বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের ওপর মলিন দাগ

বাংলাদেশ নারী অবমাননা এতদিন স্থলে সীমাবদ্ধ ছিল, বর্তমানে বাসের ভেতরেও শুরু হয়েছে। কয়েক বছর আগে ভারতের নয়াদিলিস্নতে বাসে এক তরুণীর শ্লীলতাহানির পর তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা প্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশেও সমশ্রেণির ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। প্রথমে নারীর সবকিছু লুণ্ঠন করে পরে তাকে হত্যা করা হয়। বর্তমান নারীদের কতকগুলো বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, কোনো বাসে যাত্রী না দেখলে বাসে না ওঠা দ্বিতীয়, যথাসম্ভব রাস্তায় একা একা না চলা তৃতীয়ত, সম্ভব হলে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া রাতে বাসে গমনাগমন না করা চতুর্থত, অপরিচিতি কোনো লোককে বিশ্বাস না করা।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ২০ মে ২০১৯, ০০:০০

বিবর্ণ কাগজের নোট

সাধারণভাবে সব মানুষ শুধু সুস্থ নয়, তার সঙ্গে পরিচ্ছন্নও থাকতে চায়। পোশাক থেকে শুরু করে কাজকর্ম সব ক্ষেত্রেই এই মানসিকতার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ধর্মেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। সেখানেও বলা হয়েছে: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অংশ। অথচ বাংলাদেশে অহরহ এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। বাসে বা গাড়িতে চালকদের ধূমপান নিষেধ, অথচ প্রায়ই ঢাকার বুকেই লক্ষ্য করা যায় যে, চলন্ত বাসে ড্রাইভার মুখে জ্বলন্ত সিগারেট রেখে গাড়ি চালাচ্ছে। এই আচরণ নিয়মপরিপন্থি ও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও আজও তা বন্ধ হয়নি। বাসের ড্রাইভারের সিগারেটের ধোঁয়া যাত্রীদের অসুবিধে সৃষ্টি করলেও প্রতিবাদ জানানোর উপায় নেই। শুধু তাই নয়, সিগারেট শেষ হলে প্রত্যেক ড্রাইভার সিগারেটের শেষ অংশ রাস্তায় ফেলে দেয়া প্রথমত ধূমপান, দ্বিতীয় রাস্তায় সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ফেলা- দুটোই সমান অপরাধ এবং তা জেনেশুনেও ড্রাইভাররা তার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। এখানে প্রশ্ন উঠলেও তার উত্তর কঠিন নয়। প্রথমত, ব্যক্তি মানুষের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা নেই, দ্বিতীয়ত, আইন প্রয়োগকারীদের দৃষ্টি দেয়ার প্রবণতা অনুপস্থিত। দ্বিতীয় দিকের চেয়ে প্রথম দিকটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আইন থাকা সত্ত্বেও আইন অবজ্ঞা করার প্রবণতা মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচিত। দেশের মানুষ প্রচলিত আইন মানার মানসিকতা নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করলে অনেক অপরাধ নিজে নিজেই বিলুপ্ত হতো। যেমন, প্রতিবেশী ভারতেও প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ এবং এই আইন সর্বসাধারণ জনসাধারণ পালন করে থাকে এটা তাদের নৈকি দায়িত্ব বলে। রাস্তায় মানুষ সিগারেট কিনে পকেটে রেখে দেয় ধূমপান করে না। ভারতে রাস্তার বাস বাসস্ট্যান্ড ছাড়া অন্য জায়গায় থেমে যাত্রীদের ওঠানামা করতে দেয় না। এই নিয়ম মানাই জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা আনে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার কথা ছেড়ে দিয়ে শ্রীলংকা, মিয়ানমার, নেপালের মতো দেশেও রাস্তায় একটুকরো কাগজ পর্যন্ত ফেলে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মতো আগের তিনটে দেশ (+ সিঙ্গাপুর) আর পরের তিনটে দেশের রাস্তায় কোথাও দেয়ালের গায়ে কোনো পোস্টার লাগাতে দেখা যায় না, বা রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর কোনো ব্যানার চোখে পড়ে না। মালয়েশিয়া প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছে যে, এখানে কেউ মাদকদ্রব্য (হেরোইন বা এজাতীয়) আনলে তার শাস্তি মৃতু্যদন্ড। এই কঠিন দন্ড আছে বলেই এখানে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করতে পারে না আর বাংলাদেশের সর্বত্র মাদকদ্রব্য খাদ্যদ্রব্যের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ, কর্তৃপক্ষ সব জানলেও এর প্রতিকার নেই। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা আনা কী প্রতিরোধ করা যায় না? ভারত থেকে ফেনসিডিল আনা কী বন্ধ করা সম্ভব নয়?

