শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

নতুনধারা
  ২১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

ভূমিকা: প্রতিবার আমি যখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা ফেলি আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়- আমার পায়ের নিচের এই স্বাধীন ভূখন্ড কে এনে দিলেন? পৃথিবীর সব কালে সব দেশে স্বাধীনতার জন্য মানুষকে রক্ত ঝরাতে দেখা যায়। সইতে হয় ভয়াবহ নির্যাতন। স্বাধীনতা তাই বরাবরই অমূল্য, দুর্লভ। আমরাও স্বাধীন ছিলাম না। আমাদের জন্য এই অমূল্য স্বাধীনতা এনে দেয়ার দায়িত্ব যিনি নির্ভয়ে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি আর যাই হোক কোনো সাধারণ মানুষ নন। প্রত্যেক সচেতন বিবেকবান মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন, একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন, সেদিন কার কথায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি একাট্টা হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য? স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের? কে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল? হঠাৎ করে আসা কোনো ভিনদেশী নয়। মাটি আর মানুষের জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করা একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি আর কেউ নন। তিনি আমাদের জাতির জনক। তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জন্ম ও বংশ-পরিচয়: উপমহাদেশে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা সূফীদের মধ্যে যেসব সূফীরা চট্টগ্রামে এসেছিলেন তাদের একজন ছিলেন শেখ আওয়াল। ধারণা করা হয়, তিনি প্রখ্যাত সূফী দরবেশ বায়েজিদ বোস্তামীর অনুগামী ছিলেন। এই শেখ আওয়ালের পুত্র হলেন শেখ মুজিবের অষ্টম পুরুষ। শেখ আওয়ালের পুত্র শেখ জহির উদ্দিন কলকাতার নিকটবর্তী কান্দাপাড়ায় থেকে পাটের আড়তদারী ব্যবসা পরিচালনা করতেন। শেখ জহির উদ্দিনের পুত্র শেখ জান মাহমুদ। শেখ জান মাহমুদের পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন।

শেখ বোরহান উদ্দিন তার ব্যবসার কাজে মধুমতী নদীর পথ দিয়ে গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা ও ঘোপের ডাঙ্গায় আসেন। আর এখানেই তিনি টুঙ্গিপাড়ার কাজী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন। গোপালগঞ্জে শেখ পরিবারের বসবাস মূলত এখান থেকেই শুরু। শেখ বোরহানের তিন পুত্রের মধ্যে বড় পুত্র শেখ একরাম হোসেন। এই শেখ একরাম হোসেনের তিন পুত্রের মধ্যে মেজো পুত্রের নাম শেখ আব্দুল হামিদ। এই শেখ আব্দুল হামিদই শেখ মুজিবের পিতামহ। তার পিতা ছিলেন শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা মোসাম্মৎ সায়রা বেগম যিনি সম্পর্কে শেখ লুৎফর রহমানের চাচাত বোন। শেখ মুজিব তার তৃতীয় সন্তান এবং পুত্রসন্তান হিসেবে প্রথম। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সায়রা বেগমের ঘরে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করে বাঙালি জাতিকে ধন্য করেন। সেদিন কি কেউ বুঝতে পেরেছিল যে এই সন্তানই কালে কালে একদিন বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা হবেন। হবেন জাতির জনক। কিন্তু তার শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার মধ্যদিয়ে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল।

সংক্ষিপ্ত আলোচনায় শেখ মুজিবের বর্ণাঢ্য জীবন: ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল সেই শিশুটিই একদিন তার প্রশস্ত কাঁধে পুরো বাঙালি জাতির বোঝা তুলে নিয়েছিল। ১৯২৯ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন গোপলগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। ১৯৩১ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে। ১৯৩৪ সালে চোখের অপারেশনের কারণে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে আবার স্কুলজীবনে ফিরে আসেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি বেগম ফাজিলাতুন্নেসার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। ১৯৪৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ইসলামিয়া কলেজ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের। এই সময় তিনি তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনের পক্ষে কাজ করেন কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে কায়েদ-এ-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং খাজা নাজিম উদ্দীন উর্দুকে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ১৯৪৯ সালের ২৬ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার উর্দুকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে তিনি জেলখানায় বসে ১৩ দিনের আমরণ অনশন পালন করেন। ভাষার দাবিতে ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ তিনি খালেক নেওয়াজ, শামসুল হক প্রমুখসহ গ্রেপ্তার হন এবং কিছুদিন পর মুক্তি পান। এই বছরই তিনি ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন। ১৯৫১ সালে ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন। ১৯৫৩ সালে ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অধীনে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের কৃষিমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল ঘোষণা করলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে সদস্য হন এবং অধিবেশনে পূর্ব বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান কথাটি ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন।

