বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদক ও মূল্য নির্ধারণ

সামন্ত যুগের দাসপ্রথার মতো এখনো বাংলাদেশে কৃষকদের প্রতি আচরণ করা হয়। কৃষকের ধানের মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। এই মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কৃষকের মতামত আছে কতটা সেই নিরিখে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিন্দু পরিমাণ নেই। যিনি উৎপাদনকারী তার মতামত না নিয়ে কি কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা যায়?
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ২১ মে ২০১৯, ০০:০০

পণ্য উৎপাদনকারী তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন। সারা দুনিয়াজুড়েই শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে এই নিয়মটাই দেখা যায়। সেবা খাতেও সেবার মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ। মোবাইল ফোন কোম্পানি, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কোচিং সেন্টারসহ সেবা প্রদানকারী তাদের মোট ব্যয়ের ওপর লাভ রেখে সেবা মূল্য নির্ধারণ করেন। উৎপাদক সব সময় তার উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্য নির্ধারণ করেন তার উৎপাদন খরচের সঙ্গে মিল রেখে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যখন বাজারমূল্য নির্ধারণ করেন তখন প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে প্রদেয় রাজস্ব (ভ্যাট, ট্যাক্স) তার উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ করে ইউনিটপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অবাধ বিচরণ। এই অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রেও তারা তাদের বিক্রিত পণ্যগুলোর মূল্য নির্ধারণ করাটা উৎপাদন খরচের নিরীক্ষে নির্ধারণ করে, কোনো বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন না। সুতরাং সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ তাদের নিজস্ব নিয়মানুসারে করে থাকে, এ ক্ষেত্রে সরকারের তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। থাকলেও সরকার কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ হিসাব করেই পণ্য মূল্য নির্ধারণ করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সারা দুনিয়ায় প্রত্যেক উৎপাদকই তার উৎপাদিত পণ্য মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা বা অধিকার থাকে। পৃথিবীর কোনো পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কমে মূল্য নির্ধারণ করে কোনো পণ্যই বিক্রি করে না। সারা দুনিয়ায় না থাকলেও বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার কারও কোনো ক্ষমতা নেই। প্রতি বছরই দেখা যায়, এ দেশের কৃষক তাদের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করে থাকেন। বাংলাদেশের কৃষকরা কেন তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা বা অধিকার নাই? স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এসে আজকে এই প্রশ্ন করতে হয় কৃষকদের। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল কৃষকের নায্যতা পাওয়ার বিষয়টি কেন্দ্র করে। বিশেষ করে তেভাগা, প্রজাস্বত্ব আইনসহ নানা কৃষক আন্দোলনের পথ বেয়ে এ দেশের মুক্তির সংগ্রাম। বাংলাদেশের মধ্য বিত্তবান কৃষকের ঘরের সন্তানরা পাকিস্তান শাসনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে গড়ে তুলেছিল এ দেশের ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র ও কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের যুগপদ আন্দোলনেই মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা। দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে থাকে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ তো করতে পারছেই না উপরন্ত তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্যটাও পায় না। ফলে দেখা যায় একজন কৃষক প্রচলিত মজুরি ব্যবস্থায় যে মজুরি কাঠামো রয়েছে তা সমান মজুরিটুকু তারা পায় না। তাই এ দেশে কৃষকের শ্রমের ন্যায্য মজুরি নাই স্বাধীনতার চার যুগ পার হওয়ার পরও। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ অথচ সংখ্যারিষ্ঠ মানুষই তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। কৃষকের পণ্য উৎপাদনের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় কৃষকের অবস্থা কতটা নাজুক। এই সমীক্ষা বরেন্দ্র অঞ্চলের। বরেন্দ্র অঞ্চলের দেড় বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনের একটি খরচের হিসাব নিম্নে দেয়া হলো, দেড় বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে ডিএফপি সার দিতে হয় ৫০ কেজি, প্রতি কেজি সার ৩০ টাকা ধরে মোট ডিএফপি সার বাবদ খরচ হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। দেড় বিঘা জমিতে ইউরিয়া লাগবে ৫০ কেজি, প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ১৬ টাকা করে হিসাব করলে দেখা যায় ইউরিয়া বাবদ খরচ হবে ৮০০ টাকা। দেড় বিঘা জমিতে পটাশ সার লাগবে ৫০ কেজি, প্রতি কেজি ২৬ টাকা হিসাবে পটাশ সারবাবদ খরচ পড়ে ১ হাজার ৩০০ টাকা। দেড় বিঘা জমির ধান ক্ষেতে বালাইনাশক স্প্রে করতে হয় তিন বার, প্রতিবার স্প্রে করার জন্য লাগে ৫০০ টাকা তিন বার স্প্রে করা বাবদ খরচ পড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা। আগাছা পরিষ্কার করার জন্য মেশিন খরচ ২০০ টাকা, পানি সেচ ৩ হাজার টাকা, মোট ৬ জন কৃষি শ্রমিকের শ্রমের মূল্যবাবদ প্রতি জনের মজুরি ৩০০ টাকা করে হিসাব করলে মোট মজুরি লাগে ১ হাজার ৮০০ টাকা। চাষের সময় ট্রাক্টর খরচ ১ হাজার ৫০০ টাকা, নিড়ানো মেশিনে তিনবার প্রতিবার ৩০০ টাকা করে মোট ৯০০ টাকা। মাড়াইবাবদ খরচ পড়ে ২ হাজার ১০০ টাকা তা ছাড়া অন্যান্য লেবার বাবদ ৫০০ টাকা, এই হিসাবে দেড় বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ পড়ে মোট ১৫ হাজার ১০০ টাকা। দেড় বিঘা জমিতে মোট ধান উৎপাদন হয় ২২-২৩ মণ। একজন প্রান্তিক কৃষক মোট ছয় বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে পারেন। এই ধান উৎপাদনের জন্য তার সময় ব্যয় হয় প্রায় চার থেকে ছয় মাস, তবে চার মাস ধরে হিসাব করা হলো। এই চার মাসে সরকারের একজন নিম্ন বেতনভোগী কর্মীর মজুরি হিসাবে ওই প্রাপ্তিক কৃষকের চার মাসের মজুরি হওয়ার কথা ৬৪ হাজার টাকা। তাহলে দেখা যায়, ছয় বিঘা জমির ধান উৎপাদনের খরচ ৬০ হাজার ৪০০ টাকা আর এর সঙ্গে কৃষকের মজুরি যোগ করলে মোট ছয় বিঘা জমির ধান উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৪ টাকা। ছয় বিঘা জমিতে মোট ধান উৎপাদন হবে ৮৮ থেকে ৯২ মণ। প্রতি মণে কৃষকের লাভ ১০০ টাকা করে হিসাব করলে দেখা যায়, এক মণ ধানের দাম ১ হাজার ৫ শত টাকা থেকে ১ হাজার ৭ টাকা হওয়া দরকার। অথচ এখন গ্রামের হাটে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬২০ টাকা করে। অন্যদিকে সরকারের বেঁধে দেয়া দামেও কৃষক ধান বিক্রি করতে পারছেন না। সরকার বলছেন ধান সংরক্ষণ করার মতো স্থান সরকারের নেই। সরকারি সব গুদাম ধানে ভর্তি। ধান মজুদ রাখার মতো গুদাম সরকারের আর অবশিষ্ট বা খালি নেই। তাই সরকার কৃষকের ধান কিনতে পারছেন না। যে সমস্ত শিল্প মালিকরা পণ্যের মূল্য নিজেরা নির্ধারণ করে মোটা অংকের টাকা লাভ করছেন তারাই শিল্পপতি, আর এই শিল্পপতিরাই ঋণখেলাপি। বাংলাদেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের টাকার পরিমাণ প্রায় লাখ কোটি টাকা। এই লাখ কোটি টাকার ঋণখেলাপিদের জন্য সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করছেন। খেলাপিদের জন্য সরকারের বিশেষ সুযোগ দেয়ায় তারা কোটি কোটি টাকার সুদ রেয়াত পেয়ে গেল অথচ কৃষকের ধানের মূল্যটি উৎপাদন খরচের নিরিখে নির্ধারণ করার জন্য যদি সরকার তার পক্ষ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা দিতেন তাহলে দেশের কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হতো। সম্ভাব্য ধারণানুযায়ী হিসাব করলে দেখা যাবে, খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দেয়ায় যে পরিমাণ অর্থ সরকারকে হারাতে হচ্ছে তার প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ টাকা ধানের মূল্যের ওপর ভর্তুকি দিলে কৃষকরা ধানের নায্য মূল্যটা পেয়ে যেত। একজন কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না, তার মূল কারণ এ দেশের বাজার ব্যবস্থা এবং সরকার নিয়ন্ত্রণে কৃষকের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অথচ এই গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের প্রতিফলন নেই। কারণ এ দেশে যথাযথভাবে গণতন্ত্র অনুশীলন করা হয় না। যথার্থ গণতন্ত্র যদি এ দেশে অনুশীলিত হতো তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সংখ্যালঘু মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।

সামন্ত যুগের দাসপ্রথার মতো এখনো বাংলাদেশে কৃষকদের প্রতি আচরণ করা হয়। কৃষকের ধানের মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। এই মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কৃষকের মতামত আছে কতটা সেই নিরিখে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিন্দু পরিমাণ নেই। যিনি উৎপাদনকারী তার মতামত না নিয়ে কি কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা যায়?

পৃথিবীর কোথাও কি এমন নিয়ম আছে যিনি উৎপাদন করে তার হিসাব ছাড়া উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্র্ধারণ করা হয়। এমন প্রক্রিয়া দুনিয়ার কোনো উৎপাদন ব্যবস্থায় নেই। তবে সব অসম্ভব সম্ভব করার দেশ বাংলাদেশ। এখানে কৃষকের উৎপাদন খরচ হিসাব না করেই ধানের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ফলে কৃষকরা ধানের নায্য মূল্য থেকে প্রতি বছরই বঞ্চিত হয়। তাই ভবিষ্যতে কৃষকের সঙ্গে তার উৎপাদন খরচ হিসাব করে সরকার ধানের মূল্য নির্ধারণ করবেন এটাই প্রকৃত কৃষকের প্রত্যাশা।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50460 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1