শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নদীকে চলতে দাও নদীর পথে

পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই প্রকৃতি ভাঙ্গা ও গড়ার খেলা খেলে আসছে। নদীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটছে না। নদীর পানিপ্রবাহ কমে পলি জমে ভরাট হওয়ার পাশাপাশি দখলের প্রতিযোগিতা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। নদীর বুকের ওপরেই নিমার্ণ করা হচ্ছে বিশাল বিশাল দালান। এক কথায় কোথাও নদ-নদী তার আপন গতিতে চলতে পারছে না। ফলে নদী নাব্য হারিয়ে ফেলছে এবং নদীভাঙন হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
  ১৬ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

প্রকৃতি পরিবতর্নশীল এবং এটিই প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম। প্রকৃতির নিয়মের বাহিরে কিছু ঘটাতে গেলে এর প্রতিদান প্রকৃতি নিজেই দিয়ে থাকে যার ফল বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুযোর্গ। মানুষ তার স্বাথের্র জন্য প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে আসছে ফলে প্রকৃতিতে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন দুযোর্গ। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ, বাংলার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে শত শত নদী। বাংলাদেশের প্রবাহিত প্রায় সব নদ-নদীই আন্তজাির্তক সীমানা অতিক্রম করেছে। হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমা অতিক্রম করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সবের্শষ বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ায় এদেশের নদীর সংখ্যা অনেক বেশি। একসময় বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ১১০০ নদী ছিল কিন্তু ক্রমাগত পলি জমে ভরাট (চড় পড়া), দূষণ এবং দখলের কারণে বতর্মানে নদীর সংখ্যা ৪০৫টিতে পৌঁছেছে। গত প্রায় তিন দশকে অসংখ্য নদ-নদী দেশের মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর এই বিলীন হওয়া যতটা না প্রাকৃতিক কারণ, তারচেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট। মানুষ তার নিজ স্বাথের্ একের পর এক নদ- নদীগুলোকে হত্যা করছে। আজকে আমাদের দেশে নদী হত্যা যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশের সীমানার মধ্যে এমন কোনো নদী নেই যেখানে ভ‚মিখেকো দস্যুর দলের হাত পড়েনি। পদ্মা থেকে মেঘনা, করতোয়া থেকে ইছামতি, নরসুন্দা থেকে ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যাÑ সবর্ত্রই যেন চলছে দখলের মহোৎসব। ‘নদী দখল’ লিখে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করলে চোখের সামনে সহস্রাধিক নদী দখলের চিত্র চলে আসে।

পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই প্রকৃতি ভাঙ্গা ও গড়ার খেলা খেলে আসছে। নদীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটছে না। নদীর পানিপ্রবাহ কমে পলি জমে ভরাট হওয়ার পাশাপাশি দখলের প্রতিযোগিতা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। নদীর বুকের ওপরেই নিমার্ণ করা হচ্ছে বিশাল বিশাল দালান। এক কথায় কোথাও নদ-নদী তার আপন গতিতে চলতে পারছে না। ফলে নদী নাব্য হারিয়ে ফেলছে এবং নদীভাঙন হচ্ছে।

