বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভারত-চীন সংঘাত ও পশ্চাদপসরণ

দক্ষিণ চীন সাগরে আগ্রাসন নিয়ে চীনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ভিয়েতনামও। করোনা বৈশ্বিক মহামারিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ে দীর্ঘদিন ধরেই চীনের ওপর আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্ব ক্ষুব্ধ। এর ওপর শিন জিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, হংকংবাসীদের প্রতিবাদ দমনে চীনের কঠোর নীতির কারণে সমগ্র বিশ্ব এখন এমনিতেই চীনের ওপর ক্ষুব্ধ।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
  ১৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০

এখন থেকে ৬৮ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর 'নয়াচীন' সফরের পর থেকে চীনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কী কোনো পরিবর্তন হয়েছে? ভারতের লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের ভারতীয় অংশে এসে ঘাঁটি স্থাপন করা চীনাদের অনেক পুরনো সম্প্রসারণবাদী নীতি ও আচরণের বহির্প্রকাশ। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ গ্রন্থ 'আমার দেখা নয়াচীন'-এ উলিস্নখিত বর্ণনা থেকে চীনাদের আচরণ, রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তা থেকে ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন প্রভৃতি রাষ্ট্রের সঙ্গে চীনাদের সম্প্রসারণবাদী আচরণের একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতে পারে। গত ১৫ জুন ২০২০ সাল থেকে বিশ্বের দুটি সর্বাধিক জনঅধু্যষিত এবং পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারত এবং চীনের সংঘাত এবং এলএসি থেকে ৬ জুলাই চীনের পশ্চাদপসরণ সবই চীনের সম্প্রসারণাবাদী নীতি ও আচরণগত দায়িত্বহীনতার ফলশ্রম্নতি। বর্তমান দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক, এশিয়া মহাদেশ সংক্রান্ত এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনাদের আচরণ বুঝতে পারাটা খুবই প্রাসঙ্গিক। অনেকেই এর উত্তর অনুসন্ধানে ব্যাপৃত আছেন। তবে একটি মাত্র সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধান প্রচেষ্টার দ্বারা 'রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন' এবং 'ভারত-চীন সংঘাত ও চীনাদের পশ্চাদপসরণ সম্পর্কিত' সূচিত প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণরূপে উদঘাটন করা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা 'আমার দেখা নয়াচীন' চীনাদের আচরণ তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুঝতে সাহায্য করতে পারে। আর সেখান থেকে বর্তমানে চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতি, ভারত-চীন সংঘাত এবং এই সংঘাত থেকে চীনের পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিবেচনাপ্রসূত অবস্থান কী হওয়া উচিত সেসম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারি। এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর লেখা ডায়েরিগুলো থেকে তিনটি গ্রন্থ, 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা', এবং 'আমার দেখা নয়াচীন' সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এ তিনটি ঐতিহাসিক আকর গ্রন্থ প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত প্রায় এক কোটি (পূর্ব) বাঙালি শরণার্থীকে সে দেশে আশ্রয় দিয়েছে। সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক জনসংযোগ চালিয়েছে। অন্যদিকে, চীন তখন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। পাকিস্তান ও চীনকে বলা হয় 'সব ঋতুর বন্ধু'। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিল চীন। গালওয়ানের সংঘাত এবং ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সম্প্রসারণবাদী আক্রমণের সময়েও পাকিস্তান চীনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা যে অস্ত্র দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল সে সব অস্ত্রের প্রায় সবই ছিল চীনের তৈরি। চীনাপন্থি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা তখন মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

গালওয়ানের রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং প্যাংগং সো-র শৈলশিরা/ঢাল বা আঙ্গুল ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যকার মুখোমুখি অবস্থান 'তিব্বতীয় হাতের তালুর পাঁচ আঙ্গুল' [ফাইভ ফিঙ্গারস অব টিবেটান পাল্‌ম] হিসেবে পরিচিত চীনা কৌশলের অংশ। বলা হয়ে থাকে এই ধারণাটি ছিল মাও জে দং-য়ের এবং ১৯৫০ সালে চীনা সরকার অফিসিয়ালি এটি প্রকাশ করেছে। এই কৌশল অনুযায়ী তিব্বত (যার নাম চীন পরিবর্তন করে রেখেছে জিজাং) হচ্ছে চীনের ডান হাতের তালু এবং হাতের অন্য আঙ্গুলগুলোকে স্বাধীন করা দেশটির (মানে চীনের) দায়িত্ব। এই পাঁচ আঙ্গুল হচ্ছে লাদাখ, নেপাল, সিকিম, ভুটান এবং নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি মানে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ। বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু ঠিক তার উল্টো। ষাট বছর আগে থেকেই ভারত বলে আসছে তথাকথিত এই পাঁচ আঙ্গুল ভারতের সঙ্গেই সংযুক্ত চীনের সঙ্গে নয়। অন্যদিকে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) হচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে নির্ধারিত ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত রেখা। ১৯৫৯ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নিকট প্রেরিত একটি পত্রে প্রথম এই লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। চীনের প্রধানমন্ত্রীর ধারণা প্রসূত এই সীমারেখা পরবর্তীকালে চীনই অমান্য করেছে এবং এখনো করছে। এর কারণ হচ্ছে চীনারা কথিত 'পাঁচ আঙ্গুল'-এর পুরোটাই দখল করার অন্তর্নিহিত নীতি বহাল রেখেছে। এটি চীনকে সম্প্রসারণাবাদী হিসেবে পরিচিত করাচ্ছে। আর সেখান থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত। ভারত ও চীনের পুরো সীমান্তের আয়তন হচ্ছে ৪০৫৬ বর্গকিলোমিটার বা ২,৫২০ বর্গমাইল। এই সীমানার নিকবর্তী ভারতীয় ভূখন্ড হচ্ছে কেন্দ্রশাসিত লাদাখ, চারটি ভারতীয় রাজ্য উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশ। অন্যদিকে চীনের দিকে আছে চীনের দখলীকৃত তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। ফলে যেটি ছিল আগে ভারত-তিব্বত সীমান্ত দখলের কারণে সেটি হয়েছে ভারত-চীন সীমান্ত। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অতীশ দীপঙ্কর চীনে যাননি, তিনি গিয়েছিলেন তিব্বতে। চীন কর্তৃক তিব্বত দখলের পর তিব্বতের লাখ লাখ লোক মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের নেতা হচ্ছেন দালাই লামা। ভারতে তিব্বতীদের প্রবাসী সরকারও আছে।

