বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যা

আসলে মন ও মগজ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে যারা আত্মহত্যা করেন তারা সুস্থ নন। সুস্থমনের মানুষের কথা হলো ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে।’ সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে যারা অকালে চলে যান তারা সুস্থ নন। মানুষের চেষ্টা যত বেশি সময় এ পৃথিবীতে থাকা যায়। মানুষ বেশিদিন বেঁচে থাকার কৌশল সেই আদ্যিকাল থেকে বের করে চলেছে। বেঁচে থাকার পথে মানুষের মূল অন্তরায় হলো রোগব্যাধি।
আবদুল মতিন খান
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের রীতি অনুসরণ করে শুরু করা যায়। শিক্ষক ছেলেমেয়েদের একটি বিষয়, ধরা যাক সন্ধি অথবা কারক, সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনার পর ছাত্রদের মাথায় কতটা ঢুকেছে দেখতে প্রশ্ন করতে পারেন সন্ধি অথবা কারক কয় প্রকার ও কি কি। হত্যা ও খুন-খারাবি বাংলাদেশে ও বিশ্বে হালে এত বেড়েছে যে সংবাদ মাধ্যমের বেশ অনেকটা জুড়ে থাকে এর বিবরণ। কতভাবে ও কত কায়দায় যে হত্যা সংঘটিত হয় তার তাল রাখা কঠিন। খুন যতভাবে এবং যত কারণেই ঘটুক সেগুলোকে অনায়াসে দুই ক্যাটেগরিতে ফেলা যায় যথাÑ ১. অন্যকে হত্যা এবং ২. নিজেকে হত্যা।

হত্যা হলো চরম একটি ব্যবস্থা। অনেক রকম ব্যবস্থা একের পর এক ব্যথর্ হওয়ার পর উপায়ান্তর না দেখে সবের্শষ এই ব্যবস্থাটি নেয়া হয়। এটা ব্যক্তির দ্বারা হতে পারে, পারে জাতির দ্বারাও। মাও সে তুং বলেন হত্যা হলো দ্ব›দ্ব নিরসনের সবোর্চ্চ ও সবর্ শেষের ধাপ। একজন যখন অন্য কাউকে খুন করে বুঝতে হবে খুনের অব্যবহিত পূবের্ সে এই সিদ্ধান্তে পেঁৗছে যে অন্য কোনো উপায়ে বা পথে হত্যা করতে যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে তার দ্ব›েদ্বর সুরাহা হবে না। দোষ প্রমাণিত হলে অপরাধের জন্য তার যে ফঁাসি হতে পারে জানা থাকা সত্তে¡ও ওই মুহ‚তের্ সেকথা সে বেমালুম যায় ভুলে। খুনের পর পরই কথাটা তার স্মরণে আসে বলে সে পালিয়ে যায় এবং আত্মগোপন করে।

অনেক ক্ষেত্রে খুনি পালায় না। খুনের জায়গাটাতেও থাকে না গণপিটুনির ভয়ে। খুনের পর সে সোজা চলে যায় থানায়। কেন খুন করেছে জানাতে। পুলিশের প্রশিক্ষণ হলো অপরাধীর কথা ফেস ভ্যালুতে গ্রহণ না করা। আদতে কি ঘটেছে সেটা বের করতে পুলিশ তার নিজস্ব কৌশল প্রয়োগ করে। কৌশলটি হলো ইন্টারোগেশন বা জিজ্ঞাসাবাদ। জিজ্ঞাসাবাদের চক্করে পড়লে ঝানু অপরাধী শেষ পযর্ন্ত কিছু গোপন রাখতে পারে না। অপরাধী সমাজের খুব সম্মানিত ব্যক্তি হলে এবং তার জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে তার পক্ষে ঝানু ও ঝুনা উকিল দিয়ে ধরণা দেয়া হলে আদালত পুলিশকে জেল গেটে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নিদের্শ দিতে পারেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদ জিজ্ঞাসাবাদই, সেটা থানায় হোক কিংবা হোক জেল গেটে।

