শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উৎসব

বাংলাদেশে উৎসব নতুন ধরন ও নব তাৎপযর্ লাভ করেছে। ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জীবনবোধ ও জীবন জিজ্ঞাসার নানা প্রতীকী অথর্ ও উদ্ভাবনাময় ব্যঞ্জনা। বাংলা নববষর্, একুশে ফেব্রæয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, নবান্ন উৎসব ধমর্-বণর্ নিবিের্শষে আমাদের জাতীয় উৎসব। জাতীয় সংহতি, ঐতিহ্যের বিস্তার ও নবায়নে উৎসবের গুরুত্ব তাই অসামান্য। আর ঈদ উৎসব ও দুগোর্ৎসব বিশাল আথর্-সামাজিক বিষয়কে আত্মস্থ করে বহুমাত্রিক তাৎপযর্ লাভ করেছে।
ড. মো. হুমায়ুন কবীর
  ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

উৎসবের আনন্দই আলাদা। যারা উৎসবে যোগদান করেনি তারা এর মাহাত্ম্য বুঝতে পারবে না। উৎসবের আনন্দ মানেই বাঙালির আনন্দ। কারণ উৎসবপ্রিয় জাতি হিসেবে বাঙালির খ্যাতি ও ঐতিহ্য আছে বিশ্বসমাজে। জাতীয় ও আন্তজাির্তক পযাের্য়র উৎসবগুলো বাঙালি ঘটা করেই পালন করে থাকে। উৎসব পালনের ক্ষেত্রে বাঙালি খুবই আন্তরিক এবং অকৃপণ। এ উৎসব প্রিয়তা বাঙালির ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। উৎসব পালনের উৎসাহে এতটুকু ভাটার টান পরিলক্ষিত হয় না কখনো। উৎসব পালন রীতিমতো আজ এক লোকিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যে কোনো উৎসব পাবের্ণ রাস্তা-ঘাটে মানুষের ঢল নামে। মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।

বাঙালির জাতীয় জীবনে যে উৎসবগুলো গুরুত্ব সহকারে পালিত হয় এর মধ্যে ইংরেজি ও বাংলা সনের প্রথম দিবস, অমর একুশে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নবান্ন উৎসব, ঈদ এবং পূজা উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি উৎসবেরই আছে কিছু আদশির্ক বোধ এবং সেই সঙ্গে কিছু সুস্থ বিনোদন। তবু সত্য এই যে, সবগুলো উৎসব বিনোদনের জোয়ারে ভেসে যায় প্রতিবছর।

বাঙালির কিছু রীতি ও কিছু ঐতিহ্য রয়েছে। প্রতিবছর সময়ে সময়ে এগুলোর চচার্ এখনো হারিয়ে যায়নি। অনেক ঐতিহ্যগত বিষয় রয়েছে যা একসময় গ্রামান্তরে পালিত হলেও সেগুলো এখন সময়ের ব্যবধানে আরও বিস্তৃতি লাভ করে শহরাঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে। তেমনি একটি উৎসব হলো বাঙালির নবান্ন উৎসব। প্রতি বছরের মতো এ বছরও পালিত হয়েছে নবান্ন উৎসব। এই উৎসবের প্রধান দিক হচ্ছে নতুন ধান। কৃষকের মাঠে আমনের ধান কাটা শুরু হলে নতুন ধানের গন্ধ সব গ্রামীণ জনপদকে আলোড়িত করে। শুরু হয় মেহমান দাওয়াতের কাজ।

প্রতিবছরের পহেলা অগ্রহায়ণ থেকে শুরু হয় বাঙালির অতি পরিচিত ও ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব। কাতির্ক ও অগ্রহায়ণ নিয়ে হেমন্তকালের শেষ মাস এটি। কাতির্কা ও অগ্রাণী- এ দুটি তারার নামানুসারে মাস দুটির নামাকরণ করা হয়েছে। অগ্র শব্দের অথর্ ধান এবং হায়ণ শব্দের অথর্ কতর্ন। কাজেই অগ্রহায়ণ শব্দের পুরো অথর্ দঁাড়ায় ধান কাটার কাল। আর তাই এদিন থেকেই সারা মাসজুড়ে চলার প্রত্যয়ে শুরু হয় আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব। এবছরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গ্রামীণ মানুষ এতটা আনুষ্ঠানিকতা করতে না পারলেও সেটিকে পুঁজি করে শহুরে বন্ধুরা এখন আর তা ভোলে না। সরকারও এ বিষয়টিকে লালন করার প্রত্যয়ে সদাশয়। তাই কৃষির উন্নয়নের অন্যতম রূপকার ও অগ্রসেনানী কৃষকদের প্রতি সম্মান প্রদশের্নর জন্য সরকার কতৃর্ক অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনটিকে জাতীয় কৃষি ও কৃষক দিবস হিসেবে পালনের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে।

গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নবান্ন উৎসব এখন শহরেও পালিত হয়ে থাকে বেশ ধুমধামে। তারই অংশ হিসেবে পহেলা অগ্রহায়ণে জাতীয় নবান্ন উদযাপন পরিষদ আয়োজন করে নবান্ন উৎসব। এবারো তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ওই দিন সকাল সকাল রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনের বকুল তলায় জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্বোধনের মাধ্যমে তা মাসব্যাপী বিদ্যমান থাকে। আর সেটিকে অনুসরণ করেই সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় একইসঙ্গে শুরু হয়। সে সব উৎসবে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নবান্ন শোভাযাত্রা, আদিবাসী পরিবেশনাসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা সমেত ঢাক-ঢোলের বাদ্য আর বাহারি মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা ও পিঠার আয়োজন। কিন্তু কোনো ধরনের প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আমাদের গ্রাম-বাংলায় গ্রামীণ মা-চাচি-দাদি, গৃহিণী, নববধূরা তাদের বাড়িতে এ নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে। শহরের আয়োজনটি প্রতীকী হিসেবে এক-দুদিনের জন্য হলেও গ্রামেই চলতে থাকে মাসাবধি।

ঋতু ও ফসল পরিক্রমায় বাংলার কৃষিতে রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। তারই অংশ হিসেবে আউশ, আমন, বোরোÑ এ তিনটি ধান। তারমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূণর্ হলো আমন ধান। আমন ধান কাটার সময়টা প্রাকৃতিকভাবে খুবই সুন্দর। হালকা শীত শীত ভাব। চারদিকে মেঘহীন সুন্দর দিগন্তজোড়া আকাশ। সারাদিন মিষ্টি রোদ। বাতাসে শুধু নতুন ফসলের গন্ধ। তা ছাড়া কৃষকের ঘরে একটু অভাব অনটনের পরে বহু আকাক্সিক্ষত এ আমন ফসলটি। কাজেই সে ফসলটি উঠানোর সময় তাদের মুখের হাসি যেন ফুরোতে চায় না। সেই মুখের হাসিকে কাযের্ক্ষত্রে রূপান্তরের একটি বহিঃপ্রকাশ হলো এ নবান্ন উৎসব। নবান্নের এ সময়টাতে গ্রামের এ বাড়িতে ও বাড়িতে পিঠা-পুলির সুগন্ধ যেন আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

এক সময় রাতে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলতে ঢেঁকিতে পিঠার চাল ভাঙার শব্দ শোনা যেত বাড়িতে বাড়িতে। সে সময় দাওয়াত করা হয় দূর-দূরান্তের নিকট আত্মীয়-স্বজনকে, দাওয়াত করা হয় জামাইকে। ডেকে আনা হয় শহরে থাকা কাছের ও আপনজনদের একসঙ্গে নবান্নের পিঠা-পুলির স্বাদ নেয়ার জন্য। মনের মতো এবং যার যার পছন্দমতো পিঠা-পুলি তৈরি করে তা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠানো হয়ে থাকে। সাধারণত এলাকা ও সম্প্রদায়ভেদে এ উৎসব পালনের কিছুটা বিচিত্রতা লক্ষ্য করা যায়। তবে গ্রামীণ জনপদে কমবেশি সব ধমর্-বণর্, শ্রেণি-পেশা, ধনি-দরিদ্র মানুষ সেটা যার যার চাহিদা ও সামথর্্য, সাধ্যমতো আয়োজন করে থাকে। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ কেউ বাদ যান না এ আনন্দ থেকে। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো। এসময়ে কৃষকরা তাদের আমন ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মাঠে মাঠে চারদিকে ধানের ক্ষেতে কৃষকদের ধান কেটে মাথায় করে সেই বোঝা বয়ে আনতে দেখা যায়।

এসময়ে মায়ের হাতের পিঠা বলতে একটি আবেগী ব্যাপার জড়িত থাকে। কারণ দেখা যায় সন্তান যত বড়ই হোক তা সন্তানই থাকে। সন্তানের মনের সাধ যেমন মায়ের মন এড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি এ নবান্নের সময়ে মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকা সব সন্তানই মৌসুমী পিঠার সাধ নেয়ার জন্য মুখিয়ে বসে থাকে। কাজেই এ নবান্ন সময় এলেই নতুন ধানের নতুন চালের পিঠা খাওয়ার জন্য মন আনচান করে ওঠে। খেজুরের রসের ক্ষির, কলা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, হাতে বানানো, সেমাই, মেরা পিঠা, ভাপাপিঠা, চেপা পিঠা, দুধচিতই পিঠা ইত্যাদি আরও কত বাহারি স্থানীয় নামের মজাদার পিঠাই না তৈরি হয় এ সময় মা-চাচিদের হাতে।

