শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

ঢাকাই প্রতারণা ও একটি অভিজ্ঞতা

তুফান মাজহার খান ঢাকা
  ১৭ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

প্রতারণা, ছিনতাই, লুটতরাজ হয় না এমন জায়গা খুব কমই আছে। কিছুদিন আগে একটা কাজে ঢাকায় এসেছিলাম। কাজটা সারতে সারতে দুপুর গড়িয়ে যায়। সূযর্ পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে। তবে রোদ্রের উত্তাপ তখনো কমেনি। গরমের দিন হওয়ায় শরীর বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝরছিল। ট্রেনে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে মতিঝিল থেকে কমলাপুরের পথে হঁাটতে লাগলাম। রাস্তাটা খুব দূরত্বের না। বড়জোর ১ কিলোমিটার বা তার খানিকটা বেশি হবে। তাছাড়া হঁাটতে আমার ভালো লাগে বিধায় প্রায়ই হঁাটি। তাই কোনো দ্বিধাবোধ না করেই হঁাটছিলাম। হেঁটে প্রায় এক থেকে দেড়শো মিটারের মতো যেতেই একটা বিষয় খেয়াল করলাম। মনে হচ্ছিল কেউ আমার পিছু নিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই একজন ভদ্রলোককে দেখলাম। ভদ্রলোক না বলে উপায় নেই। ফরমাল ড্রেস আর কালো সুপরা অবস্থায় একটা লোককে কি ভদ্রলোক ছাড়া আর কিছু বলা যায়? যাই হোক, মনে শঙ্কা না নিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেলাম। কিন্তু আবারও মনে খটকা লাগলো। পেছনে আবার তাকালাম। এবার একটু অবাক হলাম পেছনে একজন না, আরও একজন যোগ হয়েছে। তবে উনি ঠিক আগের ব্যক্তিটার পাশাপাশি না, একটু পেছনে আছেন। উনাকে দেখে খুব বোকাসোকা আর বিপদাপন্ন মনে হলো। হাতে আবার একটা কালো রঙের অফিস ব্যাগ। মনে হচ্ছিল প্রথমজন আমাকে কিছু বলতে চাইছে। আমি পাত্তা না দিয়ে সামনে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার পরও দেখলাম দুজন আমার দুই হাত পেছন পেছনই হঁাটছেন। এবার আমার পুরো সন্দেহ হলো। তবুও মনকে প্রবোধ দিলাম, হয়তো এরা কোনো কু-মতলব নিয়ে হঁাটছে না। হয়তো এরাও কমলাপুরের উদ্দেশ্যে হঁাটছে। আমি দঁাড়ালাম। উদ্দেশ্য ছিল এরা আমাকে ক্রস করে চলে গেলে তারপর আমি যাব। কিন্তু আমার মনে হলো আমি দঁাড়ানোয় এরা সুযোগটাকে লুফে নিল। দু’জনই আমার দিকে ছুটে এলো। প্রথমজন আমাকে উদ্দেশ্য করে খুব নরম সুরে বললো, ভাই একটা কথা বলব? আমি বললাম, জ্বী বলুন। আমার কোনো ভয় হচ্ছিল না। কারণ ফুটপাত ধরে আরও অনেকেই হেঁটে যাচ্ছিল। উনি সেই বোকাসোকা লোকটাকে দেখিয়ে বলল, ভাই এই লোকটা নাকি খুব বিপদে পড়েছে। আমি বললাম, কী বিপদ? তিনি বললেন, উনার বাড়ি ঠাকুরগঁাও। উনার মানিব্যাগ পকেটমারে নিয়ে গেছে। এখন উনার বাড়ি যাওয়ার ভাড়াও নেই। আমি বললাম, ওহ্! কিছু টাকা সাহায্য করতে হবে তাইতো? উনি আমাকে হাত দিয়ে টান দিয়ে খানিকটা সরিয়ে নিয়ে কানের গোড়ায় ফিসফিস করে বললেন, উনার কাছে রেড পাউডার আছে। আমি বললাম, রেড পাউডার কী? তখনই ঐ বোকাসোকা লোকটা এগিয়ে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, রেড পাউডার হলো একটা দামি ইনজেকশনের কঁাচামাল। এ পাউডার থাইল্যান্ড থেকে আসে। আমি এর প্রসেসিং কোম্পানিতে চাকরি করতাম। কোম্পানিতে আমার কয়েকমাসের বেতন আটকে ছিল। তাই আসার সময় বেতন দিতে পারেনি বলে ম্যানেজারের সাথে ঝগড়া করে এগুলো নিয়ে এসেছি।

তারপর কালো ব্যাগটার চেইন খুলে আমাকে অনেক প্যাকেট দেখাল। আনুমানিক বিশটার মতো প্যাকেট হবে। আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু বুঝার তো আরও একজন আছে। উনি বললেন, আমার নাম আব্বাস। আমি বড় গাড়ি চালাই। স্ট্যান্ডেই আমি থাকি। প্যাকেটগুলো উনি বিক্রি করতে চায়। কিন্তু কোথায় বিক্রি করবে সেটা জানে না।