যে সব অপরাধী খুনের পর পালিয়ে যায় এবং ধরা না দিতে আত্মগোপনে থাকে তাদের ঝানু বাম রাজনৈতিক কমীর্র মতো পালিয়ে থাকার কৌশল জানা না থাকায় তারা অচিরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পুলিশ তার নিকটজন ও বন্ধু-বান্ধবের ঠিকানায় হানা দিয়ে তাকে ধরে ফেলে। হালে গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। যারা গুম হয়ে গেছেন তাদের বাড়ির লোক এবং নিকটাত্মীয়রা বলছেন সাধারণ পোশাকে একদল লোক এসে নিজেদের আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে তাকে অপেক্ষমান মাইক্রোবাসে তুলে চোখ-মুখ কালো কাপড়ে ঝটপট বেঁধে নিয়ে গেছে। থানায় খেঁাজ নিতে গিয়ে গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনরা জেনেছেন যে তাদের থানায় ওই লোককে আনা হয়নি। যাদের ভাগ্য ভালো তারা কিছুদিন গুম থাকার পর ঘরে ফিরতে পেরেছেন। ফেরার পর তিনি কোথায় ছিলেন এবং কারা তাকে কেন ধরে নিয়ে গিয়েছিল সে সম্পকের্ কাউকে কিছু বলেন না। তবে এরকম ভাগ্য অধিকাংশের হয় না। গুম হওয়া অধিকাংশ ব্যক্তি গুম হয়েই থাকেন। এদের দুই একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অপরাধী ধরতে বেরিয়ে গভীর রাতে ক্রস ফায়ারে মারা যান। এ সব কাহিনী সংবাদপত্র ও টিভিতে মাঝেমধ্যেই প্রকাশ পায়। সবারই এগুলো জানা। এগুলো সব অন্যকে হত্যার পযাের্য় পড়ে।

ব্যাপক আকারে অন্যকে বা অন্যদের হত্যার ঘটনা প্রতি দশকে সংখ্যার দিক থেকে নেহাত কম হবে না। ব্যাপক এ হত্যাকÐগুলো ঘটনায় তারা যাদের মারণাস্ত্র গুণে-মানে ও সংখ্যায় প্রতিপক্ষরগুলোকে থাকে ছাড়িয়ে। এরূপ মারণাস্ত্রের অধিকারী নিজেকে পরাশক্তি বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। তথাকথিত এই পরাশক্তি শক্তিহীনদের ধমক ধামকি দিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। এটা সে করে তার অভ্যন্তরীণ তাগিদ থেকে। পরাশক্তিগুলোর অথর্নীতি বাজারনিভর্র হওয়ায় উৎপাদকদের অধিক মুনফার লোভে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন পণ্য অবিক্রিত অবস্থায় গুদামে পড়ে থেকে মূলধন সংকট সৃষ্টি করায়। মূলধনের চক্রায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মন্দা দেখা দেয়। বাজার অথর্নীতিতে মন্দা আণবিক বোমার বিস্ফোরণের চেয়েও ভয়াবহ। এর তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয় না এমন একজনকেও পাওয়া যায় না। এটা জানা থাকায় পরাশক্তির হতার্-কতার্রা তাদের দেশের উৎপাদিত পণ্য শক্তিহীন দেশগুলোকে দিয়ে কেনাতে বাধ্য করে। কিন্তু এই দেশগুলো দরিদ্র হওয়ায় বিদেশি মুদ্রার সংকটে ভোগে। তারা চাইলেও কিনতে পারে না।

পরাশক্তির তখন বিকল্প বের করতে হয়। বিকল্পটি হলো এমন পণ্য তৈরি করা যা একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না।

ভোগ্যপণ্য বহুবার ব্যবহার করা যায়। পরাশক্তিগুলোর দেশে ভোগ্যপণ্যও যাতে বেশিদিন বা বেশিবার ব্যবহার করা না যায় তার জন্য অহরহ ফ্যাশনের পরিবতর্ন ঘটানো হয়। এ কাজে সুদশর্ন নারী-পুরুষকে দিয়ে অহরহ ফ্যাশন শোর আয়োজন করা হয়। নামিদামি চিত্রতারকাদের দিয়ে এসব শো পরিচালনা করানো হয়। এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ, বিশেষত তরুণ-তরুণী, অযথাই অপ্রয়োজনীয় পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে নানা ফ্যাশন দ্রব্য কেনাকাটা করে।