এবার প্রকৃত প্রসঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করা যায়। পৃথিবীর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো নোংরা, জোড়াতালি দেয়া ও নোটের ওপর বিভিন্ন ধরনের লেখা কখনই চোখে পড়ে না। কোনো কোনো নোটের ওপর এমন বিশ্রিভাবে কোনো কিছু লেখা হয় তখন আর সেদিকে তাকানো যায় না। আর এও জরাজীর্ণ ময়লা নোট যে ওয়ালেটের মধ্যে রাখতেও দ্বিধায় ভুগতে হয়। অথচ মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে ডলার, পাউন্ড, ইউরো বা অন্য কোনো দেশের কারেন্সি কিনতে গেলে কখনো একটা ছোট দাগও চোখে পড়বে না। ভারত বা নেপালের দু-একটা নোট সামান্য পুরনো হলেও বাংলাদেশের মতো এমন দৃষ্টিকটু নয়। এ ক্ষেত্রে আরও একটা দিকের উলেস্নখ করা যায়। বাংলাদেশে পাঁচশ বা এক হাজার মূল্যমানের নোট একশটা নেয়ার পর তার মধ্যে নোংরা ও ছেঁড়া নোটও চোখে পড়ে। তা ছাড়া নতুন নোটও স্টেপলার দিয়ে বন্ধ করার কারণে নোটের সৌন্দর্য শুধু নষ্টই হয় না, খুলতেও অনেক সময় লাগে। এর পাশাপাশি একশটা নোটের প্যাকেটের প্রথম ও শেষটা কাগজে যেভাবে আঠা দিয়ে লাগানো হয়, তার ফলে নোট ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ক্ষেত্রে যা করণীয় তা কঠিন নয়। যে কোনো মূল্যমানের একশটা নোট ছোট কাগজ ভাঁজ করে তার মধ্যে রাখলে কারেন্সির সৌন্দর্য নষ্ট হয় না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কাস্টমারদের সতর্ক হতে হবে। অনেক সময় বা কেউ যদি ভেতর থেকে একটা নোট বের করে নেয় তাহলে হাতে নিয়ে বোঝা যায়। এখন যেহেতু সব ব্যাংকেই কাউন্টিং মেশিন আছে সেজন্য ব্যাংক থেকে নতুন নোট মেশিনে গুনে গ্রাহককে দিতে হবে।

জীর্ণ কারেন্সি বা কারেন্সি জীর্ণ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা কঠিন নয়। বিভিন্ন কারণেই এ দেশে কারেন্সির বেহাল অবস্থা হয়। এর পেছনে যে কারণগুলো ক্রিয়াশীল তা হলো- সামাজিক পরিবেশ, অসতর্কতা ও সুন্দর মানসিকতার অভাব। প্রথম পর্যায়ে যাদের হাতে নোট বিবর্ণ হয় তারা হলো ভিক্ষুক, মাছের বাজারের মালিক বা মাছ বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা ও বিক্রেতাদের টাকা রাখার অপরিচ্ছন্ন স্থান। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সামাজিক বোধ বা সচেতনতার একান্ত অভাবের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। চলন্ত গাড়ির সামনে দঁাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে বা না করে রাস্তা পার হওয়া, ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে সুযোগ পেলেই এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া আসা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। অর্থাৎ একশ্রেণির মানুষ মনে করে আমার অধিকার সবার আগে। বাসচালকদের মধ্যেও এই মনোভাব জন্ম নিয়েছে বলে নিয়মের তোয়াক্কা না করে আগে যাওয়ার প্রবণতায় অন্য বাসকে বাঁ পাশে ফেলে অনবরত লেন পরিবর্তন করে ও অন্য গাড়িচালকদের অসুবিধে ঘটিয়ে প্রকাশ্যে নিয়ম ভেঙে চলতে থাকে। এ দেশের কাগজের তৈরি টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা তৈরি হয়নি। নতুন টাকা দিলে অনেকেই আধ ভাঁজ করে পকেটে বা ওয়ালেটে রাখে। যেখানে-সেখানে ফেলে রাখার কারণে টাকায় দাগ লাগে, সেদিকেও কোনো খেয়াল করার প্রয়োজন হয় না। টাকা নিজের কাছে ভালো করে রাখা প্রয়োজন এ চিন্তা অনেকের মধ্যে অনুপস্থিত বলে মন্তব্য করা যায়।

