শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াই

অযোগ্য দুনীির্তবাজকে ভোট দিয়ে জাতীয় সংসদের মতো পবিত্র জায়গায় পাঠানোর কোনো মানে হয় না। তাতে দেশে ও জনগণের ক্ষতি হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রও মজবুত ভিতের ওপর দঁাড়াতে পারে না। এটাও মনে রাখতে হবে, যে কোনো নিবার্চন এলেই ভোটারদের মনে জন্ম নেয় আতঙ্ক। অনেক জায়গায় স্থানীয় দলীয় প্রভাবশালীরা প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ মানুষের মতামতকে প্রতিফলিত হতে দেয় না। অস্ত্র ও পেশিশক্তির ব্যবহার এবং নিবার্চনী সহিংসতার ঘটনা আমরা অতীতে অনেক দেখেছি। এবারও হয়তো বা তার ব্যত্যয় ঘটবে না। কারণ ইতোমধ্যে তিন জায়গায় সংঘষর্ হয়েছে।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২১ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

জনপ্রতিনিধি মানে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী বিশেষ ব্যক্তি, যিনি জনগণের দ্বারা নিবাির্চত হন। তাদের সরকারের কাছে যতটা না তার চেয়ে বেশি জবাবদিহিতা করতে হয় জনগণের কাছে। জনগণের দুঃখ-দুদর্শা দেখা ও লাঘব করার দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদেরই। জনগণ উপেক্ষা বা বঞ্চনার শিকার হলে তারা ভবিষ্যতে আর ওই ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ দেয় না। তবে জনপ্রতিনিধিদের কদর আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, জনগণের স্বাথের্ক সংরক্ষণ না করা অথবা প্রধান্য না দেয়া এবং চুরি, দুনীির্তর দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়া। বিশেষ রাজনৈতিক আনুক‚ল্য না পাওয়ার কারণেও অনেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পান না। তবে রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে স্বতন্ত্রপ্রাথীর্ হিসেবে দঁাড়িয়েও অনেকেই বাজিমাত করে দিয়েছেন, কেবল জনগণের ভালোবাসা ও ব্যাপক সমথর্ন পাওয়ার কারণেই।

জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের ও দেশের সেবা করা অতি উত্তম কাজ। কারণ যার মধ্যে দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে সে ব্যক্তিই মহৎ। কিন্তু এ মহত্বের আড়ালে যদি লোভ কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে, লুকিয়ে থাকে প্রতিহিংসা-বিদ্বেষ সেখানেই যত বিপত্তি।

এ দেশে দুভাবে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। জনগণ তাদের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য অনুরোধ করে। প্রাথীর্ অসামথর্্যবান হলে তাকে অথৈর্নতিকভাবে সহযোগিতা করে থাকে। দেখা গেছে, এমনও জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, যিনি একটানা ৩০ থেকে ৩৫ বছর জনপ্রতিনিধিত্ব করে রেকডর্ সৃষ্টি করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা পাওয়ার কারণেই। রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে এ প্রবণতাই আগে বেশি ছিল। যাদের জনগ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। বেশ ক’বছর ধরে আমরা ঠিক এর উল্টো চিত্র দেখতে পাচ্ছি। যার অথির্বত্ত, পেশিশক্তি বা ক্ষমতার দাপট রয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ার যিনি মহাপরাক্রমশালী এবং যার রয়েছে রাজনৈতিক বিশেষ ক্যাডার বাহিনী তিনিই জনপ্রতিনিধি নিবাির্চত হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য এ ধরনের প্রাথীর্ প্রতিপক্ষকে খুন করতেও দ্বিধা করে না। ইদানীং স্থানীয় সরকার নিবার্চনকেও রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি নিবার্চনের ক্ষেত্রে এই যে অসুস্থ রাজনীতির বিপজ্জনক বিস্তার, এর ফলে জনস্বাথর্ বারবার উপেক্ষিত হয়। কেবল সংসদ সদস্য নিবার্চনের ক্ষেত্রেই নয়, তৃণমূল পযাের্য়ও এ উপেক্ষার পালা বাড়ছে। এ দেশে যারা ত্যাগী নেতা তাদের মূল্যায়ন খুব কমই হয়। দেখা যাচ্ছে, যিনি ছিলেন আমলা ব্যবসায়ী অথবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বা পুলিশ কমর্কতার্ তিনি অবলীলায় মনোনয়ন পাচ্ছেন।

জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রবণতা গ্রহণযোগ্য নয়। ২০ বছর আগে যিনি নিজের ও পরিবারের আহার জোগাড় করতে পারতেন না। চেয়ে-চিন্তে খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল দুনীির্ত করার সুযোগ পেয়ে অথির্বত্তে হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। এখন অবস্থা এমন দঁাড়িয়েছে যে টাকা খরচের জায়গা পযর্ন্ত নেই। এ দেশে এমন ব্যক্তিও জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য চরম দুভাের্গ্যর ব্যাপার। তাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতার মধু যতটুকু পারা যায় আহরণ করা। মূল কথা হচ্ছে, এ দেশের অনেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য প্রাণপাত করছেন। এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনেও সে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংসদ সদস্য হওয়ার মধ্যে কী আনন্দ কী লাভ তা কেবল তারাই জানেন। এটা কি জনসেবা নাকি এক স্বপ্নবিলাসী খায়েস। এই খায়েস কেউ যদি পূরণ করতে চায় তাতে আমাদের কী করার আছে? যিনি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য নন, এলাকায় যার কোনো পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা নেই তিনিও মনোনয়নপত্র কিনেছেন। এবার সবচেয়ে বেশি মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছে বিএনপি। তারা বিক্রি করেছে ৪৫৮০টি ফরম। এ বাবদ দলটির আয় হয়েছে ১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ফরম বিক্রিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি বিক্রি করেছে ৪০২৩টি ফরম। এ বাবদ দলটির আয় হয়েছে ১২ কোটি ৭ লাখ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এরশাদের জাতীয় পাটির্। দলটি বিক্রি করেছে ২৮৬৫টি ফরম। দলটির আয় হয়েছে ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া গণফোরাম, জাসদ ইনু, জেএসডি এই ৬টি দল মোট ফরম বিক্রি করেছে ১২ হাজারের মতো। অথচ জাতীয় সংসদে আসন সংখ্যা ৩০০টি। এর সরল অথর্ হচ্ছে একটি আসনের বিপরীতে ৪০ জন প্রাথীর্। এ দেশে সুযোগ পেলে সবাই সংসদ সদস্য হতে চান, হতে চান মন্ত্রী। এই অসুস্থ প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক।

জনপ্রতিনিধি নিবাির্চত হওয়ার পর জনগণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া, তাদের স্বাথের্র পরিপন্থী কাজ করা, প্রতিপক্ষকে হয়রানি করা, এলাকার মহল্লার নগর শহরের উন্নয়ন না করে জনদুভোর্গ বৃদ্ধি করা, চুরি, দুনীির্তর সঙ্গে অবলীলায় জড়িয়ে পড়াÑ এসবেই আমাদের যত আপত্তি। সুযোগের অভাবে এ দেশের অনেকেই সৎ। অথর্-বিত্তের ক্ষমতার লোভ সবারই রয়েছে। এ লোভ সংবরণ করে প্রকৃত জনদরদি হয়ে কাজ করা খুবই কঠিন। এ যেন অগ্নিপরীক্ষা। এমন জনপ্রতিনিধি যে রাষ্ট্রে নেই, তা নয়। আগেই বলেছি অথর্ ও পেশিশক্তির দাপটে তারা অসহায়। অনেক সময় তাদের জীবনও বিপন্ন হয়।

