বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবাসন সংস্থান: প্রয়োজন গৃহকেন্দ্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন

ছোট পরিসরে স্বল্প ভূমি ব্যবহার করে বসবাসের সংস্কৃতির পরিচর্চা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত ও প্রণোদিত করা সময়ের দাবি।
প্রলয় কুমার ভট্টাচার্য্য ও নজরুল পারভেজ
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

মানুষের গুহা থেকে বের হয়ে গৃহে প্রবেশ সভ্যতার অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এ গৃহের বাহ্যিক সংগঠন তথা গৃহ কাঠামোয় ব্যবহৃত সামগ্রী, আকার ও আকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। কারণ একটি সমাজের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, আবহাওয়া, ধর্ম, দর্শন তথা সংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে গৃহব্যবস্থার সঙ্গে। গৃহায়ণ বিষয়ে বিখ্যাত গবেষকজুটি গ. ঋৎবরফ ধহফ চ. ঈষবরপযবৎ তাদের এক গবেষণাপত্রে- গৃহায়ণ গড়ে ওঠার পেছনে যেসব বিষয়াদি উলেস্নখ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগপূর্ণ সংস্পর্শ। তাই সংস্কৃতির সঙ্গে গৃহায়ণের সম্পর্ক আদি ও অবিচ্ছেদ্য। অত্র প্রবন্ধে গৃহায়ণ বিষয়ে সংস্কৃতি তথা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আলোচনা করার একটি অভিপ্রায় রয়েছে। কারণ একটি দেশের টেকসই গৃহায়ণ উন্নয়নের জন্য এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। গৃহ তৈরিতে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো স্থান (ঝঢ়ধপব)। আর এই স্থান (ঝঢ়ধপব) নিয়েই রয়েছে যতসব বিপত্তি। সাধারণভাবে এমন মতও রয়েছে, 'ঊধপয ধহফ বাবৎু ড়ৎমধহরংস রহ :যব ঁহরাবৎংব :ৎরবং :ড় ড়পপঁঢ়ু, পঁষঃরাধঃব, ঢ়ৎবংবৎাব ধহফ ঁঃরষরুব ঝঢ়ধপব.' মানুষের দেশ দখল, রাজ্য দখলের সীমাহীন প্রবণতার মধ্যে এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ সবসময়েই বড় স্থান নিয়ে বড় পরিসরবিশিষ্ট গৃহনামীয় কাঠামো তৈরির মধ্যে ছিল এক প্রকার আত্মপ্রসাদ- ফলে বড় রাজপ্রাসাদ, সুউচ্চ দালানকোঠা উদ্বত গৌরবের আত্মপ্রকাশ। ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর এই মনস্তাত্ত্বিক দুবর্লতা টের পায় ইংরেজরা। তাই এখানে ঔপনিবেশিক সিভিল সার্ভেন্ট, সেনা অফিসারদের জন্য বড় বড় অফিস, বাংলো তৈরি করেছে। যে পর্যায়ের অফিসারকে ঔপনিবেশকের মূল ভূখন্ডে সামান্য একটি ডেস্ক প্রদান করা হতো, তাকে ভারতে প্রেরণ করে আস্ত একটি ডাকবাংলো সমেত অফিস দেয়া হয়েছে- যাতে কলোনির মানুষের ওপর একটি সমীহ তথা ভয়ভীতি জাগিয়ে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা যায়।

তুর্কি, মুঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি যুগে চলমান এই মনস্তত্ত্ব কালের প্রবাহে এ অঞ্চলের মানুষজনের মননে দিব্যি গেঁথে যায়। আজ এই সংস্কৃতি (ঈঁষঃঁৎধষ যবমবসড়হু) দেশের আবাসন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমস্যা হিসেবে উপস্থিত। বাংলাদেশের মাত্র ১.৫৭ লাখ বর্গমাইল জমিনে প্রায় আঠারো কোটির মতো আদম সন্তানের বসবাস। তার মধ্যে প্রয়োজনীয় বন-জঙ্গল, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত বাদ দিলে আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র ২ কোটি ৪০ লাখ একর- জনসংখ্যা অনুপাতে মাত্র ১২.৫ শতাংশ যা এ গ্রহের সবচেয়ে কম অনুপাতগুলোর একটি। এই সামান্য পরিমাণ জমির সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার এ বিশাল জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শুধু প্রয়োজনই নয়- একান্ত অপরিহার্য। অথচ দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশের মতো এই অমূল্য সম্পদ কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে যা ১৮ কোটি জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সাংঘাতিক হুমকি হয়ে দেখা দেবে নিকট ভবিষ্যতেই।

