শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অটিজম মোকাবিলায় বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ

আমাদের সমাজের অনেকেই আছেন যারা প্রতিবন্ধীদের অবহেলা করেন। তাদের জানা উচিত প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ দায় থাকা উচিত। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে। বিশেষ করে যারা প্রতিবন্ধী নয় তাদেরও। প্রতিবন্ধীদেরও সমান সুযোগ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগামী। কিন্তু তারপরও প্রতিবন্ধীরা সামাজিকভাবে এখনো পুরোপুরি অধিকারপ্রাপ্ত হয়নি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই এ জন্য দায়ী।
অধ্যক্ষ সুমনা ইয়াসমিন
  ১৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি রাষ্ট্র তার মানবিক হাত বাড়িয়েছে। সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশে কর্মরত উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক এনজিও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহ প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষিত করছে আগের চেয়ে বেশি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩-তে অটিজম, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাকপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতাসহ ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিতার এসব ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে অটিজম শিশুদের কল্যাণে ইতোমধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় এবং ৩৯টি উপজেলায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে অটিজম কর্নার চালু করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে চালু করা হয়েছে 'প্রয়াস' নামের প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। প্রতিটি সেনানিবাসে এ বিদ্যালয়ের শাখা স্থাপনেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধীরাও অন্য সবার মতো মানুষ। দেশের অন্য সব নাগরিকের মতো তাদের জন্যও সব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। প্রতিবন্ধীদের অসহায় অবস্থার অবসানে বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় আয়োজন করা হয়েছিল বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বাংলাদেশের অটিজমবিষয়ক জাতীয় পরামর্শ কমিটির চেয়ারপারসন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের এ সম্পর্কিত মানবিক কার্যক্রম জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে অভিনন্দন জানাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধীদের নিয়ে দেশ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন। তিনি এমন সামাজিক দায়বদ্ধতার গুরুদায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন- যা সমাজের অধিকাংশ মানুষকে করতে দেখা যায় না। সমাজে অনেক দানশীল, সমাজ সেবক, পরোপকারী, জনহিতকর ব্যক্তি রয়েছেন যারা মানুষের সেবাকে ব্রত মনে করেন। তারপরও তাদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, অন্ধ এবং জন্মগতভাবে অস্বাভাবিক শিশুদের নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় না। বরং বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের সমাজের 'বোঝা' এবং 'বিরক্তকর' মনে করে এড়িয়ে চলেন; বাঁকা দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সেই কাজটি বেছে নিয়েছেন। পুতুল স্থায়ীভাবে বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকেও দেশের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের সেবায় যেভাবে কাজ করেছেন তা আমাদের জন্য গর্বের, অহংকারের এবং গৌরবের। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ক্ষমতাকে 'ভোগ-বিলাসের' পর্যায়ে না নিয়ে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সমাজে অটিজমকে এক সময় পাপ-অভিশাপ ভাবা হতো। অটিস্টিক শিশুদের সমাজের বোঝা মনে করা হতো। সমাজসেবায় কিছু সংগঠন কাজ করলেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা পরিবারের কাছেও ছিল অবহেলিত। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অটিজম মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। দক্ষ-অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিতদের তত্ত্বাবধান, বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচির ব্যবস্থা, খেলাধুলা, শরীর চর্চা, বইপড়া, প্রত্যেক প্রতিবন্ধী শিশুর বিশেষ চাহিদা পূরণ, বিকলাঙ্গ শিশুদের আর্থিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং মানসিক-শারীরিক অটিস্টিক শিশুদের উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের অবজ্ঞা না করা এবং প্রতিবন্ধী হিসেবে না দেখার আহ্বান জানানো সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০০৮ সালে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে বাংলাদেশে এবং পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় তিনি কাজ করেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে 'হু অ্যাক্সিলেন্স' অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, সামাজিক মর্যাদা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সহায়তা দিতে অবকাঠামো গড়ে তোলে। প্রধানমন্ত্রীর কন্যার দেখাদেখি দেশের অনেক বিত্তবান এবং পরোপকারী মানুষ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন; অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন এবং সেবা করছেন। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, জনশক্তিতে পরিণত হচ্ছে।

প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি ও তাদের জন্য অবকাঠামোগত পরিবেশ নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুরা যাতে সাধারণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিবিড় শিক্ষাগ্রহণের জন্য প্রত্যেক প্রতিবন্ধীকে ভাতা দেয়া হচ্ছে। উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে অটিজম কর্নার। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। নীতিমালার আওতায় ৫০টি বিদ্যালয়ে প্রায় ১০ হাজার প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছে।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিশেষ বা একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম, অটিস্টিকদের বিনামূল্যে বিভিন্ন সেবা প্রদান, অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম প্রতিষ্ঠা, প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপিসহ অন্য চিকিৎসা প্রদানের জন্য ৬৪ জেলায় ১০৩ প্রতিবন্ধী সেবা কেন্দ্র স্থাপন, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে ঘরে বসে প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সেবাগ্রহণে সরকারের পদক্ষেপসহ সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রাখা প্রতিবন্ধীদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের বড় উপহার।

আমাদের সমাজের অনেকেই আছেন যারা প্রতিবন্ধীদের অবহেলা করেন। তাদের জানা উচিত প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ দায় থাকা উচিত। প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে আমাদের সবাইকে। বিশেষ করে যারা প্রতিবন্ধী নয় তাদেরও। প্রতিবন্ধীদেরও সমান সুযোগ নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগামী। কিন্তু তারপরও প্রতিবন্ধীরা সামাজিকভাবে এখনো পুরোপুরি অধিকারপ্রাপ্ত হয়নি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই এ জন্য দায়ী।

অধ্যক্ষ সুমনা ইয়াসমিন: অধ্যক্ষ, উত্তরা ইউনাইটেড কলেজ ও সভাপতি স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ ঢাকা মহানগর উত্তর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58764 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1