রাস্তায় ভিক্ষে করা যদিও সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচ্য, তবুও এ ক্ষেত্রে ভিখারিদের চিন্তা এর মধ্যে বিবর্তিত হয় না। এর কারণ, ভিক্ষে করে সহজে অর্থ পাওয়া যায়- কাজকর্মের প্রয়োজন হয় না। আর একশ্রেণির ভিখারি পেশা হিসেবেই ভিক্ষে করার পথ বেছে নিয়েছে। এর সঙ্গে আছে দারিদ্র্য ও মানুষের সঙ্গে ছলনা করে অর্থ আদায়। প্রতিদিনই ঢাকার বিভিন্ন পথে মানুষ অসংখ্য ভিখারিকে টাকা দিয়ে থাকেন। তারা টাকা পাওয়ার পরই সেগুলো ভাঁজ করে পকেটের মধ্যে রেখে দেয়। অনেকে হাতের মুঠোর মধ্যেও টাকা ভাঁজ করে রাখে। আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে হাতে রাখা টাকা ক্রমেই মলিন হতে থাকে।

টাকার অবয়বের ওপর সবচেয়ে বেশি আঘাত পড়ে মাছের বাজারে আর কাঁচা বাজারে। মাছ বিক্রেতারা মাছ ওজন করা, মাছের গায়ে হাত দেয়া থেকে শুরু করে বরফ থেকে মাছ বের করা ও বর্তমানে পানিতে রুই-কাতলা জীবন্ত রেখে বিক্রির পর ভেজা হাতে ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ট্যাঙ্কে ভাঁজ করে রাখে। এর সঙ্গে শুধু মাছ বিক্রেতা নয়, যারা মাছ কাটে তাদের প্রসঙ্গও উলেস্নখ করা যায়। মাছ কাটার লোকরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাছ কাটার পর নোংরা হাতেই টাকা নিয়ে পকেটে গুঁজে রাখে।

এ দেশের কাঁচা বাজারে পর পর সবজি বিক্রেতারা বসে এবং অপরিচ্ছন্ন হাতেই ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পকেটে বা টুলের মধ্যে ছোট বাক্সে টাকা ভরে রাখে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে শপিং মার্ট প্রতিষ্ঠার পর টাকার লেনদেনে টাকার ওপর অপরিচ্ছন্ন হাতের প্রভাব অনেকটা কমেছে। শুধু পাশ্চাত্যে নয়, প্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই এখন শপিং মার্ট হওয়ায় ক্যাশিয়ারই শুধু দ্রব্য বিক্রির অর্থ সংগ্রহ ও অন্য কাজ না করায় কারেন্সি অবিকৃতির হাত থেকে খানিকটা নিষ্কৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া এ দেশের বাসের ভাড়া আদায় ও অন্যান্য লেনদেনে টাকার ওপর প্রতিনিয়তই বিরূপ প্রভাব পড়ে।

দেশে বাইরের পরিবেশের পর ব্যাংকে প্রবেশ করলে দেখা যাবে যে, ব্যাংকের ক্যাশিয়ার টাকার লেনদেনের সময় টাকার গায়ে সংখ্যা দিয়ে খরচের পরিমাণ লিখে থাকেন। বলপেনে টাকার ওপর দাগ চিরস্থায়ীই হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের শুধু কঠিন নিষেধাজ্ঞা নয়, ব্যাংকে যারা টাকার ওপর লিখবেন তাদের ক্ষেত্রেও শাস্তির ব্যবস্থা প্রদানের দিক উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন।

