মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রপ্তানিতে সুবাতাস, ইতিবাচক বাংলাদেশ

নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করছি, আমরা। সাবির্কভাবে সব কিছুই আমাদের অনুক‚লে। সে কারণেই বাড়ছে রপ্তানি আয়। অথর্বছরের বাকি মাসগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
মো. মাঈন উদ্দিন
  ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আমরা এমন এক বাংলাদেশে বাস করি, সেখানে দুই দশক আগেও বেকার মানুষ দিনমজুরের কাজও পেত না। তারা অনাহারে-অধার্হারে দিনাতিপাত করত। খাবারের জন্য কোলের শিশুরা কান্নাকাটি করত। কিন্তু বেকার পিতামাতার কিছুই করা ছিল না শুধু বুক ফঁাটা আহাজারি ছিল তাদের হৃদয়জুড়ে। কিন্তু তলাবিহীন ঝুড়ি নামে খ্যাত সেই বাংলাদেশ আজ ঘুরে দঁাড়াতে শুরু করেছে। সেই বাংলাদেশ আজ অপার সম্ভাবনার প্রান্তরের বুকভরা নিঃশ^াস নেয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। আজকাল শহর কেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মানুষও না খেয়ে মারা যায় না। এমনও দেখা গেছে, একজন ভিক্ষুকেরও আজকাল ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। এই যে সম্ভাবনার দুয়ার খোলছে। তার পেছনে রয়েছে, দেশের সাবির্ক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা, সেইসঙ্গে এ দেশের মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রম। আর এই পরিশ্রমের যে ক্ষেত্রটি, তাহলো এ দেশের গামের্ন্টস শিল্পসহ বিভিন্ন রপ্তানি অঞ্চল। এমনই একটি সম্ভাবনার খবর পেলাম গত কিছুদিন আগে একটি পত্রিকা মারফত। এতে বিজিএমইএ-এর একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।

বিজিএমইএর তথ্যমতে, টানা তৃতীয় মাসের মতো রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি অথর্ দেশে এসেছে। রপ্তানি আয়ের এই পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। আগের মাস অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩০ শতাংশের বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৩৩ শতাংশ। আর পঁাচ মাসের হিসাবে অথার্ৎ চলতি অথর্বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আয় বেড়েছে সাড়ে ১৭ শতাংশের মতো। মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করেই আমাদের এ অগ্রযাত্রা। বিজিএমইএর একজন কমর্কতার্ বলেন, আমাদের পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। আমরা এখন বেশি দামের পোশাকও রপ্তানি করছি।

নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করছি, আমরা। সাবির্কভাবে সব কিছুই আমাদের অনুক‚লে। সে কারণেই বাড়ছে রপ্তানি আয়। অথর্বছরের বাকি মাসগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

গত পঁাচ ডিসেম্বর বুধবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অথর্বছরের প্রথম পঁাচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে ১ হাজার ৭০৭ কোটি ৩৭ লাখ (১৭.০৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। এই পঁাচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৫২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত বছরের এই পঁাচ মাসে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৪৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। নভেম্বরে ৩৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এই মাসে লক্ষ্য ধরা ছিল ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত বছরের নভেম্বরে আয় হয়েছিল ৩০৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার। এ হিসাবে নভেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট (মাসভিত্তিক) আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ইপিবির তথ্য পযাের্লাচনায় দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ দশমিক ১০ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অথার্ৎ ১৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারই এসেছে এ খাত থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৭৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ।

