'অমিত সম্ভাবনাময় দেশ বাংলাদেশ', 'বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল'- দেশ সম্পর্কে যখন এমন প্রশংসাবাক্য শোনা যায়, কিংবা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জরিপে যখন বাংলাদেশের নানান অগ্রগতি এবং আশাবাদের পূর্বভাস জানানো হয়, তখন সে খবরগুলো দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে হয়ে ওঠে অত্যন্ত আনন্দের। আবার যখন, দেশের কোনো নেতিবাচক খবর আসে- তখন বিষয়টি নিয়ে মর্মাহত না হয়ে গত্যন্তর থাকে না। দেশের সম্ভাবনা এবং আশা জাগানিয়া খবরের ভিড়ে সম্প্রতি একটি নেতিবাচক খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি দাতব্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা কারখানার অভ্যন্তরে যৌন সহিংসতা, হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। গত সপ্তাহে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে প্রকাশিত বাংলাদেশের ২শ পোশাক কারখানার ওপর অ্যাকশন এইড ইউকে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপে এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান একটি খাত। ফলে সেই খাত যাদের শ্রম-ঘামে দাঁড়িয়ে আছে, সেই শ্রমিকরা যখন কারখানার ভেতরেই নির্যাতিত-নিপীড়িত হচ্ছেন- এমন একটি তথ্য উঠে আসা তখন বিষয়টি উদ্বেগের বলেই প্রতীয়মান হয়।
জানা গেছে, অ্যাকশন এইড ইউকে'র তত্ত্বাবধানে পোশাক শ্রমিকদের সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পে কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি আচরণ খতিয়ে দেখার অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকার ২০০টি পোশাক কারখানায় জরিপ চালিয়ে উদ্বেগজনক ওই তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। কারখানার উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারায় নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। জরিপে অংশ নেয়া অনেকেই সহকর্মীকে কারাখানার ফ্লোরে যৌন হয়রানির শিকার হতে দেখেছেন- এমন তথ্যও উঠে এসেছে। এ ছাড়া অনেক শ্রমিক গর্ভবতী হওয়ার কারণেও ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া নানান অভিযোগে নারী শ্রমিকদের শরীরের নানান স্থানে হাত দেয়া, গালগাল শোনা এবং ঊর্ধ্বতনদের কাছে এসব আপত্তিকর আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোনো ফল হয় না। উপরন্তু ওই কর্মকর্তাও অভিযোগকারীকে গালিগালাজ করার পাশাপাশি ছাঁটাইয়ের হুমকি দেন। দেশের প্রধান আয়ের একটি খাতের অভ্যন্তরীণ এসব বিষয় শুধু অমানবিকই নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেও বিবেচনা করা সঙ্গত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সংস্থাটির উপপরিচালকের মতে, বর্তমানে বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে যৌন সহিংসতা ও হয়রানি রোধে আন্তর্জাতিক কোনো আইন নেই। বিশ্বে যেখানে প্রতি তিনজন নারীর একজন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন সেখানে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগও পর্যাপ্ত নয়। বস্তুত, বিভিন্ন দেশের সরকারের আইনি উদ্যোগের অভাবই বলে দিচ্ছে, আমরা নারীদের জন্য ঠিক কতটা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করছি। সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টরের মতে, অনেক পোশাক উৎপাদনকারী ভবনের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের সময়। আমরা যে পোশাক পরছি তা তৈরির কাজে নিয়োজিত অনেক নারীর কাছেই লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এখনও প্রাত্যহিক বাস্তবতা বলেও তিনি মনে করেন। আমরা বলতে চাই, সরকার যেহেতু নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কঠোর অবস্থানে আছে, আর পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে তখন বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অগ্রধিকার ভিত্তিতে আমলে নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য।
বলাই বাহুল্য, সারা বিশ্বেই নারীরা যৌন হয়রানির মতো গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে আন্দোলনও দিন দিন জোরদার হচ্ছে। জানা গেছে, কর্মস্থলে যৌন হয়রানি নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) একটি কনভেনশন গ্রহণ করতে যাচ্ছে। যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে হয়রানির ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে এবং এতে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং প্রাসঙ্গিকতা থাকা অত্যন্ত জরুরি বলে বিজিএমইএ সভাপতি যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে করি, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর হওয়া সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্রে নারী নিগ্রহের ঘটনা রোধ হতে পারে। নির্যাতন রোধে আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি জরিপকারী সংস্থাটির পরামর্শ আমলে নিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত করবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।