ফ্যাশনের হলেও ব্যবহাযর্ দ্রব্যের তবু একটা স্থায়িত্ব থাকে কিন্তু গোলাবারুদের নয়। গোলাবারুদ একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। যুদ্ধ বঁাধিয়ে রাখলে গোলাবারুদ কামান বিমান অনবরত খরচ হতে থাকে। গুদামে পড়ে থেকে মন্দা ডেকে আনে না। অতএব, যুদ্ধই হলো মন্দা থেকে বাজার অথর্নীতি রক্ষার শ্রেষ্ঠতম উপায়। মজার ব্যাপার হলোÑ যুদ্ধ কখনো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) পর থেকে পরাশক্তিগুলোর দেশে হয় না। যুদ্ধক্ষেত্রগুলো এরপর থেকে সবর্দাই হয়ে রয়েছে হতদরিদ্র দেশগুলোতে। এতে প্রাণ দিচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোর উলুখেড়েরা, যারা জানেই না কেন তাদের দেশে যুদ্ধ হচ্ছে, কেন তারা ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, হারাচ্ছে ও পঙ্গু হচ্ছে তাদের আপনজন।

হালে পরাশক্তিগুলো দরিদ্র ও দুবর্ল দেশ ধ্বংসের একটি জুতসই উপলক্ষ পেয়েছে। উপলক্ষটি হলো মৌলবাদী জঙ্গি দমন। মৌলবাদী জঙ্গি দমন শুধু নয় নিমূর্ল করতে গিয়ে পরাশক্তিগুলো সাগরে অবস্থানরত তাদের ভাসমান বিমানক্ষেত্র থেকে মিসাইল ছুড়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের বহুতল অ্যাপাটের্মন্ট ভবনগুলো। এতে অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু মারা যাচ্ছে ও পঙ্গু হচ্ছে। এটা যে কত বড় মানবিক বিপযর্য় চিন্তা করা যায় না। ঘরবাড়ি হারিয়ে ও পঙ্গু হয়ে আবাসিকরা রাতারাতি হয়ে যায় রেডক্রসের স্থায়ী অতিথি। শহরে যারা অ্যাপাটের্মন্টে বসবাস করেন তারা জানেন কত কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে ইনস্টলমেন্টে বা কিস্তিতে তারা ওটা কিনেছেন। বহুতল এই ভবনটি তৈরি করতে কত শ্রমিকের দেহের কত লিটার রক্ত হয়েছে জল। ভবনটিতে জানালা-দরজা-গ্রিল ও অন্যান্য নিমার্ণসামগ্রী রড, সিমেন্ট প্রভৃতি কিনতে কত খরচ হয়েছে। তারপর থাকার জন্য খাট, বিছানা, সোফা ও অন্যান্য তৈজস আসবাব কোথাও এয়ারকুলার ইত্যাদি সংস্থাপন করা হয়েছে। বাসযোগ্য করতে লেগেছে কত মাস, কত মানুষের নিঘুর্ম দিনরাত্রি। তার সবই বরবাদ হয়ে গেল পরাশক্তির আক্রোশে পড়ে মিসাইল ও বোমার আঘাতে। দেখা যাচ্ছে দালানকোঠাগুলোই মৌলবাদী। যারা দালানকোঠাকে মৌলবাদী ঠাওরায় বুঝতে কষ্ট হয় না মৌলবাদ আস্তানা গেড়েছে তাদেরই ঘিলুতে। তারাই তালেবান আইএস। বহু পয়সা খরচ করে আইএস তৈরি করে তাদের দিয়ে তারা কিছু ছোটখাটো নাশকতার ঘটনা তাদের এলাকায় প্রথমে ঘটায়। তা নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ তোলার পর তাদের নিমূের্ল তারা নিকটবতীর্ সাগর থেকে মিসাইল ছুড়ে দুবর্ল দেশের মানুষ হত্যায় মাতে।