কৃষকরা একদিকে ধান কাটে, অন্যদিকে বাড়িতে এসে সেই ধানেরই পিঠা-মুড়ি-মুড়কি খায়। এ যেন এক চিরচেনা দৃশ্য। এ নবান্ন উৎসবের আবার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নাম রয়েছে। বাঙালিদের কাছে যা নবান্ন কোচদের কাছে তা ‘গেটেল চাওয়া’, মান্দিদের কাছে ‘উয়ান্না’, হাজংদের কাছে ‘নয়াখাওয়া’ ইত্যাদি আরও কত কী! নবান্ন নিয়ে কতগান কবিতা বঁাধা হয়েছে। ‘আবার আসিব ফিরে, ধান সিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়, হয়তো মানুষ হয়ে নয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কাতিের্কর নবান্নের দেশে’। আবার গানে গানে, ‘ও ধান বানিরে ঢেঁকিতে পার দিয়া’, ‘শালি ধানের চিড়ে দেব বিন্নি ধানের খই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। নতুন বিভিন্ন স্থানীয় জাতের ঐতিহ্যবাহী ধানের সুগন্ধি চাল দিয়ে এসব পিঠা তৈরি করা হয়ে থাকে।

একেক এলাকায় একেকটি ধানের জাতের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসব ধানের জাতও হারিয়ে যেতে বসেছে এবং দিনে দিনে নবান্নের উৎসবেও এখন কিছুটা ভাটা পড়তে দেখা যায়। কারণ মানুষ এখন আগের চেয়ে দিনে দিনে যান্ত্রিকতার ভিতরে ঢুকে পড়ছে। তারপরও গ্রাম-শহর মিলিয়ে আমাদের সবাইকেই এসব ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। কারণ ঐতিহ্য ছাড়া মানুষের কোনো পরিচয় থাকে না। সেটি ধরে রাখার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এগুলোকে উৎসাহিত করে থাকে সবসময়। বাঙালি ঐতিহ্যের এ বিষয়গুলো এভাবেই সংরক্ষিত হবে দিনের পর দিন। এখন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের বাহারি পিঠা তৈরি করে সেগুলোর প্রদশর্নীর জন্য সারাদেশজুড়ে পিঠামেলা আয়োজন করতে দেখা যায়।

বাংলাদেশে উৎসব নতুন ধরন ও নব তাৎপযর্ লাভ করেছে। ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জীবনবোধ ও জীবন জিজ্ঞাসার নানা প্রতীকী অথর্ ও উদ্ভাবনাময় ব্যঞ্জনা। বাংলা নববষর্, একুশে ফেব্রæয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, নবান্ন উৎসব ধমর্-বণর্ নিবিের্শষে আমাদের জাতীয় উৎসব। জাতীয় সংহতি, ঐতিহ্যের বিস্তার ও নবায়নে উৎসবের গুরুত্ব তাই অসামান্য। আর ঈদ উৎসব ও দুগোর্ৎসব বিশাল আথর্-সামাজিক বিষয়কে আত্মস্থ করে বহুমাত্রিক তাৎপযর্ লাভ করেছে।

সবকিছু মিলিয়ে দেখা যায়, বহুকালের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে উৎসব প্রিয় বাঙালি জাতি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নানা উৎসব পাবের্ণর মাধ্যমে উজ্জ্বল করে রেখেছে। যতোই দিন যাচ্ছে উৎসবপ্রিয়তা বাঙালিদের মধ্যে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে জাতি ধমর্ বণর্ নিবিের্শষে সৌভাতৃত্ব ও গভীর মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে । ব্যক্তিক ও সামাজিক যোগাযোগ বেড়েছে। মানুষ নিজেকে চেনা-জানার সুযোগ পেয়েছে। নিজস্ব কৃষ্টি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারছে। দেশীয় ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এসব উৎসব-আয়োজন খুবই তাৎপযর্পূণর্। এসব উৎসব-আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালির ঐতিহ্য টিকে থাকুক, সেটাই প্রত্যাশা।

ড. মো. হুমায়ুন কবীর: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

শনফযঁসধুঁহ০৮@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<26751 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1