শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন

মুক্তিযুদ্ধের লালিত চেতনাকে আশ্রয় করে একটি ব্যাপক অসাম্প্রদায়িক ঐক্যই পারে একটি বিকল্প বিরোধী দলের উত্থান ঘটাতে। যে বিকল্পের সন্ধান ঘটানোর আহ্বান বিচ্ছিন্নভাবে হলেও দীর্ঘকাল যাবৎ দিয়ে আসা হচ্ছে- আজ তা কাজে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। এভাবেই এ দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া বামপন্থি রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটানো এবং একটি সংগঠিত বাম শক্তি দৃশ্যমান হয়ে ওঠার আশাবাদ সবার মনে নতুন করে জাগানো সম্ভব।
রণেশ মৈত্র
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ষাটের দশকে একটি অবিস্মরণীয় স্থান দখল করে নিয়েছে। এ দশকের মুখায়িত অবদান, তার উদ্যমতা, তার ব্যাপকতা এত দ্রম্নতালয়ে অগ্রসর হচ্ছিল যে তার একটি উলস্নম্ফন ঘটেছিল ১৯৭২-এ যখন মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলাম। এই মুক্তিযুদ্ধের সব পরিণতির জন্য যে ভিত্তিভূমির অর্থাৎ ব্যাপক গণ-ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল অসীম, ৭ মার্চের অসাধারণ ভাষণ এবং তার পশ্চাতে ২৩ বছরের ধারাবাহিক গণসংগ্রাম তা প্রবলভাবে গড়ে তুলেছিল।

কিন্তু ষাটের দশক কি কোনো পূর্ব ইতিহাস ব্যতিরেকেই ষাটের দশকে পরিণত হতে পারতো? সূচনা করতে পারতো কি ১৯৬৯-এর গণ-অভু্যত্থানের?

বস্তুত, ইতিহাসও একদিনে বা এক বছরে সৃষ্টি হয় না। গণআন্দোলন গণঅভু্যত্থানও না। বিস্মৃত পঞ্চাশের দশককে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের কোনো আন্দোলনই দৃশ্যমান হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না ষাটের মতো উত্তাল একটি দশকেরও। পঞ্চাশের দশক বাঙালি জাতির তাবৎ গৌরবোজ্জ্বল উত্থানের ভিত্তিভূমি গড়ে তুলেছিল তার ধাত্রীর কাজটি সাফল্যের সঙ্গে হয়েছিল ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭১। যেন একটি আন্দোলনের মালাগাঁথা হয়েছিল আন্দোলন-সংগ্রামে বিকশিত ফুলে ফুলে। তার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ থেকে দেশান্তরে, নগর থেকে নগরান্তরে, শহরে থেকে শহরান্তরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

স্মরণে আনা প্রয়োজন যে চলিস্নশের দশকের শেষ প্রান্তে এসে ১৯৪৮ সালের মার্চে করাচি থেকে শহীদ ধীরেন দত্তের জ্বালানো ভাষা আন্দোলনের সলতেটি কম তাৎপর্য বহন করে না। করাচি থেকে ফিরে যখন জননেতা ধীরেন দত্ত ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা তাকে ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানান, জানান সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। সেই থেকে শুরু।

অতঃপর জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৯ সালে, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫১-তে গড়ে তোলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ আগামী দিনের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখবার দায়িত্ব নিয়ে।

কিন্তু ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি করাচির সংসদে শহীদ ধীরেন দত্তের জ্বালানো বাংলা ভাষার সলতেটি দিব্যি স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়ে একটি ঝড় তুলে ফেলল পূর্ববাংলার শহরে, নগরে, বন্দরে, গ্রামে, গ্রামান্তরে। বাঙালির কণ্ঠে স্স্নোগান উঠলো 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'- 'অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' 'বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে।' প্রকম্পিত হলো ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার রাজপথ।

