মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিযাির্তত আরও ৩৮ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত গেজেট জারি করেছে সরকার। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৫৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বীরাঙ্গনারা এ স্বীকৃতি পেলেন। আর এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া বীরাঙ্গনার সংখ্যা হলো ২৩১।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিযার্?তিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সম্মান জানান। তার নিদের্শনায় বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনবার্সনের কাজ শুরু হয়। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের পর এ কযর্ক্রম বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পযর্ন্ত মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পর ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেইÑ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক ভয়াবহ অধ্যায় হচ্ছে দুই লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রমহানি। যুদ্ধের সময় যারা মারা গেছেন বা আত্মহত্যা করেছেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যুদ্ধ-পরবতীর্ সময় থেকে এখনো যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবন যে কত দুঃসহ ও অবমাননাকর তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সমাজে অচ্ছ্যুৎ অবস্থা নিয়ে দিন কাটানো থেকে শুরু করে নানারকম অমানবিক পরিস্থিতির সঙ্গে বসবাস করতে হয়েছে বীরাঙ্গনাদের। এই দীঘর্ সময়ে অবহেলা-অনাদরে চিরতরে হারিয়েও গেছেন অনেকেই। অনেকেই বেঁচে থেকেও এমন অন্ধকার তাদের জীবনে নেমে এসেছে, যেখানে বেঁচে থাকার অনুভূতি জখম হয়েছে বার বার। সঙ্গত কারণেই বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি কতটা গুরুত্ব বহন করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা মনে রাখা দরকার যে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম জাতি সারাজীবন মনে রাখবে। কিন্তু নারীর আত্মত্যাগ, সম্ভ্রমহানি আরও বেশি বেদনাবহ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন বয়সী নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটেছে, শিকার হয়েছে নানা ধরনের নিযার্তনের। পাশবিক নিযার্তন, নিযার্তনের পর হত্যার শিকার হয়েছে অনেক মা-বোন। আর যারা জীবিত ছিল, তাদের জীবনে ঘটেছে নানারকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। উঠতে-বসতে নানা অশ্লীল ও বঁাকা কথা শুনতে হয়েছে। অনেকে আবার পরিবারে ফিরে এসেও জীবন রক্ষা করতে পারেনি। মেয়ের কারণে পরিবারের অন্য সদস্যরাও অপমানিত হয়েছে। একদিকে পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে ভয়াবহ রকম শারীরিক মানসিক নিযার্তনের শিকার হয়েছিল, আবার স্বাধীন দেশে নিজ বাড়িতে আরেক ধরনের মানসিক নিযার্তনের শিকার হয়েছে। কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছে। যারা স্বাধীনতার চার দশকে জীবিত আছে তারাও নানা ধরনের মানসিক নিযার্তনের শিকার হয়েছে। অনেকেই আবার চরম অথৈর্নতিক সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি যে অত্যন্ত তাৎপযর্পূণর্ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির পাশাপাশি তাদের জীবনের সংকট ও সাবির্ক পরিস্থিতি পযের্বক্ষণ সাপেক্ষে যে কোনো সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে এমনটিও কাম্য।
সবোর্পরি আমরা বলতে চাই যে, প্রত্যেক জাতিরই গবর্ করার পাশাপাশি গভীর ক্ষত ও গøানি থাকে। একাত্তরে চরম ত্যাগ ও রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অজির্ত হলেও, দুই লাখেরও বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমহানি আমাদের গভীর ক্ষত এবং পরবতীের্ত তাদের জীবনে নেমে আসা নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি অত্যন্ত বেদনার। সঙ্গত কারণেইÑ বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির পাশাপাশি তাদের প্রাপ্য সম্মান, সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধাগুলো যথাযথভাবে নিশ্চিত হবে এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।