উভেন পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৬৮৮ কোটি ডলার; প্রবৃদ্ধি ২০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। নিটে লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়ে গেছে ১১ দশমিক ১ শতাংশ। আর উভেনে প্রায় ১২ শতাংশ। অথর্বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০ শতাংশের মতো। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টেই তা হেঁাচট খায়। ওই মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে আয় কমে ১২ শতাংশ। এর পরের মাস থেকে তৈরি পোশাকসহ সামগ্রিক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দেশের রপ্তানি আয়ের ওপর বরাবরই তৈরি পোশাক পণ্যের বড় ধরনের প্রভাব থাকে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে তাদের কারখানার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেয়ায় ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি রপ্তানি আয় বাড়াতে অবদান রেখেছে বলে মনে করেন পোশাক শিল্প মালিকদের শীষর্ সংগঠন বিজিএমইএর কতার্ব্যক্তিরা। তিনি বলেন, অথর্বছরের শুরুটা খুব ভালো হয়েছিল। কোরবানির ঈদের কারণে কয়েকদিন কারখানা এবং রপ্তানি কাযর্ক্রম বন্ধ থাকায় আগস্ট মাসে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল। সে ধাক্কা আমরা সামলে নিয়েছি। এখন প্রতি মাসেই রপ্তানি আয় বাড়ছে। অথর্বছরের বাকি মাসগুলোতে আয় বাড়বে আশা করে তিনি বলেন, কারখানাগুলোর উন্নয়নে পোশাক শিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কষ্টও করেছেন। ৮০ শতাংশের বেশি কারখানা উন্নত কমর্পরিবেশের আওতায় চলে এসেছে। এতে বায়াররাও খুশি। এ কারণেই বিদেশি ক্রেতাদের আস্থার সঙ্গে ক্রয়াদেশও বেড়েছে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সহসভাপতি। খুশির খবর হচ্ছে, আমরা এখন অনেক বেশি দামের পোশাকও রপ্তানি করছি। আমরা ক্রেতাদের পছন্দ এবং ডিজাইনের পণ্য দিতে পারছি। আমাদের প্রতি তাদের আস্থা বাড়ছে। তবে ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ মাকির্ন ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার ব্যাপক দরপতন করায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে তাতে আমেরিকার বাজারে চীনের পোশাক রপ্তানি কমে যাবে। সেই বাজার বাংলাদেশের দখল করার সম্ভাবনা আছে। সেটা হলে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়বে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে জুলাই-নভেম্বর সময়ে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৪৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলারÑ যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রপ্তানি আয় ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ কমেছে। এ খাতে আয় দঁাড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। একইভাবে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি আয়ও কমেছে। এ খাতে আয় হয়েছে ৩৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। গত ২০১৭-১৮ অথর্বছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ তিন হাজার ৬৬৬ কোটি ৮২ লাখ (৩৬.৬৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। এর মধ্যে ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। অথার্ৎ মোট রপ্তানির ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশই এসেছিল এই খাত থেকে। ২০১৭-১৮ অথর্বছরের সাবির্ক রপ্তানি ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ বাড়লেও তা ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ২২ শতাংশ কম। চলতি ২০১৮-১৯ অথর্বছরে পণ্য রপ্তানি করে ৩৯ বিলিয়ন (তিন হাজার ৯০০ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার, যা গত অথর্বছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। এবার দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার আসবে বলে ধরা হয়েছে, যা মোট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।

এই যে পরিসংখ্যানটি। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য আশাব্যঞ্জক। অমাবস্যার গভীর রাতে বিদ্যুতের চকচকে আলোয় দঁাড়িয়ে দেখা হাজার পাওয়ারি ঝকঝকে একটি বাল্বকে। শুধু পরিসংখ্যানই নয়, বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের আথর্-সামাজিক পরিবতর্নই বলে দেয় এ বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, কনক্রিটসম তলাওয়ালা ঝুড়ির ওপর দঁাড়িয়ে। এখন দরকার অনাকাক্সিক্ষত কালপ্রিট শকুনের রক্তচক্ষু থেকে এ দেশকে নিরাপদ রাখা। নিরাপদ থাকা হিং¯্র মানুষের অনাহুত উসকানি থেকে। তাহলেই আজকের অদম্য টাইগারের এই বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পেঁৗছে যাবে তেজোদীপ্ত অশে^র ন্যায়।

মো. মাঈন উদ্দিন: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<26752 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1