শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গণতন্ত্র ও বিরোধী দল

বিগত ১ দশক তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল উন্নয়ন ও অগ্রগতি। এবার একই সঙ্গে তিনি গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকেও সফল দেখতে চান। বিরোধী দলের উচিত সংখ্যায় তারা যতই কম হোন না কেন, সম্মিলিতভাবে সাংবিধানিক ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করে চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সবল ও সুষ্ঠু করে তুলবেন। শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভ‚মিকা অনস্বীকাযর্। তিনি সেভাবেই বিরোধী দলকে দেখতে চান।
ডা. এস এ মালেক
  ২১ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে একটা সাধারণ নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নিবার্চনে একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হয়ে নতুন করে সরকার গঠন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা। বলা যায়, ২০১৮ সাল জাতিকে উপহার দিয়েছে এক অনন্য সরকার। বিগত এক দশক ধরে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন ছিলেন। এই এক দশকে তিনি বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিয়ে দেশকে এমন একপযাের্য় পৌঁছে দিয়েছেন যে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের এক মডেল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা এরূপ যে বাংলাদেশের সবর্স্তরের মানুষ মনে করে যে, শেখ হাসিনা মানে উন্নয়ন; শেখ হাসিনা মানে অগ্রগতি; শেখ হাসিনা মানে দ্রæত এগিয়ে যাওয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সরকার উন্নয়নের পথে দেশ এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এভাবে সবর্স্তরের মানুষের কল্যাণ সাধন কেউ করতে পারেননি। বাংলাদেশের কৃষক আজ প্রায় সচ্ছল জীবনযাপন করছে। কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের কারণে তাদের এই সচ্ছলতা। মানুষ এখন শুধু পেট ভরে খায় না, এমন খাবার খেতে আগ্রহী যা স্বাস্থ্যকে সবল করে। গ্রামে এমন গরিব মানুষ কম আছে; যার সন্তান অথার্ভাবে পড়ালেখা করতে পারছে না। বিনা ব্যয়ে সাবর্জনীন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবতর্ন হয়েছে। গ্রামের মানুষ আজ ঘরে বসে স্বাস্থ্যসেবা পায়। বিধবা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, গৃহহীন মানুষ, নদীভাঙা ও পাহাড় ধসা মানুষ, সবার দিকে শেখ হাসিনার দৃষ্টি। কিছুই পাননি সমাজে এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য । সম্পদ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হয়েছে। তাই জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিপুলভোটে বিজয়ী হওয়ায় সবর্স্তরের মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুধু অভিনন্দন জানাতে পারেনি তারাই; যারা স্বাধীনতা ও সাবের্ভৗমত্বে বিশ্বাসী নয়। ৭৫’এর প্রতিবিপ্লবের পর থেকে যারা বাংলাদেশকে বিপরীত ধারায় পরিচালিত করে স্বাধীনতাকে অথর্হীন করতে চেয়েছিল। আসলে পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও নিবার্চন ১০০ ভাগ অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যে যেখানে সুযোগ পেয়েছে কিছু কিছু অনিয়মতান্ত্রিকতার আশ্রয় নিয়েছে। এ কারণেই সরকার ও বিরোধী দলের কিছু দায়িত্বহীন লোকেরাই দায়ী। তবে ওইরূপ করা না হলেও শেখ হাসিনা যে এবার বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন, তা জাতীয় ও আন্তজাির্তক পযাের্য় অনেকেই অঁাচ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। নিবার্চন সম্পকের্ যাই বলা হোক না কেন, নিবার্চন সংবিধান মোতাবেক ও অংশগ্রহণমূলক যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রথমেই ধরা যাক নিবার্চন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া। সরকার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই কমিশন গঠন করেন। এখন প্রমাণিত হয়েছে যে বিরোধী দলের প্রতি সহানুভ‚তিশীল লোক পাওয়া গিয়েছিল। নিবার্চন কমিশনকে তারা মেনে নিয়েই নিবার্চনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং কখনো কখনো তারা নিবার্চন কমিশনকে প্রশংসিত করেছেন। নিবার্চনের পূবের্ সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিবার্চন অনুষ্ঠানের দিন বেলা ১২টা পযর্ন্ত বিরোধী দলের মুখপাত্র ড. কামাল নিবার্চনকে ভোট বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন। বিজয় সম্পকের্ তারা এতই সুনিশ্চিত ছিলেন; তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩০ ডিসেম্বরের পর ক্ষমতাসীন দলের অস্তিত্ব থাকবে না। অবশ্য নিবার্চন সুষ্ঠু হবে না, পরাজয় সুনিশ্চিত এরূপ অনুভ‚তি ও বক্তব্যে তারা পিছিয়ে ছিলেন না। নিবার্চন কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট না দেয়া, দলীয় ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে নিষেধ করা, কেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টি, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ওপর আক্রমণ, বেশকিছু ভোটকেন্দ্রে নিবার্চন না হতে দেয়া এর সবকিছুই তারা ১২টার পর থেকে শুরু করে। যখন প্রায় ৩৫% ভোট দেয়া হয়েছে। হঠাৎ করে প্রথমে জামায়াত প্রাথীর্রা সংখ্যায় প্রায় ২২ জন নিবার্চন থেকে সরে দঁাড়ানোর ঘোষণা দেন। এরপর দুপুর ১২টা থেকে ২টা পযর্ন্ত বিএনপি প্রাথীর্রাও নিবার্চন থেকে সরে দঁাড়ানোর ঘোষণা দেন। তাদের ঘোষণার পরেও নিবার্চন সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে হয়েছে এবং সঠিক ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় নিবার্চনে অংশগ্রহণ বলতে যা বোঝা যায় তার সবকিছুই তারা করেছে এবং পরাজয় নিশ্চিত জেনেই তারা নিবার্চন থেকে সরে দঁাড়ায় এবং ঘোষণা দেন রায় মানেন না পুননির্বার্চন দিতে। সম্প্রতি ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন আবার সরকারের সঙ্গে সংলাপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কি বিষয়ে সংলাপ করবেন তার ঘোষণা এখনো দেয়া হয়নি। তবে বুঝতে বাকি নেই তারা যেসব দাবি ইতিপূবের্ই উত্থাপন করেছেন; যার কোনোটাই বতর্মান পযাের্য় গ্রহণ করা হলে সংবিধানের পরিপন্থি কাজ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের সম্মতি দিয়েছেন। তবে তিনিও কিন্তু বলেননি আলোচ্য বিষয় সম্পকের্। নিবার্চন পূবের্ যখন সংলাপের কথা উঠেছিল তখন প্রধানমন্ত্রী সংলাপে সম্মতি দেন। নিবার্চনে বিরোধী দল অথার্ৎ ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ৭টি আসন পাওয়ায় শেখ হাসিনা যে তুষ্ট নন; তা তার বক্তব্যেই বোঝা যায়। তবে বোধহয় ধারণা ছিল সংসদে বিরোধী দল বেশ কিছু আসন পাবে এং সংসদে একটি বিরোধী শক্তি কাজ করবে। শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে কাজ করতে পারবে। বাস্তবতায় তার প্রতিফলন না ঘটায় প্রধানমন্ত্রী যাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসাবে অভিহিত করা হয়, তিনি বিরোধী দলকে সক্রিয় করার প্রয়োজন বোধ করেছেন। ড. কামাল হোসেনের সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানানো তাই মনে হয়। প্রচার মাধ্যমে যা দেখা যায় আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট নেতারা এবারের সংলাপে বিরূপ মন্তব্য করলেও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র সংরক্ষণের প্রয়োজনেই সংলাপের প্রয়োজন অনুভব করছেন। এ দেশে অনেকে আছে যারা মনে করেন, শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের পক্ষের কোনো শক্তি নন। তার কারণেই নাকি এ দেশে গণতন্ত্রের বিপযর্য় ঘটেছে। তাদের উপলব্ধি করা দরকার বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পরেও কেন শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে রাজি হলেন।

