শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

যানজট: অব্যবস্থাপনার অভিশাপ মুক্ত হোক

নতুনধারা
  ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

দেশের অথর্নীতির রক্ত সঞ্চালনকারী শিরা হিসেবে অভিহিত করা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে। সময়ের চাহিদা পূরণে এ মহাসড়কটি চারলেনে সম্প্রসারিত করা হয়েছে দেড় বছর আগে। আশা করা হয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কপথের যানজট নিরসনে তা ভূমিকা রাখবে। দেশের অথর্নীতির জন্য সুখবর বয়ে আনবে পণ্য পরিবহনে সময়ের অপচয় বন্ধ হওয়ার ফলে।

কিন্তু সড়ক পথের অব্যবস্থাপনায় সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। সীমাহীন অব্যবস্থাপনায় দুভোের্গর শিকার হচ্ছেন এ সড়ক ব্যবহারকারীরা। বিশৃঙ্খল মহাসড়কে কে কখন গন্তব্যে পেঁৗছাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ২৬০ কিলোমিটার দীঘর্ পথে ছোট-বড় অধর্শতাধিক বাজার, রিকশা ভ্যান, ঠেলাগাড়িসহ নানা ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহনের বিপজ্জনক চলাচল গুরুত্বপূণর্ এই মহাসড়কটিকে অনিরাপদ করে তুলেছে। উল্টোমুখী গাড়ির চলাচল ও টোল প্লাজায় টোল আদায়ের ধীরগতি মহাসড়কটিতে যানজটের দুভোর্গ সৃষ্টি করছে। মহাসড়কটির মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, দাউদকান্দি, চান্দিনা, নিমসার, পদুয়া বাজার, ফেনী, মিরসরাইসহ বিভিন্ন অংশে অবাধে অটোরিকশা, রিকশা ভ্যান, এমনকি ট্রাক্টরও চলাচল করে। এসব যানবাহন হুট করে উল্টোপথে সামনে এসে পড়ায় দ্রæতগামী বাস ও ট্রাকের সঙ্গে দুঘর্টনা অনিবাযর্ হয়ে ওঠে।

মহাসড়কটির ঢাকা-কুমিল্লা অংশে সোনারগঁায়ের মোগরাপাড়া, দাউদকান্দি, কুমিল্লার চান্দিনা, নিমসার, ইলিয়টগঞ্জ, কাবিলা, ক্যান্টনমেন্ট, আলেখারচর, পদুয়াসহ ছোট-বড় বিভিন্ন বাজারের কারণে থমকে যায় চলমান গাড়ির গতি। এসব বাজারের বেশ কয়েকটিতে সকালে সবজির ট্রাকে মালামাল ওঠানো ও নামানোর কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দ্বিগুণ প্রশস্ত হওয়ার পরও যানজট এড়ানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে টোল প্লাজাগুলো এ সড়কপথকে গতিহীন করে তুলছে। উল্টোপথে গাড়ি চালানোর প্রবণতাও কখনো কখনো যানজট সৃষ্টিতে মদদ জোগাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতি আনতে এ সড়কের ওপর যেসব হাটবাজার গড়ে উঠেছে সেগুলো দূরে সরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। টোল আদায়ে অযথা সময় ক্ষেপণ বন্ধ করাও জরুরি। উল্টোপথে গাড়ি চালানো বন্ধেরও উদ্যোগ নিতে হবে। রিকশা, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করাও জরুরি।

একটি দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা হচ্ছে জাতীয় অথর্নীতির মূল চালিকাশক্তি। আগে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া প্রায় সমান থাকলেও বিশ্বমানের যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে মালয়েশিয়া এখন অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের দেশে অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে যাতায়াত ব্যবস্থা। যানজটের কারণে অথর্নীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

যানজট এখন শুধু রাজধানীবাসীর নয়, সমগ্র জাতির জন্যও এক বিড়ম্বনার নাম। দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছে এ ভয়ঙ্কর সমস্যা। যানজটের কারণে যে সময়ক্ষেপণ ঘটছে- অথর্নীতির বিচারে তার ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ। এ সমস্যা উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশের রফতানি বাণিজ্যকে অনিশ্চিত করে তুলছে। বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজধানীকে অস্বস্তির দৃষ্টিতে দেখে যানজটের কারণে। বলা যেতে পারে, যেসব কারণে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বিঘিœত হচ্ছে যানজট তার অন্যতম। প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা মহানগরী ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মেগাসিটি অভিধাটি গবের্র অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হলেও যানজটসহ নানা সমস্যায় ঢাকা মহানগরী বিশ্বের শীষর্স্থানীয় সমস্যাবহুল নগরী হিসেবেও বদনাম কিনেছে।

রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে লোকসান আর ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঠিক কতটা অথৈর্নতিক লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, কতটা কমর্ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, মানুষ কতটা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে এ নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। কিন্তু কোনো কিছুতেই সফলতা আসছে না।

ঢাকার যানজট নিয়ে এত দুশ্চিন্তার পরও এ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ এখন পযর্ন্ত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। বরং দিন দিন আরও সঙ্কুুচিত হয়ে আসছে যান চলাচলের রাস্তা। ঢাকার রাস্তায় মন্থর এবং দ্রæত গতির যান চলাচল করে অথার্ৎ রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, মোটরগাড়িÑ যা পৃথিবীর কোথাও এ ব্যবস্থা নেই। এ কারণেই ভয়াবহ যানজট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। যানজটে এখন নাকাল নগরবাসী।

একটি শহরে রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত ২৫ শতাংশ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ শতাংশ। পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিলে ৮ ভাগ রাস্তা থাকার পরও ঢাকার যানজট নিরসন সম্ভব। ঢাকার চেয়ে কলকাতায় এক সময় যানজট ছিল বেশি। সেই কলকাতার যানজট এখন ঢাকার তুলনায় তুচ্ছ। আয়তনের তুলনায় লন্ডন-সিঙ্গাপুরেও রাস্তা কম। অথচ এ দুই নগরীতে দুঃসহ যানজট নেই। হংকংয়ের ৯০ শতাংশ লোক পাবলিক ট্রান্সপোটর্ ব্যবহার করে। ঢাকায় যানজটের পেছনে প্রধান কারণ যথাযথ নগর পরিচালন ব্যবস্থা না থাকা। ঢাকায় বিভিন্ন সময় রাজউক, ডেসা, ওয়াসা, ডেসকো হয়েছে। এগুলোর কাজ আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই। এগুলোর যথাযথ সমন্বয় দরকার। সবই আলাদাভাবে গড়ে ওঠায় এবং সমন্বয়হীনভাবে কাজ করায় কোনো লাভ হয়নি।

যানজটের জন্য মাত্রাতিরিক্ত অভিবাসনও দায়ী। দেশের প্রতিটি এলাকা থেকে রাজধানীতে প্রতিদিন মানুষ আসে কাজের খেঁাজে। ঢাকা পুরোপুরি অথর্নীতিনিভর্র শহর হয়ে গেছে। সরকারের যেসব পরিকল্পনা, তাতে এ অভিবাসন ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর আইনের কথা যতই বলা হোক না কেন, সবকিছুরই সীমাবদ্ধতা আছে। যে কোনো পযাের্য়ই যাওয়া হোক যানজট হবেই, যদি মানুষের সংখ্যা সহনীয় পযাের্য় রাখা না যায়। এর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যে শহরে লোকসংখ্যা বেশি, সেখানে তিন ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। সারফেস, এলিভেটর ও আন্ডারগ্রাউন্ড। আমাদের এখানে শুধু সারফেসটাই আছে। এটা কোনো বড় শহরের চরিত্র নয়। যানজট নিরসনে পাতাল রেলের কথাও ভাবতে হবে। তবে সবকিছু করতে হবে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই করে। যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সরকারের আশু করণীয় হচ্ছে, ছোট ছোট মিনিবাস তুলে দিয়ে ৫২ সিটের বাস ও দোতলা বাস চালু করা। মূল সড়ক থেকে রিক্সা সম্পূণর্রূপে তুলে দেয়া। ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি কেবল রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পযর্ন্ত চলাচলের অনুমতি দেয়া। বধির্ত ঢাকার সঙ্গে মূল ঢাকায় চলাচলের জন্য অধিকসংখ্যক বাইপাস সড়ক নিমার্ণ। রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করা। ঢাকায় রাজপথ অপদখল পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজধানীর রাজপথ দখলমুক্ত হলে যানজট সহনীয় মাত্রায় আসবে।

যানজট জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দঁাড়িয়েছে। উৎপাদনের জন্য যে সময় ব্যয় হওয়ার কথা তা গিলে খাচ্ছে এ সমস্যা। গত এক দশকে যানজটে অপচয় হওয়া সময় ব্যবহৃত হলে বাংলাদেশ বহু আগেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতো। ফলে এ সমস্যার সমাধানে আন্তরিক প্রয়াসই এখন সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা তেমন কোনো কাজে আসছে না। যানজট নিরসনে প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ। বিচ্ছিন্নভাবে একক পদক্ষেপ নিয়ে এই সবর্গ্রাসী সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

ইফতেখার আহমেদ টিপু

ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<26753 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1