অন্যকে খুনের কথা এতক্ষণ বলার পর নিজকে হত্যার কথায় ফেরা যায়। কী অবস্থায় পড়ে মানুষ নিজেকে হত্যার আশ্রয় নেয়? আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব, যারা থাকেন তাদের চোখে হত্যা এবং আত্মহত্যা দুটোই সমান অপরাধ। দেখা যায় এদেরই একজন আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়েছেন। অতএব, আত্মহত্যা একটা অবস্থা ও অবস্থান-নিরপেক্ষ প্রপঞ্চ। কে যে কখন কাজটি করে বসবে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।

আসলে মন ও মগজ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে যারা আত্মহত্যা করেন তারা সুস্থ নন। সুস্থমনের মানুষের কথা হলো ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে।’ সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে যারা অকালে চলে যান তারা সুস্থ নন। মানুষের চেষ্টা যত বেশি সময় এ পৃথিবীতে থাকা যায়। মানুষ বেশিদিন বেঁচে থাকার কৌশল সেই আদ্যিকাল থেকে বের করে চলেছে। বেঁচে থাকার পথে মানুষের মূল অন্তরায় হলো রোগব্যাধি।

রোগব্যাধির নিরাময়ে তার প্রচেষ্টা একটানা। রোগব্যাধির উপশমে সে বহু ওষুধ আবিষ্কার করেছে। পৃথিবীর সব দেশে সব সমাজে হেকিম-কবিরাজ বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তারা প্রত্যেক অসুখের নিরাময়ে এক এবং কখনো একাধিক ওষুধ ব্যবহার করেন। তাতে রোগী ভালো হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা নিরুপায় হন তখন যখন মহামারী দেখা দেয়। কলেরা, বসন্ত ও প্লেগের মতো রোগ লোকালয়ে হানা দিলে গ্রামের পর গ্রাম নগরের পর নগর যায় উজাড় হয়ে। দুশ বছর আগে পৃথিবীর লোকসংখ্যা খুব কম ছিল। কারণ, বছর বছর মহামারীতে গণমৃত্যু। কিন্তু টিকা আবিষ্কারের পর মহামারী উধাও হয়ে গেছে। টিকা এবং প্রাণরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক বের হওয়ার পর মানুষের আয়ু বেড়ে সত্তর/আশির কোঠায় গেছে পেঁৗছে। মানুষের আয়ু এতদিন সবাির্ধক ছিল ১১৬ বছর। নতুন একটি কোষ প্রতিস্থাপক আবিষ্কৃত হওয়ায় মানুষের আয়ু বেড়ে নাকি হবে ১৫০ বছর।

পজিটিভ এত খবরের পর বা সত্তে¡ও মানুষ এ পৃথিবীতে থাকতে চায় না। বীতশ্রদ্ধ হয়ে সে নিজেকে নিজে হত্যা করে। এতে বোঝা যায় সে মনের দিক থেকে সুস্থ ছিল না। এরকম রোগীকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো তার নিকটজনের তাকে যথাযথ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং তার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তাকে চিকিৎসা দেয়া। তাকে চোখে চোখে রাখা।

আত্মহত্যা সম্পকের্ কথা শেষ করতে গিয়ে একটি নিত্যকার পৌনঃপুনিক দুঘর্টনার উল্লেখ না করলে নয়। সুস্থমনের মানুষই কেনাকাটা করে। মোটরসাইকেল যিনি কেনেন তার মাথা খারাপ এ কথা কেউ বলেবে না। মোটরসাইকেল কেনামাত্র তিনি নিজে এবং কখনো সপরিবার (রাস্তায় দুঘর্টনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান তাই বলে) আত্মহত্যা করবেন বলে নিজের অজান্তেই যে সিদ্ধান্ত নিলেন একথা হলফ করে বলা যায়। ( ১৯.০৯.২০৮)

আবদুল মতিন খান: রাষ্ট্রনীতি ও সমাজ বিকাশ বিষয়ে সন্ধিৎসু

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<13302 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1