বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমজনতা জিডিপির সুফল পায় কতটুকু?

জিডিপি বাড়লেও এ সব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না, যার কারণে তাদের আয়ও বাড়ছে না। শ্রমজীবী মানুষের আয় বৃদ্ধি না পেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১৭ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

বতর্মানে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ২৭ হাজার ৪১১ কোটি ডলার। টাকার অংকে এর পরিমাণ দঁাড়াবে ২২ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। গত ২০ বছর আগের দেশের জিডিপির আকারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় বেশ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জিডিপির বৃদ্ধির হার অনুসারে বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত অথর্নীতির কোনো দেশ থেকে পিছিয়ে নেই। বিশ্বের উন্নত ২০টি দেশের অথর্নীতির প্রবৃদ্ধি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অথর্নীতিও অনুরূপ। দেশের বতর্মান সময়ের হিসাবে এ বছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ প্রায় হবে। তাই বলা হচ্ছে ২০১৮-১৯ অথর্বছরে জিডিপি অজির্ত হবে ৭.৮ অথ্যাৎ প্রায় ৮ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক ইকোনমিক প্রসপেক্টাসের মতে ২০১৮-২০২০ সালের অথর্বছরগুলোতে গড়ে ৬.৭ অথর্্যাৎ প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অজির্ত হবে। বাংলাদেশের জিপিডি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রতি বছরই তার ইতিবাচক ২০১২-১৩ সালের জিপিডি ছিল ৬.০১ শতাংশ, ২০১৩-১৪ সালে তা দঁাড়ায় ৬.০৬ শতাংশ, ২০১৪-১৫ সালে তা হয় ৭.২৪, ২০১৭-২০১৮ সালে দেশের জিডিপি ছিল ৭.৪০। এই ক্রম বধর্মান জিডিপিতে বুঝা যায়, দেশের এৎড়ংং উড়সবংঃরপ চৎড়ফঁপঃ বৃদ্ধি পেয়েছে। জিডিপি বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাথা পিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এখন মাথা পিছু আয় ১৭৫১ ডলার। অথর্্যাৎ একজন মানুষ বছরে এখন ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৯ টাকা আয় করে। মাথাপিছু আয় কিন্তু কোনো একক ব্যক্তির আয় নয় । দেশের মোট আয় কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যে গড় পাওয়া যায় তা হলো মাথাপিছু আয়। বাংলাদেশের বতর্মান সাবির্ক অথর্নীতির অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে, দেশের সমষ্টিক অথর্নীতি স্ফিত হচ্ছে। তাই বলা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য আয়ের পথে এগিয়ে চলেছে। দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছে এটা ঠিক, তবে এই মধ্যম আয়ের দেশের সুফলটা কজনের ভাগ্যে জুটছে তা এখন দেখার বিষয়। যাদের শ্রমে এই মধ্যম আয়ের দেশ, সেই শ্রমজীবীদের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বিশ্বের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান অষ্টম। ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ দুই অংক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে বতর্মানে বিদেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পায় তা মোট জাতীয় আয়ের ১১ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অথর্বছরে উপসাগরীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশি যাওয়ার হার বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে বেশি লোক উল্লিখিত অথর্বছরে কাজ করতে গিয়েছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এই দেশগুলোত যে বাংলাদেশি শ্রমজীবীরা আছেন তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশই নারী। এই দেশগুলোতে কমর্রত বাংলাদেশিদের বেতন অন্য দেশের চাইতে কম দেয়া হয় । এই দেশগুলোতে একই কাজ করে এমন চাকরিতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিকের চাইতে বেশি বেতন পেয়ে থাকেন ভারতীয় একজন শ্রমিক। একটি পরিসংখ্যন থেকে জানা যায় , মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৩ লাখ ৪৯ হাজার, কুয়েতে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৬২১ জন, বাহরাইনে ৩ লাখ ১৫ হাজার, ইরাকে ৩৬ হাজার, লেবাননে ১ লাখ ৩৬ হাজার ও জডাের্ন ১ লাখ ৩ হাজার ২৭০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। এ ছাড়াও আফ্রিকার লিবিয়াতে ১ লাখ ২২ হাজার, সুদানে ৮ হাজার ৫২২, মিসরে ২১ হাজার ৬৯০, মারিশাসে ৪০ হাজার ৯৮৫ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার ৭০ জন, ইতালিতে ৫৫ হাজার ৫১৪ জন বাংলদেশি শ্রমিক কাজ করে থাকেন । এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়ায় ৭ লাখ ১০ হাজার, সিঙ্গাপুরে ৫ লাখ ৮৫ হাজার, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩৩ হাজার ১১৫, জাপানে ১০ হাজার ৩৮৬, ব্রæনাইয়ে ৫১ হাজার ৩৩৪ জন, এ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এক লাখ ১০ হাজার ২০৩ জন বাংলাদেশি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। একটি তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৭৬ সাল থেকে এ পযর্ন্ত ৯৫ লাখ ৭৬ হাজার ১১২ জন শ্রমিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রম বিনিয়োগ করছে। বিদেশ গমনকারী শ্রমিকরা সবাই নিম্ন ও নিম্নবিত্ত পরিবারের, আর এই শ্রমজীবীদের শ্রমের বিনিময়ে অজির্ত বৈদেশিক মুদ্রাই জিডিপিকে স্ফিত করছে আর দেশের অথর্নীতি ধারণ করছে বৃহৎ আকার।