সারা দেশে এখন ভোটের হাওয়া বইছে। রাজনৈতিক দলগুলোও প্রাথীর্ প্রায় চ‚ড়ান্ত করে ফেলেছে। সব দলই অংশ নিচ্ছে এই নিবার্চনে। সবচেয়ে ইতিবাচক ঘটনা হচ্ছে বিএনপি এই নিবার্চনে অংশ নিচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে এবারের নিবার্চন হবে উৎসবমুখর, যদি নিবার্চনী সহিংসতা এড়ানো সম্ভব হয় এবং কোনো দল যদি নিবার্চন বয়কট না করে।

মনে রাখতে হবে জাতীয় নিবার্চনের গুরুত্ব জাতীয় জীবনে অনেক বেশি। কোন দল থেকে কারা সংসদ সদস্য নিবাির্চত হচ্ছে, তার গুরুত্ব অনেক।

অযোগ্য দুনীির্তবাজকে ভোট দিয়ে জাতীয় সংসদের মতো পবিত্র জায়গায় পাঠানোর কোনো মানে হয় না। তাতে দেশে ও জনগণের ক্ষতি হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রও মজবুত ভিতের ওপর দঁাড়াতে পারে না। এটাও মনে রাখতে হবে, যে কোনো নিবার্চন এলেই ভোটারদের মনে জন্ম নেয় আতঙ্ক। অনেক জায়গায় স্থানীয় দলীয় প্রভাবশালীরা প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ মানুষের মতামতকে প্রতিফলিত হতে দেয় না। অস্ত্র ও পেশিশক্তির ব্যবহার এবং নিবার্চনী সহিংসতার ঘটনা আমরা অতীতে অনেক দেখেছি। এবারও হয়তো বা তার ব্যত্যয় ঘটবে না। কারণ ইতোমধ্যে তিন জায়গায় সংঘষর্ হয়েছে। বেশ কয়েকজন মারাও গেছে। এমন ঘটনা প্রত্যাশিত নয়।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বারবার বলে আসছিল এই সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নিবার্চন সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ ভেঙে দিতে হবে, করতে হবে নিবার্চন কমিশন পুনগর্ঠন। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে নিবার্চন অনুষ্ঠিত হলে সরকার রাজনৈতিকভাবে নিবার্চনকে প্রভাবিত করতে পারে। তাদের যত অভিযোগই থাকুক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে তারা নিবার্চনে যাচ্ছে। ড. কামাল হোসেন তো স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, যত বাধাই আসুক না কেন তারা নিবার্চন করবেই।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের এবারে নিবার্চন অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্। সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রকামী মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এই নিবার্চনের জন্য। এই নিবার্চন অবাধ সুষ্ঠু হোক। সবার অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হোক। নিবার্চনের নামে কোনো ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতা, অবৈধ অথের্র ব্যবহার এ দেশের মানুষ আর দেখতে চান না। দেখতে চায় না সংখ্যালঘু নিযার্তন। কারণ ২০০১ সালের নিবার্চন পরবতীর্ পরিস্থিতির কথা সবারই মনে আছে। ওই সময়ে এ দেশের সংখ্যালঘুরা যেভাবে নিযার্তনের শিকার হয়েছিল তা নজিরবিহীন। ওই ভয়াবহ ক্ষত আমাদের জাতীয় জীবন থেকে এখনো মুছে যায়নি। আমরা এর পুনরাবৃত্তি স্বাধীন বাংলাদেশে আর প্রত্যক্ষ করতে চাই না।

আমরা চাই একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনের মাধ্যমে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হোক। দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাক, দেশের মানুষ শান্তিতে স্বস্তিতে বসবাস করুক। সুষ্ঠু নিবার্চন ছাড়া গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ভিত শক্তিশালী হয় না। দেশের নিবার্চনী ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার মাধ্যমেই কেবল দেশের সামগ্রিক শাসনপ্রণালি ও উন্নয়ন মজবুত ভিতের ওপর দঁাড়াতে পারে। এবারের নিবার্চন নিয়ে আমরা আশাবাদী।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<23352 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1