বাঙালির নবজাগরণের মুহূর্ত হিসেবে, তারা ঘরের ফেরার আন্দোলন হিসেবে অসাধারণ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হলো বাহান্নর একুশে ফেব্রম্নয়ারি। পাকিস্তানের ইসলামী জোশ, তার দ্বিজাতিতত্ত্ব তার তাবৎ বৈষম্যমূলক বাঙালি ও বাংলা ভাষা বিদ্বেষী ক্রিয়াকলাপকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিল তরুণ সমাজ। সলতে থেকে স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিঝড় গ্রাস করল সমগ্র পূর্ব বাংলা- চূড়ান্ত পরাজয়ের ঘণ্টা নিনাদিত হতে শুরু করল যেন।

আন্দোলনকারীরা দেখলেন, ভাষা আন্দোলনকে অমর করে রাখতে হলে সাম্প্রদায়িকতাকে 'না' বলতে হবে আঁকড়ে ধরতে হবে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনাবোধকে; কারণ ওই চেতনাই হলো ভাষা আন্দোলনের মৌলিক প্রাণশক্তি।

কিন্তু এই নবতর চেতনা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিস্মৃত সেই চেতনা হিসেবে অসাম্প্রদায়িকতাকে মজবুত ভিত্তির ওপর বাঙালি সমাজকে দাঁড় করাতে হলে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তাই ১৯৪৮ গড়ে উঠেছিল বামপন্থী পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ (বর্তমানের আওয়ামী যুব লীগ নয়) এবং যুবলীগ ১৯৪৮ ও ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

অতঃপর বাহান্ন সালেই; তার শেষার্ধে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ গড়ে তুললেন বিভাগোত্তর বাংলার প্রথম অসাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠন যা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র ইউনিয়নের লক্ষ্য ঘোষিত হলো "ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি"। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাকে হাজির নাজির জেনে ছাত্র ইউনিয়নের নেতানেত্রী ও কর্মীরা ছড়িয়ে পড়লেন দেশের জেলায় জেলায়, মহকুমায় মহকুমায়, থানায় থানায়। উল্কার বেগে ছাত্র ইউনিয়ন ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বহুসংখ্যক ছাত্রীও হলেন এই সংগঠনের সাহসী সংগঠক তারাও ছাত্র নেতাদের সঙ্গে মিলে মিশে সর্বত্র ঘুরে ঘুরে ছাত্র ইউনিয়নে ব্যাপ্তি ঘটালেন।

ছাত্র ইউনিয়ন যে রাজনীতি প্রচারের এক গৌরবোজ্জ্বল বাহনে পরিণত হলো তাই হলো বামপন্থী রাজনীতি এবং ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ওই রাজনীতি ও তার প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, অর্থনৈতিক বৈষম্য অবসানের সপক্ষে এক নবতর রাজনীতিরও প্রসার। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেল, সারাদেশের ছাত্র যুব সমাজ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হলেন সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরোধিতার আবেদন। দেশের মানুষ যুব সমাজসহ ওই আদর্শগুলোকে গ্রহণ করে আগ্রহ ভরে।

ক্রমশ দাবি উঠতে থাকল পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম ছাত্র লীগ ও পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগকেও তাদের নাম থেকে মুসলিম শব্দ তুলে দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতা আঁকড়ে ধরতে হবে। দাবিটি জনপ্রিয়তা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কিছুকাল পরে উভয় সংগঠনই তাদের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দ তুলে দিলে দেশে সার্বিকভাবেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি একটি স্থান পেয়ে গেল এবং তার আবেদন এমনই যে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে আর কোনো সংগঠন তার নামের সঙ্গে 'মুসলিম' শব্দ জুড়ে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি।

ছাত্র ইউনিয়ন দেশের জনজীবনের সমস্যাবলী ও ছাত্র সমাজের শিক্ষা সংক্রান্ত এবং শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে সর্বজনীন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা চালুর দাবিতে, ছাত্রসমাজের দৈনন্দিন সমস্যাবলি দূর করার দাবিতেও আন্দোলন গড়ে তুলে ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনে পরিণত হতে পেরেছে। শিক্ষক সমাজের ন্যায় সঙ্গত দাবিগুলোও যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন সূচিত আন্দোলনগুলোতে।