১৯৫৭ সালে তিনি উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি স্বাধীন বাংলা বিপস্নবী পরিষদ গঠন করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরোধিতা করার কারণে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ সালে তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃতু্য হলে তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে তিনি আইয়ুব খানের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং ফতিমা জিন্নাহকে সমর্থন দান করেন। ১৯৬৪ সালের ১৫ হতে ২১ সেপ্টেম্বর তিনি করাচিতে অবস্থান করেন। কথিত আছে এই সময় তিনি লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেনের আমন্ত্রণে বিএলএফের গোপন মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং এর জন্যই ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হলে পরবর্তীতে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

১৯৬৬ সালে তিনি লাহোরে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন। ১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নথিভুক্ত করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেরুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেয়া হলে ২২ ফেব্রম্নয়ারি তিনি সব সঙ্গী-সাথীসহ মুক্তিলাভ করেন। এ সময় দশ লাখ লোকের এক সমাবেশে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়।

১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে তিনি উপকূলবর্তী এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার দল পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচনেও তার দল ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর, সংবিধান প্রণয়ন ও স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি সংক্রান্ত মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ভেঙে গেলে তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দান করেন এবং নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃক রাজনীতির মহাকবি হিসেবে আখ্যায়িত হন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে ঐতিহাসিক ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবার শপথ নেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবার শপথ নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে নিহত হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্বে বহাল ছিলেন।

শেখ মুজিবের জীবন পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূলত তার জীবনটাই বাঙালি জাতির ভাগ্য রচনার এক সুদীর্ঘ ফিরিস্তি। তিনি যে বাঙালির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তার প্রমাণ তার জীবনের প্রতিটি ঘটনা পরম্পরার মধ্যেই সুস্পষ্ট। তিনি ছিলেন বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। মুজিব মূলত একটি জাতির মানচিত্র। মুজিব মূলত একটি জাতির পতাকা। বাংলাদেশ নামটিও মূলত তারই দেয়া। তিনি নিজে তার সব চিন্তা, চেতনা, স্বপ্ন ও দর্শনে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে ধারণ করেছিলেন। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সজাগ। মুজিব তাই চেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। মুজিব তাই একটি জ্বলন্ত সূর্যের মতোই দীপ্যমান।

বাঙালি জাতির আজকের যে অবস্থান, তার যে উন্মেষ ঘটেছিল সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে, তখনও তিনি ছিলেন পূর্ণ সোচ্চার। তারপর ১৯৭১ সালে বাঙালির রক্তস্নাত স্বাধীনতা সংগ্রামে তার নেতৃত্বেই ৯ মাসের যুদ্ধ জয় সম্ভব হয়েছিল। মুজিব মূলত মনে-প্রাণে ছিলেন খাঁটি বাঙালি। নির্লোভ, নিরহঙ্কার মানুষটির সব জীবনজুড়ে ছিল এই বঞ্চিত জাতির ভাগ্যান্বেষণের অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তিনি নিজের জন্য কিছু চেয়েছিলেন এমন কোনো কথা ইতিহাসের কোথাও লেখা নাই। জীবনে কোনোদিন নিজের জীবনের পরোয়া করেন নাই। তার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে কারান্তরালে। তবুও তিনি ছিলেন অকুতোভয়।

দীর্ঘদেহী এই মানুষটি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি ছিলেন একজন সুবক্তা। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণেই পেশ করা সম্ভব হয়েছিল ৬ দফার দাবি, যা পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। মুজিব মূলত জানতেন এই ৬ দফাই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রভাবক। ইতিহাস তাকে অমর করেছে। কার সাধ্য তাকে মুছে ফেলে। তিনিই বঙ্গবন্ধু। তিনিই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনিই আমাদের জাতির জনক। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। সবার প্রিয় শেখ সাহেব।

উপসংহার: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে মেনে নিতে কিছু কিছু লোককে ইতস্তত করতে দেখা যায়। এর কোনো যুক্তিও তাদের কাছে নেই। আসলে একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ দেশের জন্য ভাবেন। মানুষের জন্য ভাবেন। আর সে জন্যই আমরা দেখতে পাই, পাকিস্তান আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিককে পরে পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাঙালি জাতির স্বার্থরক্ষার তাগিদে একটা জীবন পার করতে হয় পাকিস্তানি ঘৃণ্য মানসিকতার বিরোধিতার মধ্যদিয়ে। আর তার ফলাফলই হলো আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

ওমর খালেদ রুমি

কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<59134 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1