দেখা যাচ্ছে, বৃহৎ আকারের অথর্নীতির বিস্তৃতিটা দেশের অভ্যন্তরে কতটা অথর্ প্রবাহ ঘটিয়েছে নাকি অজির্ত অথর্ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সম্প্রতি একখানা জরিপে দেখা গেছে, নিম্নবিত্ত দেশের মোট জনসংখ্যার ৫% এর যে আয় তা মোট জিডিপির ২৩ শতাংশ। অথচ এই জনগোষ্ঠীর ২০১০ সালে মোট জিডিপির ৭৮ শতাংশ। বতর্মানে জিডিপির কলেবর বেড়েছে সেই হিসাবে উল্লিখিত জনগোষ্ঠির জিডিপির অবদান বাড়েনি। বরং তাদের জিডিপিতে অংশীদারিত্ব কমেছে তিনগুণ। ২০১০ সালে দেশের অতি গরিব ১০ শতাংশ মানুষের জিডিপিতে অবদান ছিল ২ শতাংশ সেই জনগোষ্ঠীর বতর্মানে জিডিপিতে অবদান হয়েছে ১ দশমিক ১ শতাংশ। এতে প্রতীয়মান হয় যে, দেশের নিম্নবিত্ত এবং গরিব মানুষের আয় তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসাবে চিহ্নিত ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের জিডিপিতে ২০১০ সালে অবদান ছিল ১৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ । বতর্মানে সেই আয়ের অবদান দঁাড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশে। দেশের জিডিপির কলেবর বৃদ্ধি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা ধনী তারা আরো অধিক ধনী হচ্ছেন আর যারা গরিব তারা ক্রমেই গরিব থেকে গরিবেতর হচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ যারা তারা জিডিপির ২৭ শতাংশ। একটি জরিপে দেখা গেছে, জাতীয় পযাের্য় যারা ধনী এমন ধনী পরিবারের খানাপ্রতি প্রত্যেক সদস্যের মাসিক আয় দঁাড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকা অথচ ছয় বছর আগে এ ধরনের পরিবারে সদস্য প্রতি মাসিক আয় ছিল ৮৩ হাজার ৬০৫ টাকা। ছয় বছরে ধনীদের আয় বেড়েছে ৬.০৪ শতাংশ। ২০১২ সাল থেকে এ পযর্ন্ত গত পঁাচ বছরে দেশের ধনকুবের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ শতাংশ হারে। বাংলাদেশে অতি দ্রæত হারে ধনকুবের হওয়ার হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অথর্নীতির দেশের চাইতেও শীষের্। ১২-৯-২০১৮ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোর তথ্যর ভিত্তিতে জানা যায় , অতি ধনকুবের হার বাড়ার তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রে ৮.১ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮.৪ শতাংশ, ইসরালে ৯.৬ শতাংশ, আয়ারল্যান্ডে ৯.১ শতাংশ, হংকং এ ৯.৩ শতাংশ, ভারতে ১০.৭ শতাংশ, কেনিয়ায় ১১.৭ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১২.৭ শতাংশ, চীনে ১৩.৪ শতাংশ আর বাংলাদেশে এই হার হলো ১৭.৩ শতাংশ। এদিকে গ্রামীণ শ্বেত দরিদ্রতার হার বাড়ছে। অপরদিকে দেশের অথর্ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। দৈনিক যুগান্তরে ৩০ জুন, ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে এদেশ থেকে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। গত তিন বছর আগে জিএফআইয়ের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বের ১৯০টি অথর্ পাচারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ২৬তম। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশের মোটা অংকের অথর্ পাচার হয়ে যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে প্রায় সেই পরিমাণ টাকাই বিদেশে পাচার হয়ে যায়। অনেকেই মনে করেন, দেশের ভেতর বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা আর শিল্প বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় ব্যবসায়ী এবং এ দেশের ধনীরা বিদেশে জমি কিনছেন আর ব্যবসা গড়ে তুলছেন।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণে বেকারত্ব বাড়ছে। মানসম্মত শিক্ষা না পেয়ে এ দেশের জনসম্পদ দক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না, বেকারত্বের হার বাড়ছে। এই বেকারত্ব থেকে বঁাচার জন্য ও জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের জনসম্পদরা কায়িক শ্রম বিনিয়োগ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছে। এই বিপুল শ্রম শক্তি বিনিয়োগের পরও দিন দিন বিদেশি রেমিট্যান্স কমছে তার অন্যতম কারণ বাংলাদেশীরা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূণর্ শিক্ষা পাচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ যারা গ্রামের বাস করছে তারা বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আর এই কারণে প্রবাসে গিয়েও তাদের মজুরি কম।

জিডিপি বাড়লেও এ সব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না, যার কারণে তাদের আয়ও বাড়ছে না। শ্রমজীবী মানুষের আয় বৃদ্ধি না পেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22754 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1