বাংলা তথা ভারতীয় উপ-মহাদেশের সামাজিক জীবন সাংস্কৃতিকভাবে গৃহকেন্দ্রিক। আমাদের সব অনুষ্ঠান, পার্বন, আত্মীয়স্বজন এমনকি দাপ্তরিক বিষয়াদিও বাড়িকেন্দ্রিক- যা অন্য অনেক দেশের সংস্কৃতির মধ্যে ততটা নেই। এমনকি এশিয়ার উন্নত দেশ জাপান, সিঙ্গাপুরের অনেক উচ্চবিত্ত মানুষই মাত্র ছোট দুই রুমের ফ্ল্যাটে যথারীতি পরিবার নিয়ে বসবাস করে। কারণ সামাজিক মেলামেশার জন্য সোশ্যাল সেন্টার রয়েছে- এজন্য গৃহের পরিসর বড় হওয়ার দরকার পড়ে না। আশার কথা, আমাদের দেশের শহর এমনকি মফস্বল শহরে আস্তে আস্তে এ চল দেখা যাচ্ছে। অনেক সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি আজকাল কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল রেস্তোরাঁতেই সম্পন্ন হচ্ছে। এর প্রচলন আরও বাড়াতে হবে। ফলে ধীরে ধীরে বৃহত্তর পরিসরবিশিষ্ট আবাসনের প্রয়োজন কমে আসবে। বৃহত্তর বাসস্থান প্রবণতার মতো অধিক সন্তান গ্রহণের প্রবণতাও প্রয়োজনের নিরিখে কিন্তু আমরা কমিয়ে আনতে পেরেছি। এখন শিক্ষিত সচেতন জনগোষ্ঠীর কারও দুটি সন্তানের অধিক দেখা যায় না।

গৃহায়ণ সংস্কৃতির আরেকটি হালের ট্রেন্ড আলোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। গলায় গামছা পরে কূপমন্ডূক বাঙালি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর গ্রামের বটগাছের তলায় কাটিয়ে দিয়েছে। আধুনিক যুগে কিছুটা উন্নতজীবনের টান ও নবতর চাহিদার জোগান স্থানীয়ভাবে না পেয়ে চাকরি, ব্যবসা, বাণিজ্যের প্রয়োজনে বিদেশ বিভূঁইয়ে অবস্থান শুরু হয়। কালক্রমে বিদেশে বা নিদেনপক্ষে দেশীয় কোনো শহরে বসবাস করতে থাকলেও গ্রামের বাড়ির টান ছিন্ন হয়নি। তাই দেখা যায়, 'গ্রামের বাড়ি' নামের বিশেষ অর্থবোধক নতুন প্রপঞ্চের উদ্ভব। বছরে এক দুবার কারও কারও বা দুই তিন, বছরে গ্রামের বাড়িতে একবার আসা হয় তবু গ্রামে চাই বড় বাড়ি। বিশেষত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে আলিশান বাড়ি, অট্টালিকা তৈরি করার। এভাবে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজন ছাড়া বিশাল গ্রামের বাড়ি তৈরির সংস্কৃতি এই স্বল্প আয়তনের দেশে চলতে দেয়া যায় না। যেখানে, ২২ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে সংসদে উপস্থাপিত তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১০.৬৯ লাখ ভূমিহীন এবং ২.৮১ লাখের মতো গৃহহীন মানুষ বাস করে সেখানে কারও কারও একাধিক স্থানে বসবাসের জন্য একাধিক বাড়ি কোনোরূপ সুবিবেচনার পরিচায়ক হতে পারে না।