বিশেষ করে নিবাির্চত বিএনপি সদস্যরা যখন শপথ নেয়া ও সংসদে যোগদান করতে অসম্মতি জানিয়েছেন; তখন সংসদকে কাযর্কর করার প্রয়োজনে তাদের সংসদকে যোগদান করানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারপ্রধান হিসেবে তার একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব আছে। তার মূল লক্ষ্য সংসদকে শক্তিশালী করা। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সংসদ দুবর্ল হয়। একথা ঠিক জাপার সংসদ সদস্যরা নিবার্চনে বিজয়ী হয়েছে। তারা নিবার্চনে বিজয়ী হয়েছেন শেখ হাসিনার আশীবার্দপুষ্ট হয়ে। তা ছাড়া আগে জাপা বিরোধী দল হিসেবে থাকলেও তাদের পোষ্য বিরোধী দল বলে অভিহিত করা হতো। তাই বিরোধী দল ও সরকারি দলের অবস্থানরত অংশগ্রহণ করা সত্যিকারে বিরোধী দলের ভ‚মিকা পালন করা সম্ভব ছিল না। এবার অবশ্য জাপার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা এরশাদকে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাই আশা করা যায় সংসদে জাপা বিরোধী দলের ভ‚মিকা পালন করবে। তাই জাপার ২২ জন এবং ঐক্যফ্রন্ট ৭ জন যদি সত্যিকার অথের্ বিরোধী দলের ভ‚মিকা পালন করে, তাহলে সংসদ সঠিক দায়িত্ব পালনে বেশ কিছুটা সক্ষম হবে। আসলে নিবার্চনের ওপর ভিত্তি করে সংসদ তৈরি হয়। শেখ হাসিনা তার বিজয়ী প্রাথীের্দর পদত্যাগ করিয়ে সেই জায়গায় বিরোধী দলের প্রাথীের্ক বিজয়ী করে সংসদকে শক্তিশালী করতে পারেন না। তাই মনে হয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাশা করেন যে, বিরোধী দলের নিবাির্চত প্রতিনিধিরা সংখ্যায় কম হলেও সরকার যদি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে, তাহলে গণপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ বেশ কিছুটা সঠিক দায়িত্ব পালন করবে।

জাতির জনকের কন্যা, বাংলাদেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দলের নেতা, জননেত্রী শেখ হাসিনা সত্যিকার অথের্ই এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নিবার্চনে অনিয়ম-আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে এবং বিরোধী দলের কণ্ঠ তার বিরুদ্ধে সোচ্চার বলে তিনি এবার সংলাপের ক্ষেত্রে নতি স্বীকার করেছেন বলে কেউ চালানোর চেষ্টা করলেও আসল কথা বিগত ১০ বছর উন্নয়ন তৎপরতাকে যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে সক্ষম হলেও উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ঠিকভাবে এগোতে পারেনি।

বিগত ১ দশক তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল উন্নয়ন ও অগ্রগতি। এবার একই সঙ্গে তিনি গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকেও সফল দেখতে চান। বিরোধী দলের উচিত সংখ্যায় তারা যতই কম হোন না কেন, সম্মিলিতভাবে সাংবিধানিক ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করে চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সবল ও সুষ্ঠু করে তুলবেন। শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভ‚মিকা অনস্বীকাযর্। তিনি সেভাবেই বিরোধী দলকে দেখতে চান।

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<33063 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1