একই সঙ্গে গড়ে উঠতে থাকল সাংস্কৃতিক আন্দোলন- যাতে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও লেখালেখি প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ অবদান রাখতে শুরু করেন। ভারতের আইপিটি'র চেতনাধারার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের চেতনার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তড়িত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে শরু করল সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী। রচিত হতে থাকল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নতুন এক আবহ। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকল খেটে খাওয়া মানুষের, অবহেলিত কৃষক, শ্রমিক ও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের রাজনীতির অঙ্গনে পদচারণা।

সেই থেকে পথ চলতে শুরু করে বামপন্থি রাজনীতি পাকিস্তানের বুক চিরে। কাজটা তখন সহজ ছিল না। তার জন্য জেল-জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের- যার সিংহভাগই ছিলেন গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মী।

বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের জয় যাত্রা এই বিশাল কর্মী বাহিনীকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। পাকিস্তানের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও পরিণত হন বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশে।

কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। পার্টির অসংখ্য নেতাকর্মী কারাগারে নয়তো আত্মগোপনে থেকে কাজ পরিচালনা করতেন। কমিউনিস্ট হিসেবে বেশি পরিচিত নন এমন নেতাকর্মীদের আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে একদিকে গণ-সম্প্রীতি বাড়ানো অপরদিকে দুলটিকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করতে উদ্যোগী ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে রীতিটি ফলপ্রসূ হয়েছিল। সেলিনা বানু, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, ভাষা মতিনসহ অনেক কমিউনিস্ট নেতা আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিসমূহের বড় অবলম্বন কমিউনিস্টদেরও। অতঃপর সবার এবং শেখ মুজিবের উদ্যোগটি ভূমিকায় ১৯৫৬ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ আওয়ামীতে পরিণত হলো। তার আগেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে পরিণত হয়। রাজনীতিতে মূল সংগঠনের অসাম্প্রদায়িকীকরণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন উপাদন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পূর্ব বাংলাতেও তখন আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতাসীন।

আকস্মাৎ দেখা গেল, দেশের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রের বিন্দুমাত্র সংশোধন না করেই ঘোষণাক করলেন 'পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% ভাগ স্বায়ত্তশাসন' হয়ে গেছে অথচ ওই স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগই ছিল চ্যাম্পিয়ান, দেখতে পাওয়া গেল আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞা-অবহেলা প্রদর্শন করে দলীয় নীতি আদর্শ পরিপন্থী সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো- সেন্টো প্রভৃতি সামরিক চুক্তির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করলেন। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সমগ্র পাকিস্তানের সব প্রদেশের প্রগতিশীল, বাম-গণতান্ত্রিক দলগুলির সমবায়ে ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করে। দলটি তখন পাকিস্তানের বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীদলে পরিণত হলো। সর্বত্রই আনন্দের হিলেস্নাল পরিলক্ষিত হলো।

অতঃপর সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী ন্যাপ গড়ে তোলা হয়- এতে মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমেদ ও অপরাপর বামপন্থী নেতারা বিশেষ ভূমিকা অবলম্বন করে সারা প্রদেশে ন্যাপের নানা শাখা প্রশাখা গড়ে তোলেন। সঙ্গে আরও ছিলেন সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মীর হাবিবুর রহমান, চৌধুরী হারুনর রশিদ প্রমুখ দেশবরেণ্য বামপন্থি প্রগতিশী নেতারা। ন্যাপ হয়ে দাঁড়ালো পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম দল এবং পাকিস্তানের বৃহত্তম দল।

স্বাভাবতই সামরিক শাসনের অবসান, সাম্প্রদায়িকতার অবসান, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। সেই ১৯৫২ থেকে ১৯৫৯ মাত্র এই ১৭ বছরের মধ্যে দেশের বামশক্তি একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হলো। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ন্যাপের কোয়ালিশন এবং কেন্দ্র, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ন্যাপের একক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিল।

ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬ দফা তথা বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ায় ন্যাপে অনেক সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার প্রায় সব আসন পেয়ে গেলেন। ন্যাপ পেল বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। ওই দুটি প্রদেশেই ন্যাপের একক শক্তিতে সরকার গঠিত হলো।

ধীরে ধীরে ক্ষমতার হাত বদলের দাবি জোরদার হলো আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতৃত্বে। পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয়। এই পর্যায়সহ সব পর্যায়েই ন্যাপ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কমিউনিস্ট পার্টি অনেক দিন আগে থেকেই ন্যাপের মধ্যে কাজ করার নীতি গ্রহণ করে।