অর্থশাস্ত্রে একটি মূলনীতি ধরা হয় 'জধঃরড়হধষ ঢ়বড়ঢ়ষব :যরহশ ধঃ :যব গধৎমরহ' অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে লাভালাভ হিসাব করেই যুক্তিবান মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা এই জধঃরড়হধষরঃু-এর উপস্থিতি দেখি না। গবেষণায় এমনও দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি নতুন ধানী জমিতে বড় বাড়ি করে যে ঙঁঃপড়সব অর্জন করেন তার অর্থনৈতিক মূল্য জমিতে উৎপাদিত ফসলের সমান নয়। আবার ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু ঈড়ংঃ-এর বিবেচনায় বড় বড় আলিশান বাড়ি তৈরিতে যে খরচাদি হয়, তা যদি কল-কারখানা বা অন্যান্য উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যয় করা হতো তাহলে অর্থনীতির চাকার গতি আরও বাড়ত।

দেশে মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসন তৈরির ক্ষেত্রে চলমান এ সংস্কৃতি একটি বড় অন্তরায় বলে আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবেরও অভিমত। যদি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক আয়ের ৩০-৪০ শতাংশ দ্বারা আবাসন ব্যয় নির্বাহপূর্বক অবশিষ্ট আয় অন্যান্য গৃহস্থালির খাতে ব্যয় করা যায় তখন সেটিকে অভভড়ৎফধনষব ঐড়ঁংরহম বা মূল্য সাশ্রয়ী আবাসন ব্যবস্থা বলা যায়। সে ক্ষেত্রে ৬০০-৭০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট তৈরি করে যার মূল্য বিশেষ ভর্তুকি ব্যবস্থায় ১৫-২০ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় সে ক্ষেত্রে ১৫-২০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তি ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থায়ী আবাসন সংস্থান করা সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছোট আয়তনের এসব ফ্ল্যাটের জন্য ক্রেতার চাহিদা খুবই কম। বরং ভাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে এসব ফ্ল্যাটের চাহিদা থাকলেও স্থায়ীভাবে ক্রয় করার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষজনও কমপক্ষে ১০০০-১২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট চায়। কারণ আর কিছু নয়- বড় ফ্ল্যাটে থাকার বিলাস যা আমাদের দেশের একটি সাধারণ কালচার। যদিও দেখা যায়, এসব ফ্ল্যাটের ছোট আয়তনের কক্ষে ভালো মতোই বসবাস করা যায়।

স্বল্পতা বা সংকট দূরীকরণে উপরে উলিস্নখিত সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় এক ধাক্কায় পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এজন্য একটি ধারাবাহিক গণসচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

ছোট পরিসরে স্বল্প ভূমি ব্যবহার করে বসবাসের সংস্কৃতির পরিচর্চা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত ও প্রণোদিত করা সময়ের দাবি। যেভাবে অধিক জনসংখ্যার এ দেশের বাস্তবতার নিরিখে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে, একইভাবে স্বল্প আয়তনের বাসস্থান জনপ্রিয় করা যেতে পারে। এজন্য নিম্নরূপ কিছু প্রস্তাব নীতিনির্ধারণ ও সচেতন নাগরিকদের কাছে উপস্থাপন করে অত্র রচনার ইতি টানছি-

হ গণমাধ্যমে সচেতনতা প্রোগ্রাম প্রচার

হ স্বল্প আয়তনের ফ্ল্যাটে বসবাসের জন্য আর্থিক প্রণোদনা

হ ভূমি ব্যবহারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

ভাড়াবিহীন অব্যবহৃত বাড়ির জন্য আলাদা করারোপ ব্যবস্থা

হ গুরুত্বপূর্ণ লোকেশনে ছোট আয়তনের ফ্ল্যাট নির্মাণে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ

হ স্বল্প আয়তনের ফ্ল্যাটের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান

অধিক হারে কমিউনিটি ও সোশ্যাল সেন্টার তৈরি করা।

প্রলয় কুমার ভট্টাচার্য্য: উপ-মহাব্যবস্থাপক, বিএইচবিএফসি এবং নজরুল পারভেজ, উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67210 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1