উপরিউক্ত বিভিন্ন দিক ছাড়াও টাকার সাদা অংশ বিকৃতির ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকও দায়ী নয়, বলা কঠিন। কারণ বাড়িতে বা দোকানে কিছুসংখ্যক কৌতূহলী মানুষ টাকার গায়ে নিজেদের নাম লিখে বা ছোটখাটো অংকন চর্চা করে থাকে। এই দিকটি প্রতিরোধ করা কঠিন নয়। যারা এ ধরনের বিকৃত ফেসের টাকা অন্যকে দেবে, তখনই তাকে ধরে আইন প্রয়োগকারীর কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

যে কোনো দেশে টাকা বিকৃত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হলে টাকা বিকৃতির হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে। শোভনতা জীবনের একটা বিবেচিত, কিন্তু শোভনতা শুধু পোশাক বা আচরণে নয়, অন্য ক্ষেত্রেও তা কার্যকর করা বা হওয়া প্রয়োজন। এদিকে শুধু সরকারি নিয়ম ও পর্যবেক্ষণ নয়, ব্যক্তি মানুষের সচেতনতার জাগরণও গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রমান্বয়ে বাজার ও ব্যাংক থেকে নোংরা টাকা তুলে নষ্ট করে তার পরিবর্তে নতুন টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করলেও মানুষের হাতে আর পুরনো টাকা থাকবে না এবং যেসব কারণে টাকা বিবর্ণ হয় তার বিরুদ্ধে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বাংলাদেশি মুদ্রাও সবার ওয়ালেট ও ক্যাশ বাক্সে সুন্দরভাবে সাজানো থাকবে।

রাস্তায় ও বিল্ডিংয়ে এত দুর্ঘটনা কেন

বাংলাদেশ এক সময় বিদেশিদের কাছে বন্যা ও সাইক্লোনের দেশ নামে পরিচিত ছিল। তার কারণ, এই দুটো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিদেশিদের সহায়তা প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে উপরিউক্ত দুর্যোগের মধ্যে বন্যার প্রাদুর্ভাব কম হলেও বিদেশিদের সাহায্যের জন্য যাওয়া হয় না। বর্তমান নতুন করে একটা দুর্বিনীত দিক সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে : আবাসিক ভবন ও বাণিজ্যিক ভবনে আগুন। আগুন যে মানুষের কী ভয়াবহ ক্ষতিকারক শত্রম্ন তা ক্যানাডা ও আমেরিকা ভালো করে জানে। এ দুটো দেশে মাঝেমধ্যে বিস্তীর্ণ বনভূমিতে আগুন লাগার পর আগুন নেভাতে অনেক সময় লেগে যায়।

বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলে মাঝেমধ্যে আগুন লাগলেও ঢাকার মতো ভয়াবহ চিত্র আর কোথাও দেখা যায় না। এখানে আগুন লাগা বসতি বাড়িতে অবস্থিত রাসায়নিক গুদাম ঘরে ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে তৈরি অফিস বা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে।

কয়েক বছর আগেও ঢাকার নিমতলীতে একটা বাড়িতে রাসায়নিক গুদাম ও আবাসিক ফ্ল্যাটে আগুন লাগার কারণে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়। রাসায়নিক দ্রব্য পুড়লে অর্থের ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ সম্ভব কিন্তু মানুষের মৃতু্য হলে কোনো ক্ষতিপূরণ অগ্নিদগ্ধ মা, বাবা বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। নিমতলীর ঘটনা মহাজন শ্রেণির মানুষ ও সরকারি কর্তৃপক্ষের চোখ যে খোলেনি ঢাকার চকবাজারে রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর নিরীহ মানুষের অসহায় মৃতু্য তার প্রমাণ। সাধারণভাবেই পুরনো ঢাকার অনেক এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। সাধারণভাবে বসতি বাড়িতে নিচের অংশে গুদাম ঘর তৈরি করে রাসায়নিক দ্রব্য রাখা কোনোদিক থেকেই অনুমোদিত নয়। মানুষ ও রাসায়নিক দ্রব্যের সহাবস্থান সাধারণ মানুষ কল্পনাই করতে পারে না। তবুও তাদের থাকতে হয় ভাড়া বাড়িতে সংকট উত্তরণে, আবাসিক সমস্যার কারণে বা অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার কারণে। অসহায় আহত ও নিহত মানুষের মৃতু্যর কোনো প্রতিকার নেই, কারণ তাদের অর্থ ও আয় সীমিত, দেন-দরবারের ক্ষমতা অনুপস্থিত। অন্যদিকে, মহাজনদের অর্থের ও ক্ষমতার শেষ নেই বলে টাকা ছড়ালেই অন্যে তা লুফে নেয়। মৃতু্য তাদের গায়ে লাগে না, কিন্তু অর্থ তাদের দেহ স্পর্শ করে।