তারপর উনি আমার কানে ফিসফিস করে আবারও বললেন, আমি একটা দোকান চিনি। আপনি একটু উনাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমরা যদি এগুলো বিক্রি করে দিই তাহলে উনি আমাদের কত টাকা দিবেন।

আমি থতমত খেলাম। লোকটা বলে কী! একটা লোক বিপদে পড়েছে, এখন যদি তার একটু উপকার করতে পারি তাহলে এর জন্য আবার প্রতিদান চাইব কেন? আমি বুঝতে ছিলাম কোনো একটা চক্রের খপ্পরে পড়েছি আমি। তবে আমিও এত সহজে ছাড়ার পাত্র নই। শেষটা দেখতে চাই। তাই আমিও অভিনেতা হয়ে গেলাম। আমি বললাম, এগুলোর তো দাম অনেক বেশি মনে হচ্ছে। তো আমরা যদি বিক্রি করে দিই আমাদেরকে কী দেবেন?

কারণ আমার তো এ সম্পকের্ আইডিয়া নেই। তবে আব্বাস নামের লোকটি বলে ওঠলেন, এক প্যাকেটের মূল্য তো পঁাচ হাজার টাকার বেশি হবে না। তাহলে সবগুলোর মূল্য মোট এক লাখ টাকার মতো হবে।

আমি মনে মনে বললাম, বাহ্! কি সুন্দর নাটক সাজিয়েছে। মনে মনে দুটোকে পুলিশে দিব ভাবছিলাম। আশেপাশে কোনো কোনো পুলিশ নেই। তাই পুলিশ না পাওয়া পযর্ন্ত ওদের সাথে অভিনয়টা চালিয়ে যেতে হবে। বোকা লোকটা বললো, ঠিক আছে এক লাখ টাকা বিক্রি করতে পারলে আপনাদের দুজনকে দশ হাজার টাকা দিব। আমিও তাল মিলিয়ে বলে ওঠলাম, না ভাই, আমাদের দুজনকে ৫০ হাজার দিতে হবে। উনি বললেন, না ভাই এত টাকা তো আমি দিতে পারব না। আচ্ছা যান, আমি ২০ হাজার টাকা দিব।

আব্বাস সাহেব আমার দিকে সামান্য তাকিয়ে বললেন, আরে না, এত কমে আমরা পারব না। আর আমরা বিক্রি না করে দিলে আপনি নিজেও বিক্রি করতে পারবেন না। হয়তো অন্য কেউ নিয়ে যাবে অথবা পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন। তখন এক টাকাও পাবেন না। গোপনে বেচতে হবে। আমাদের কথায় রাজি থাকলে বলেন। তা না হলে আমরা আসি। (আমার হাত ধরে টান দিয়ে একটু চলে যাওয়ার ভঙ্গি করলেন।) আমিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম আর পা বাড়ালাম।

আশেপাশে কোনো পুলিশ নেই। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। সামনে অবশ্য একজন ট্রাফিক পুলিশ দেখা যাচ্ছিল।

আমি কায়দা করে বললাম, ঠিক আছে একটু ছায়ায় আসুন। এ কথা বলে তাদের ট্রাফিক পুলিশটার কাছাকাছি গেলাম। এবার পকেট থেকে মোবাইল বের করার ভান করে জোরে ট্রাফিক ভাই বলে চিৎকার দিলাম। আর দুইজনের দুই হাতে খপ করে ধরে ফেললাম। অবস্থা বুঝতে পেরে বোকা লোকটা তার পকেট থেকে একটা ছোট্ট ছুরি বের করে আমার হাতে ঘা মারল। আমি আর ধরে রাখতে পারলাম না। দুইজন ছুটে দুই দিকে দৌড় দিল। ট্রাফিক পুলিশ খানিকটা দৌড়ে ওদের তাড়া করল কিন্তু মুহূতের্ই এরা গাড়ির ভীড়ে হারিয়ে গেল। তারপর ট্রাফিক পুলিশ আমার কাছে এলে ঘটনা খুলে বলি। পুলিশ পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে বললেন, রক্ত পড়ছে, চেপে ধরুন।

ভাগ্যিস সামান্য আঘাত লেগেছে, তাও আবার হাতে। যদি পেটে ছুরিটা বসিয়ে দিত। ওহ্!

দোকানটা কাছে হওয়ায় পুলিশ বললেন, চলুন তো দেখি। কিন্তু ওখানে গিয়ে আর ঐ লোকটাকে পাওয়া গেল না, যিনি আব্বাসকে টাকা দিয়েছিলেন। বুঝতে পারলাম উনিও তাদের দলের লোকই ছিল। কবিরাজকে জিজ্ঞেস করলে তিনি নিজেও এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারলেন না। রোগী দেখার চাপে হয়তো এসব তিনি খেয়ালই করেননি। পুলিশ আমার কঁাধে হাত রেখে বললেন, এমন বোকামি করবেন না কখনো। এদের থেকে সাবধানে থাকবেন। পারলে ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক ৯৯৯ তে কল দিবেন।

আমি বললাম, জ্বী। আর কোনো কথাই বের হলো না মুখ দিয়ে। শুধু মনে মনে বললাম, আহা কি নাটকীয় জীবন!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<3852 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1