রোববার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুবির্পাকে

সরকারের সুন্দর ভাবমূতিের্ত আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর এবং প্রশাসনের কতিপয় অসৎ সদস্য কলঙ্কের কালিমা লেপে দিচ্ছে। এরা মনে করছে দুবর্ল সরকার টিকে আছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তির বলেÑ তাদের এই মনোভাব তাদের বেপরোয়া ও দুনীির্ত করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি পরিহার করা দরকার।
সৈয়দ জাহিদ হাসান
  ১২ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুবির্পাকে

এ কথা বললে কেমন শোনাবে জানি না, তবে কথাটা ঠিক, বাংলাদেশে এ মুহূতের্ সকলেই ভ্রান্তির মধ্যে আছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, ক্ষমতার বাইরের অবস্থানকারী দলসমূহ এবং সাধারণ মানুষÑ কেউই আজ ভ্রান্তিমুক্ত নয়। যখন আমাদের সমস্ত ভ্রান্তি, সমস্ত দুবর্লতা ঝেড়ে-মুছে দুবার্র গতিতে এগিয়ে চলার কথা সে-মুহূতের্ এরকম নেতিবাচক মনোভাব লালন করাকে পলায়নপর মনোবৃত্তিরই পরিচায়ক বলে মনে হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই কোনো কিছু সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। গবেষণার চেয়ে গুজবেই বাংলার মানুষ বেশি বিশ্বাসী। এ কথার প্রমাণ হিসেবে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চঁাদে দেখার গুজব কিংবা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের শিক্ষাথীের্দর হত্যা-ধষর্ণ ও নিযার্তনের গুজব দুটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সাঈদীকে চঁাদে দেখার গুজবে প্রায় ২৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শিক্ষাথীর্ নিযার্তনের গুজবে বেকায়দায় পড়তে গিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।

গুজব তারাই বিশ্বাস করে যারা নিবোর্ধ ও ভ্রান্তি-আক্রান্ত। বাংলাদেশে নিবোর্ধ মানুষের সংখ্যা তখনই বেশি বেড়ে যায়Ñ যে সময়ে দেশ ও জাতি জটিল সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয় কিংবা নিপতিত হয় সীমাহীন সংকটের ভেতর। আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন দেখতে চাই, কেমন দেখতে চাই আমাদের সাবির্ক জীবনমান এবং আমাদের প্রত্যাশিত জীবনধারা কার বা কাদের পক্ষে পরিবতর্ন করা সম্ভবÑ এসব প্রশ্ন নিজের ভেতর উত্থাপন না করেই পরের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চিন্তা মতো আমরা গড্ডলের মতো এগিয়ে যাই। আমরা ভুলেই যাই সরকার আমাদের সেবক। আমরা সাধারণ মানুষ যা চাইব সরকার আমাদের সেভাবেই সেবা দিতে বাধ্য। অথচ বাস্তব অবস্থা সম্পূণর্ ভিন্ন ধরনের। এখন দেখা যাচ্ছে সরকার সেবক নয়, শাসক। জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস নয়, সবার্ংশে ক্ষমতাহীন। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না, তবু হচ্ছে। আর এটা যে কারণে হচ্ছে তার নাম-ভ্রান্তি। ‘ভ্রান্তি’ আজ আমাদের চারপাশ দখল করে নিয়েছে। আমাদের মেধা-মনন-মিডিয়া, মানসিকতা সবকিছুই আজ ভ্রান্তির দখলে। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ ভ্রান্তির কলধ্বনি শোনা যাচ্ছে। নিবার্চন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই ফেনিয়ে উঠছে জোট ও ভোট ভ্রান্তি। ভ্রান্তির পরিণাম অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। অচেতন মানুষের সবর্স্ব লুটে নেওয়া যেমন সহজ, তেমনি ভ্রান্তিমগ্ন মানুষের ধন-প্রাণ-বুদ্ধিহরণও সহজ ব্যাপার। ভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করতে না পারলে উন্নত দেশ-জাতি ও জীবনমান আশা করা শুধু হাস্যকরই নয়, সেটাও আরেকটা মহাভ্রান্তি।