স¤প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে কয়েক হাজার পরিবারের সবর্স্ব। ভেঙে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, রাস্তাসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও নদীতে স্রোত না থাকায় কচুরিপানা ও ময়লা জমে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটছে। নদ-নদীর প্রাণশক্তি ক্রমাগতভাবে কমে যাওয়ায় পরিবেশগত বিপযর্য় ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একযোগে দখলমুক্ত করে নদী বঁাচানোর কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। সময়টা টারশিয়ারি যুগেরও বহু বছর আগের, এই জায়গাটায় ছিল শুধুমাত্র সমুদ্র। টেকটনিক সঞ্চালনের পরে হিমালয় এবং উঁচু পাহাড়গুলো থেকে পানির ধারা নিচুতে প্রবাহিত হতে শুরু করে, ফলে এই পদ্ধতিতে হিমালয়ে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য নদীর। এর মধ্যে সব থেকে খ্যাত হলো আমাদের পদ্মা, যা কিনা ভারতসহ সবখানে গঙ্গা নামেই অধিক পরিচিত। এসব ছোট ছোট ধারা মিলে গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে গঙ্গার উৎপত্তি যার শেষ অবস্থান বঙ্গোপসাগর। গঙ্গা ছাড়াও ক্রমাগত ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ অনেক নদী ভারত হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং চর জমতে জমতে তৈরি হয়েছিল আমাদের বঙ্গ দেশ বা বাংলাদেশ। যদিও ব-দ্বীপ একদিকে যেমন উবর্র ভ‚মির জন্য বিখ্যাত, কিন্তু কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। বসবাসের অযোগ্য হওয়ার কারণ হলো, যখন দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া সম্পূণর্ শেষ হয়ে যাবে তখন নদী-নালা বিলুপ্ত হয়ে এটি মরুভ‚মিতে পরিণত হবে। অথার্ৎ, ধীরে ধীরে পলি জমে নদীর মোহনা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে নদীগুলো ছোট হয়ে যাবে। আসলে তখন নদী অন্য কোনো সহজ পথ অবলম্বন করে চলবে। ফলে পুরনো পথের আশপাশের এলাকায় শুরু হবে মরুকরণ এবং নতুন পথ খুঁজতে শুরু করলে শুরু হবে বন্যা, যা বতর্মানে বাংলাদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। এভাবেই ব-দ্বীপ বাসের অনুপযোগী হয়। উদাহরণ হলো মিশরের সভ্যতা। মিশরে আগে নীল নদের পাশে দারুণ সুন্দর উবর্র জমি ছিল আর ছিল পানির নিমর্ল প্রবাহ। তখন মিশরও ছিল আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশ যা আজ আর নেই। বাংলাদেশের এমন পরিণতি হতে আরও অনেক দেরি ছিল। কিন্তু দেশের মানুষগুলো যেভাবে নদী দখল করছে বাংলাদেশও মরুকরণ হতে খুব বেশি দেরি নেই।

জলবায়ু পরিবতের্নর প্রভাব মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকার ‘ইধহমষধফবংয উবষঃধ চষধহ ২১০০’ প্রকল্পটি হাতে নেয়। এই প্রকল্পের ফলাফল রচিত হবে ৫০ থেকে ১০০ বছরের একটি সমন্বিত এবং টেকসই পরিকল্পনা কাজের ওপর ভিত্তি করে। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য, আমাদের নিরাপদ জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা এবং দেশের অথর্নীতির চাকাকে সচল রাখা। এই প্রকল্প বান্তবায়নের জন্য ২০১২ সালেই বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়াও ২০১৩ সালের ২২ জুলাই, নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প-কারখানা কতৃর্ক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নিমার্ণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাসহ আথর্-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠনের মধ্যদিয়ে ‘জাতীয় নদী কমিশন আইন, ২০১৩’ প্রণীত হয়। এক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং পরিবেশবাদী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একত্রে কাজ করছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোডের্র তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনরোধ, বালাসি-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি চলাচলের জন্য নদীতে ড্রেজিং ও জেলাকে বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বঁাধটি মেরামতে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। দুটি সংবাদপত্র প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, ভোলায় নদীভাঙন রোধে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার কাজ এবং মেঘনার ভাঙন রোধে ৪৩২ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ফলে এবার বষার্ মৌসুমে বেশ কয়েকটি এলাকা প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছে।

শুধু সরকারি এবং বেসরকারি প্রচেষ্ঠা থাকলেই হবে না সাধারণ জনগণকেও সোচ্চার হতে হবে। এক্ষেত্রে নদীর আশপাশের এলাকায় সাময়িক বাড়ি-ঘর বা মোবাইল বিল্ডিং তৈরি করা যেতে পারে। এই পদ্ধতির ঘর-বাড়ি বন্যা বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুযোের্গর সময় স্থানান্তর করা যায়, ফলে ক্ষতির পরিমাণ কম হবে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোডর্ ইউনিভাসিির্ট বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<22631 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1