সম্প্রতি ঢাকার বিলাসবহুল এলাকা বনানীতে একটা বিল্ডিংয়ে আগুন লাগার কারণে সেখানে অবস্থিত অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও অফিসকর্মীর মৃতু্য হয়। এই ভবন অনুমোদিত তলের চেয়েও উপরে কয়েকটা তলা নির্মাণ করা হয়। অগ্নি-নির্বাপক কোনো সিলিন্ডারও কোনো অফিস বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ছিল না। অথচ এক সময় এ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অন্যত্র অগ্নি-নির্বাপক সিলিন্ডার থাকত। কাজে আসুক বা না আসুক, এগুলো নিজের স্থান পরিবর্তন করত না। এখন বোধহয় এমন দৃশ্যের দেখা পাওয়া বেশ দুষ্কর। আগুন লাগা বা কোনো দুর্ঘটনা হলে বিভিন্ন বহুতল বিল্ডিংয়ের পেছনে আত্মরক্ষার জন্য সিঁড়ি থাকত। এই ব্যবস্থার কারণে মানুষের প্রাণহানি রোধ সম্ভব।

দু'তিন বছরের মধ্যে ঢাকার গুলশান এক নম্বর মার্কেটে দুবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর কিছু ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ অর্ধ দগ্ধ কিছু জিনিস বের করে ফুটপথে চোখের পানি ফেলে অল্পদামে বিক্রি করেছে শুধু নিজের ও পরিবারের ক্ষুধার্ত পেটের অন্ন সংস্থানের কারণে। গুলশানের পর কারওয়ান বাজারেও অগ্নিকান্ডে অনেক সাধারণ মানুষের দ্রব্য ভস্মীভূত হয়ে যায়। এখানে যারা খোলা জায়গায় পাশাপাশি বসে শাক-সবজি বিক্রি করে বা ছোট ছোট দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করে তারা সাধারণ শ্রেণির ব্যবসায়ী। গুলশান মার্কেট বা এখানে দোকান ও দ্রব্য ভস্মীভূত হলে তাদের আর্থিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে, এসব মার্কেটে স্থায়ী অগ্নি-নির্বাপন ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন। দেশ আর কতবার আগুনে বিবর্ণ হয়ে যাবে?

হায় নারী, তুমি কি আর হাসবে না?

বাংলাদেশ বোধহয় একটা বাষ্পীয় অরণ্যে পরিণত হয়েছে। রাস্তার পলিউশন একশ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের উগ্র করে তুলেছে। তার ফলে নারীদের নির্ভয়ে যাতায়াত ও জীবনযাত্রায় আঘাত করেছে দুর্বিষহ আঘাত আর এই আঘাতের প্রতি ঘৃণা।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিনই নারী নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে শিশু নির্যাতনও মানুষকে চিহ্নিত করে তুলেছে। প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্র খুললেই নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচার ও পরবর্তী পর্যায়ে তাদের অপমৃতু্যও ঘটনার সংবাদ লক্ষ্য করা যায়। এই অপরাধে যেন শান্তি নেই, প্রতিদিনই একাধিক অঞ্চলে সমশ্রেণির ঘটনা ঘটলেও তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনুপস্থিত। আগে গ্রামে নারীরা রাতে বাইরে বেরুলে, দিনের বেলায় দোকানে সওদা করতে গেলে স্কুলে যাতায়াতের পথে বা বাড়িতে একাকী অবস্থায় সুযোগ নিয়ে মানহানি করার সুযোগ পেত তরুণ সম্প্রদায় ও বয়স্করা। সাম্প্রতিককালে নারী অবমনার আরও দুটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। একটা বাসের মধ্যে নারীর শ্লীলতাহানি আর অন্যটা, যা কখনো ভাবা যায়নি, মাদ্রাসা প্রধান বা মাদ্রাসার শিক্ষকদের নারীর সম্ভ্রমহানি ও দেহে আগুন দিয়ে মৃতু্য ঘটানো। মাদ্রাসার ছাত্রীরা নিজেদের আব্রম্ন ঢাকতে বোরকার আশ্রয় নিয়েছে কিন্তু আক্রোশের আগুন তাদের বোরকাও রক্ষা করতে পারেনি। সাহিত্যিক আবুল ফজলের দূরদৃষ্টি ও মুক্তবুদ্ধির চেতনা ছিল বলে জীবনের মধ্যবর্তী সময়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের সমস্থানীয় চরিত্র নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলেন। গল্পের নাম আজ মনে নেই, গল্পটা পড়ার সুযোগ হয়েছিল পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত ও জনাব নিজামী সম্পাদিত 'পূর্ব পাকিস্তানের সেরা (বা শ্রেষ্ঠ) গল্প' সংকলনে। এ কী বিচিত্র দেশ সেলুকাস, বাংলাদেশে দিনের পর দিন নারীদের জীবনে আঘাত আসছে এবং তা বৃদ্ধি পেলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?