বাংলাদেশের সামনে এখন দারুণ দুঃসময় উপস্থিত। একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনকে কেন্দ্র করে দিনে দিনেই সংকট ঘনীভ‚ত হচ্ছে। নিবার্চন এলে বিশ্বের সবদেশেই সংকট কম বেশি অনুভ‚ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সংকট রূপ নেয় সংঘাতে। এই সংঘাত আমরা ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। গরিব রাষ্ট্রে খাদ্যের লোভের চেয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষমতার লোভ বেশি দেখা যায়। এর কারণ হলোÑ ক্ষমতা থাকলে খাদ্য, অথর্, ভোগবিলাসিতা সবই হাতের কাছে পাওয়া যায়। তাই মেথর হওয়ারও যার যোগ্যতা নেই সেও হতে চায় রাজমন্ত্রী। শুধু বিরোধিতার জন্যই কেউ যদি বিরোধিতা করতে চায়, তাহলে তার সঙ্গ এড়িয়ে চলাই ভদ্র লোকের কাজ। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের অবস্থা পুরোটাই ভিন্ন রকম। এখানে শুধু বিরোধিতাই মূল কথা নয়, বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ষড়যন্ত্রকারীদের, মুখোশ পরা মানুষদের, ভÐ-প্রতারক-শয়তানদের নিভর্য় লীলাভ‚মি। ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু সরকারের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করছে বিষয়টি তা নয়, তারা বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ঊধ্বর্গতিকে রোধ করার জন্য দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। সবুজ অরণ্য আর কোমল পলি মাটির বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রীরা একদা যে সম্মান ও সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য, তারা সে সুযোগ নানা কারণেই কাজে লাগাতে পারেনি। এদেশের বহু সমাজতন্ত্রী বিদেশের টাকায় দলীয় কমীের্দর বঞ্চিত রেখে নিজের আখের গুছিয়েছেন। দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকেও আড়ালে-আবডালে প্রয়োজনমতো সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। পরে যখন মুখোশ খুলে যাবার উপক্রম হয়েছে, তখন হয় তিনি চুপ হয়ে গেছেন, নয়তো সরকারি দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছেন।

একজন বিপ্লবী কখনোই আদশের্ক বিক্রি করেন না, অথচ বাংলাদেশের বিপ্লবীরা আদশর্ বিক্রি না-করে থাকতেই পারেন না। অতীতের তীব্র বিপ্লবীরা এখন বেশিরভাগই বিক্রীত দাস। এটাও কি ভ্রান্তিবিলাস নয়? অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন আজকের ‘উন্নত বাংলাদেশ’ এটা সময়ের কারণেই সম্ভব হয়েছে। অথার্ৎ ভাবখানা এমন যেন, সময়ই ঠেলে ঠেলে বাংলাদেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের জন্য পলিসির দরকার নেই, অথের্র দরকার নেই, রাজনৈতিক স্থিরাবস্থার দরকার নেই, উন্নত ক‚টনীতির দরকার নেই। যারা বলেন বাংলাদেশের এগিয়ে চলার প্রধান কারণ ‘সময়ের দাবি’, তাদেরকে বলবÑ পাকিস্তান পিছিয়ে যাচ্ছে কেন? পাকিস্তানের সময় কি সামনে না-এগিয়ে পেছনের দিকে ছুটছে? ২০০৮ সালের বাংলাদেশে যে-সংকটগুলো ছিল দশ বছর পরের বাংলাদেশে অথার্ৎ ২০১৮ সালের বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই সংকটগুলো আরো বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমরা আশ্চযর্ হয়ে লক্ষ্য করছি আমাদের সংকটগুলো আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় আমাদের এখনও ত্রæটি থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এবং প্রশাসন ব্যবস্থা যদি সবার্ংশে স্বাধীন ও দুনীির্তমুক্ত করা যেতো তাহলে এখনকার বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে সত্যিকারের মডেল বলেই পরিগণিত হতো।

সরকারের সুন্দর ভাবমূতিের্ত আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর এবং প্রশাসনের কতিপয় অসৎ সদস্য কলঙ্কের কালিমা লেপে দিচ্ছে। এরা মনে করছে দুবর্ল সরকার টিকে আছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তির বলেÑ তাদের এই মনোভাব তাদের বেপরোয়া ও দুনীির্ত করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি পরিহার করা দরকার।

আইনের শাসন না থাকলে উন্নয়নের ঢোল পিটিয়ে লাভ হবে না। আমি জানি না বতর্মান সরকার নিজেকে কোনো কারণে দুবর্ল ভাবেন কিনা, সরকারকে এখন আর নিজেকে দুবর্ল ভাবার প্রয়োজন নেই। সরকারের দুবর্ল মানসিকতার সুযোগ নিয়ে আজ অনেকেই অনৈতিক সুযোগ নিচ্ছেন। এই অনৈতিক কমর্কাÐের দায় পড়ছে সরকারের ওপর। যে পাপ সরকারের নয়, সরকার কেন সেই পাপের শাস্তি বহন করবে?

ষোলো কোটি মানুষের শক্তিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও প্রশাসনের গুটি কয়েক অসৎ সদস্য যদি অস্বীকার করতে চান, তাহলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যারা খেয়ে-পরে থাকেন এবং সেই জনগণকেই যারা প্রতারণা করার স্পধার্ দেখান তারা যত শক্তিশালীই মনে করুন নিজেকে, আসলে তারা শক্তিহীনই। অন্যায়কারীকে তার অন্যায়ের জন্য কঠিন শাস্তি দিতে হবে। সরকারের মান-মযার্দা ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা যারা মসিময় করতে চায় তাদের ক্ষেত্রে ভ্রান্তি নয়, শাস্তিই জনপ্রত্যাশা। দুঃসময়ে কোনো ভ্রান্তি নয়, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাহসের সঙ্গে সত্য পথে এগিয়ে যেতে হবে। কেননা সত্যই চিরস্থায়ী।

সৈয়দ জাহিদ হাসান : কবি ও কথাশিল্পী

ংুবফলধযরফযধংধহ২৯@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে