বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলা, লেখক-প্রকাশক এবং কিছু কথা

আলী এরশাদ ঢাকা
  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

বই জ্ঞানের বাহন, বই আলোর প্রতীক। মানুষের মননকে ঋদ্ধ করে বই। মনের অন্ধকার দূর করে মানুষকে সত্যের পথে ধাবিত করে বই। বইয়ের মাধ্যমে ঘরে বসেই পরিচয় ঘটে অচেনা বিশ্বের সাথে। মানুষের ঘুমন্ত হৃদয়কে জাগাতে পারে

শুধু বই।

শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ মেলা লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকদের প্রাণের মেলা। মেলাকে ঘিরে বাংলা একাডেমির মহাব্যস্ততা, নানান দিক সামলাতে হয়। বছরের ৯০% বই প্রকাশ হয় মেলাকে উপলক্ষ করে। ফেব্রæয়ারি মাসজুড়ে হাজার হাজার নতুন বই আসবে মেলায় যার অধিকাংশই নতুন লেখকদের। নতুন লেখকদের মাঝে দেখা যাবে প্রথম প্রেমে পড়ার মতো এক ধরনের চাপা উত্তেজনা। পাঠকরা পাবে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের লেখা আর প্রকাশকরা গুনবে কচকচে নতুন টাকার নোট।

বাংলা একাডেমির তথ্যমতে, ২০১৮ সালের বইমেলায় সবের্মাট বই প্রকাশিত হয়েছিল ৪৫৯১টি এবং বই বিক্রি হয়েছিল ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে বাংলা একাডেমির ধারণা বই প্রকাশের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ অনেক প্রকাশনা সংস্থা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে বই জমা দেন না। প্রতিবছর এই যে বিপুল পরিমাণ বই প্রকাশ ও বিক্রি হয় তা থেকে লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক কে কি পরিমাণ লাভবান হচ্ছে তা নিয়ে কিছু কথা বলবো।

বতর্মানে পাঠক বইবিমুখ, কেউ বই কিনতে চায় না এ কথা আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি। আমি এ কথার সাথে পুরোপুরি একমত নই। পাঠক যদি বইবিমুখ হবে, পাঠক যদি বই না পড়বে, তবে ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই কে কিনলো?

পাঠক এখনো বই পড়ে তবে তারা আস্থা রাখে স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের উপরই। কারণ অনেক পাঠক চোখ ধঁাধানো মলাটের ভেতর তেমন কোনো মসলা খুঁজে পায়নি, তাই তারা নতুন লেখকদের বই কিনতে চায় না এ কথা মানতেই হবে। তবে নতুনদের ভেতর অনেক লেখক আছে প্রতিশ্রæতিশীল। বতর্মান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকষর্তার এ যুগে মানুষ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক, অনেক বেশি ব্যস্ত তাই প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবতর্ন। আগে মানুষের অবসর কাটতো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, গল্প করে কিংবা বই পড়ে বা গান শুনে, এখন সময় কাটায় নেটে ঢুকে, স্মাটর্ ফোন বা কম্পিউটারে গেমস খেলে, এজন্য স্বাভাবিকভাবেই বই পড়ায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। আবার যারা বইপ্রেমী তারা নেট থেকে বিভিন্ন বই ডাউনলোড করে সহজেই পড়ে নিচ্ছে, যার কারণে বইয়ের কপি কম বিক্রি হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে যে তরুণ সমাজ এখন বইয়ের প্রতি মন দিচ্ছে। তাদের প্রতিদিনের যাপিতজীবনের একঘেয়েমি দূর করতে আবার ফিরে আসছে বইয়ের পাতায়। নিজে থেকে খুঁজে নিচ্ছে প্রগতিশীল লেখকদের বই।

অন্যদিকে শুধু নাম, যশ, খ্যাতির মোহে আকৃষ্ট হয়ে নামের পাশে কবি, সাহিত্যিক বিশেষণ ব্যবহারের লোভে পড়ে, নিজেকে সেভাবে তৈরি না করেই অনেকে গঁাটের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করে থাকেন। তারপর মানহীনতার কারণে বা পরিচিতির অভাবে বই রয়ে যায় অবিক্রীত। হতাশ হয়ে পড়েন লেখক। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে মেধা খাটিয়ে একটি বই লিখে যখন আবার নিজের টাকায় প্রকাশ করার পরও এক কপি বিক্রি হয় না এর চেয়ে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে? কথা হচ্ছে লেখকরা লিখে যাবেন, প্রকাশকরা তাদের প্রয়োজনেই ভালোমানের লেখক খুঁজে বের করে বই প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পেঁৗছে দেবেন। কিন্তু না, হচ্ছে তার উল্টো। লেখকরা বরং ধণার্ দিচ্ছে প্রকাশকের কাছে, আর সুযোগটা ভালোভাবেই নিচ্ছে প্রকাশনা সংস্থাগুলো। প্রকাশনীগুলো স্বাভাবিকভাবেই কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়, আর তা যদি হয় নতুন লেখক তবে তো কোনো কথাই নেই। এখন যা হচ্ছে একজন লেখকের সারাবছর মেধা এবং শ্রমের পাশাপাশি হাজার হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে।

অনেকেই গবের্র সাথে বলে থাকে, এটি আমার দশম প্রকাশিত বই! আমি মনে করি লেখকদের এ ধরনের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, কোয়ান্টিটি নয় কোয়ালিটির উপর নজর দিতে হবে। অনেক প্রথিতযশা লেখক রয়েছেন যাদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি; কিন্তু তারা সাহিত্যে পাকা আসন করে নিয়েছেন তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যার তার এক লেখায় বলেছেন, ‘আমি লেখক আমি কেন টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করবো? এজন্য তাকে প্রথম বই প্রকাশ করতে বেশ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

তবে হ্যঁা, প্রকাশনী সংস্থাগুলো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও বটে। তারা চুক্তিসাপেক্ষে বই প্রকাশ করছে এটা নীতিবিরুদ্ধ নয়, তবে কিছু কিছু প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা চুক্তি মোতাবেক কাযর্ সম্পাদন করেন না। অনেক প্রকাশনীর নিজস্ব সম্পাদক নেই, ভুলভাল বানানে দায়সারা গোছের বই প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ। অল্পকিছু খরচ বঁাচাতে বইটি দেখানো হচ্ছে না অভিজ্ঞ প্রæফরিডারকে।

আবার অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে লেখকদের সাথে প্রতারণা করে থাকে, সময়মতো মেলায় বই নিয়ে আসছে না, যতকপি লেখককে দেয়ার কথা সেটাও ঠিকমতো দিচ্ছে না, কোনো কোনো প্রকাশনী টাকা নিয়ে লাপাত্তা।

সবচেয়ে যে দুঃখজনক কাজটি কিছু কিছু প্রকাশক করে থাকে তা হলো, মেলা শেষে বলবে আপনার এক কপিও বিক্রি হয়নি! লেখকের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা যে বই কিনে ফোনে জানাল তা কি মিথ্যে?

আফসোস! বড় আফসোস হয় এসব কপট প্রকাশকদের আচরণ দেখে। এরা প্রকাশক নয়Ñ এরা প্রতারক। প্রকাশকরা হয়তো ভুলেই যান লেখক বঁাচলেই তারা বঁাচবেন। অনেক লেখকের যেখানে চা পান করার মতো পয়সা থাকে না সেখানে প্রকাশক বিলাসী জীবনযাপন করে এসব লেখকের কল্যাণেই। বতর্মান সংঘাতময় পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে একটি ভালো বই। সমাজকে কুসুমিত করতে মূল্যবান ভ‚মিকা রাখে একটি মানসম্পন্ন বই। শুদ্ধ মানুষ তৈরিতে বই তথা সাহিত্যের বিকল্প কিছুই নেই। আর এ সাহিত্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে লেখক এবং প্রকাশক উভয়কেই সততার পরিচয় দিতে হবে। লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক কারও থেকে কারও গুরুত্ব কম নয়। পাঠকের প্রতি লেখকের যেমন দায়বদ্ধতা রয়েছে, প্রকাশকেরও উচিত ভালো লেখক তৈরিতে গুরুত্বপূণর্ ভ‚মিকা পালন করা। লেখককে তার সঠিক সম্মানী প্রদান করা।

আশা করি নতুন লেখক এবং কিছু প্রকাশকদের মধ্যে যে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে তা অচিরেই বন্ধ হবে। লেখক-প্রকাশক পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং পাঠক পাবে মানসম্পন্ন নতুন নতুন স্বাদের বই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<36971 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1