এতটা গৌরবোজ্জ্বল অতীতের দাবিদার ন্যাপ কিন্তু তার সাংগঠনিক ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৬৭ সালে চীন রাশিয়ার দ্বন্দ্বে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয় রুশ ও চীনপন্থি হিসেবে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চীনপন্থি এবং অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমেদের নেতৃত্বে রুশপন্থি ন্যাপ গঠিত হয়- যা এড়িয়ে গিয়ে ঐক্য বজায় রাখতে পারলে বাংলার ইতিহাস হয়তো ভিন্নভাবে লিখিত হতো।

মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপের সামগ্রিক এবং অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমেদের অসাধারণ ভূমিকা সব মহলের সশ্রদ্ধ প্রশংসা অর্জন করেছিল। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি- ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনী গঠন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমগ্র সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থনেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য অর্জিত হয়।

প্রত্যাশা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশের বামপন্থি আন্দোলন আরও দ্রম্নতগতিতে অগ্রসর হবে, সমাজের সব স্তরের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু তা সম্ভব হলো না কারণ-

প্রথমত, ন্যাপে দীর্ঘকাল যাবত কর্মরত কমিউনিস্ট নেতাকর্মীকে কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রকাশ্যে কাজ করার জন্য ঙঢ়বহ করা;

দ্বিতীয়ত, দফায় দফায় ন্যাপে ভাঙন।

পরিণতি দাঁড়ালো ভয়াবহ ও আত্মঘাতী। দুর্বল হতে হতে আজ ন্যাপ ও তার নানা খন্ডাংশ আজ চোখে দেখা যায় না।

\হদেশে শূন্যতা। বামপন্থি সংগঠনও আন্দোলনে শূন্যতা। প্রগতিশীল সব সংগঠনই প্রায় অস্তিত্বহীন ও স্থায়িতা আজ তাই সর্বাগ্রে ন্যাপের সব অংশের ঐক্য ও অতঃপর সব বামপন্থি দলের ঐক্য অপরিহার্য।

যে ঐক্যের কথা ইতোপূর্বে উিেলস্নখিত করেছি অর্থাৎ ন্যাপের সব অংশ একীভূত হওয়াই শুধু নয়- আর ব্যাপক ও অপরাপর বামপন্থি সব সংগঠন মিলে একক দলে পরিণত হওয়া আজ সময়ের দাবি (এতে শুধুমাত্র দলগুলোর নেতাকর্মীর মনেই উৎসাহ জোগাবে না দেশের বিরোধীদলীয় রাজনীতির শূন্যতা পূরণ করতে অত্যন্ত সহায়ক হবে। গণতন্ত্রের সংসদীয় রাজনীতির বিদ্যমান করুণ পরিস্থিতি থেকে মেহনতি মানুষের স্বার্থে তেমন ঐক্য আজ জরুরি।

উপমহাদেশের বাম-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমেদ চলে গেছেন। ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও তার স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই সভাগুলো থেকেও অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমেদের আজীবন লালিত সুমহান নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেও ওই বৃহত্তর ঐক্য অপরিহার্য। কাজেই দেশবাসীর ও নিম্নস্তরের অগণিত কর্মীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে অবিলম্বে ঐক্য গঠনে ব্রতী হওয়া প্রয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধের লালিত চেতনাকে আশ্রয় করে একটি ব্যাপক অসাম্প্রদায়িক ঐক্যই পারে একটি বিকল্প বিরোধী দলের উত্থান ঘটাতে। যে বিকল্পের সন্ধান ঘটানোর আহ্বান বিচ্ছিন্নভাবে হলেও দীর্ঘকাল যাবৎ দিয়ে আসা হচ্ছে- আজ তা কাজে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। এভাবেই এ দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া বামপন্থি রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটানো এবং একটি সংগঠিত বাম শক্তি দৃশ্যমান হয়ে ওঠার আশাবাদ সবার মনে নতুন করে জাগানো সম্ভব।

রণেশ মৈত্র: সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67398 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1