরলস পরিশ্রম, অবতীর্ণ হয়েছেন সৃজনশীল প্রক্রিয়ায়।

যে বিষয়গুলো নেতিবাচক মনে হয়: পরীক্ষা পেছানোর বিষয়টি কামনা করি না, কামনা করি না পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করা। যে কোনো অপকৌশল আমাকে পীড়া দেয়, পীড়া দেয় চেইন অব কমান্ডের বিশৃঙ্খলা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতা। এই বিষয়গুলো প্রকৃত উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, নষ্ট করে আন্তঃসম্পর্ক, অকস্মাৎ নস্যাৎ হয় ভালো কাজ করার পরিবেশ। নেতিবাচক বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজ নিজে করলেই সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের শিক্ষা সম্ভব হবে কাজী নজরুল ইসলামের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চেতনাকে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা।

মানুষের চাহিদার সীমা নেই। যার যত বেশি সুযোগ সুবিধা থাকে তার চাহিদা ততই ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। কাজেই আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকবেই। সেই সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে শিখতে হবে। থাকতে হবে সৎসাহস, প্রচেষ্টা, ধৈর্য, মনোবল, স্বপ্ন ও স্বপ্ন পূরণের তাড়না, করতে হবে পরিশ্রম। খুঁজে বের করতে হবে সৃজনশীল পথ, সৃজনী প্রক্রিয়া।

আমি বিশ্বাস করি এবং মেনে চলি- 'একমাত্র, সীমাবদ্ধতাকে সৃজনশীলতায় রূপান্তরিত করলেই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব।' এ ক্ষেত্রে পাথেয় হতে পারে আব্রাহাম লিংকন, চার্লি চাপলিন, শেখ সাদী, কাজী নজরুল ইসলাম, এ পি জে আব্দুল কালাম প্রমুখের জীবন ও কর্ম।

ইসমতআরা ভূঁইয়া ইলা: বিভাগীয় প্রধান, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67399 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1