বাংলাদেশ নারী অবমাননা এতদিন স্থলে সীমাবদ্ধ ছিল, বর্তমানে বাসের ভেতরেও শুরু হয়েছে। কয়েক বছর আগে ভারতের নয়াদিলিস্নতে বাসে এক তরুণীর শ্লীলতাহানির পর তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা প্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশেও সমশ্রেণির ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। প্রথমে নারীর সবকিছু লুণ্ঠন করে পরে তাকে হত্যা করা হয়। বর্তমান নারীদের কতকগুলো বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, কোনো বাসে যাত্রী না দেখলে বাসে না ওঠা দ্বিতীয়, যথাসম্ভব রাস্তায় একা একা না চলা তৃতীয়ত, সম্ভব হলে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া রাতে বাসে গমনাগমন না করা চতুর্থত, অপরিচিতি কোনো লোককে বিশ্বাস না করা। বেশ কয়েক বছর আগে বগুড়ার ঘটনা বোধ হয় অনেকের মনে আছে। একজন মেয়ে রাতে বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় একজন পুলিশের গাড়ি তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সবকথা শুনে তাকে তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়ে দিতে চায়। মেয়েটা সরল মনে পুলিশের গাড়িতে ওঠার পর তারা তার শ্লীলতাহানি ও হত্যা করে রাস্তার মোড়ে ফেলে দেয়। অবশ্য, এই পুলিশ পরে ধরা পড়ে এবং যে জায়গায় পুলিশ মেয়েটাকে হত্যা করে ফেলে দেয় সে জায়গার

মানুষ সম্মানের অর্ঘ্য ছড়িয়ে দিয়েছিল এই

মেয়েটার উদ্দেশ্যে।

অনেক সময় নারী নির্যাতন ও হত্যার বিচারই হয় না। কারণ, এর নেপথ্যে থাকে প্রভাবশালী মহল। সাধারণ পরিবারের মানুষের ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রতিকারহীন অবস্থায় বসে কাঁদতে হয় তাদের মেয়েদের জন্য, বোনের জন্য বা স্ত্রীর জন্য। এক সময় কুমিলস্নার তনুর ঘটনা সংবাদপত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু তারপর অন্ধকারে সব কিছু আবৃত হয়ে গেছে। নারীদের প্রতি নিষ্ঠুর অত্যাচারের বিচার কী শুধু নিভৃতেই কাঁদবে। পশ্চিমবঙ্গেও কলকাতার পাক স্ট্রিটে একজন অ্যাংলো মেয়ের ওপর যে অবিবেচনা হয়েছিল তা সংবাদপত্রে প্রকাশের পর শেষ পর্যন্ত সরকারও তদন্ত করতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের মানুষের শান্তিতে, নিরাপদে বসবাসের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রণের অভাবেই সমস্যা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি সামাজিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে এখনো ঢাকার রাস্তার পুরনো বাস রং করে রাস্তায় নামানো, বাস চালকদের আগের অনিয়ম, খাদ্যদ্রব্য ভেজাল ও কেমিক্যাল মেশানোর মতো অসংখ্য দিক বন্দ করা সম্ভব হতো। আসলে এ দেশের অনেক লোক পচা রসায়নের মতো হয়ে গেছে বলেই দেশের এ দুরবস্থা।

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<50154 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1