১৯৬২ সালে সর্বশেষ ভারত ও চীনের সংঘর্ষ হয়। এরপর থেমে থেমে, ১৯৬০, ১৯৭০, এবং ১৯৮০-র দশকগুলোতে ছোটখাটো সংঘর্ষ কিছু হয়েছে। এসব সত্ত্বেও, বিগত কয়েক দশকে ভারত ও চীনের সীমান্ত মোটামুটি শান্ত ছিল, বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ হয়নি। চীন এই শান্তিময় পরিস্থিতিকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার চীনের অংশে অবকাঠামো নির্মাণ তথা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রচুর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখানে চীন এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে, হেলিপ্যাড নির্মাণ করেছে এবং সংক্ষিপ্ত নোটিশে ভারত চীন সীমান্তে যাতে হাজার হাজার চীনা সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে পারে তার জন্য প্রচুর রাস্তাঘাট প্রভৃতি নির্মাণ করেছে। ভারত এসব কিছুই করেনি। চীনের এই প্রস্তুতি বোঝার পরে ভারতও যখন চীনের সক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে তখনই সংঘাত শুরু হয়েছে। উলেস্নখ্য, দক্ষিণ চীন সাগরেও চীন একই নীতি অনুসরণ করছে। এমনকি চীন রাশিয়ার ভস্নাডিভস্টকও নিজেদের বলে দাবি করছে। চীনাদের এই সম্প্রসারণবাদী নীতি, দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ বাদে, সমগ্র বিশ্বে তীব্র বিতর্ক ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

যে কোনো সফরের মাধ্যমে ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়ে যায়। কোন প্রেক্ষিতে কার সঙ্গে কোন ধরনের মিথস্ক্রিয়া হবে তা আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর এই সফরের সময় প্রথম রাতের খাবার খেয়ে পেটের অবস্থা খারাপ হওয়ার কথা বলেছেন। বলছেন, 'আমাদের জন্য গরুর গোস্তের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু খেতে পারলাম না। যা খেলাম তার জন্য সারারাত পেটে তেল লাগাতে হলো। মাঝেমধ্যে পেটের ভিতর গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করতে শুরু করল, আর চাপা চাপা বেদনা শুরু হলো।' (পৃ.৩৭) পরে বঙ্গবন্ধু ফল খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন এবং অনেক কষ্টে তার রাত কেটেছিল। পরের দিন ছিল কনফারেন্স। পরদিন দুপুরে যখন আবার রাতের সেই হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো তখন বঙ্গবন্ধুর আগের সেই অবস্থাই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলছেন, 'দুপুরে আবার সেই হোটেলে নিয়ে যাওয়া হলো। আবার সেই দশা। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমরা যে হোটেলে থাকি তার উপরেই ভারতীয়দের জন্য খাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের লোকও সেখানে খায়।...এর মধ্যে ভারতীয় প্রতিনিধিদের অনেকের সঙ্গে আমাদের আলাপ হলো; বিশেষ করে বিশিষ্ট লেখক মনোজ বসুর সঙ্গে। লেখক মানুষ, ব্যবহার অতি চমৎকার। কথায় কথায় 'ভাই' 'দাদা' বলে সম্বোধন করে, পরে আমার সঙ্গে খুব ভালোবাসা হয়ে গেল।' বঙ্গবন্ধু তখন মনোজ বসুর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, 'দাদা, আপনারা কোথায় ভাত খান?' তিনি বললেন, 'কেন, উপরে, চিংড়ি মাছ পাকাইয়া দেয়, ডিম, মুরগির মাংস, সমুদ্রের মাছ, ডাল যা বলবেন সব দেয়।' (পৃ.৩৭) বঙ্গবন্ধু বলছেন. "মানিক ভাই আগেই বলে দিয়েছেন, আমি আর ও হোটেলে খেতে যাবো না, উপরে খাবো। আস্তে আস্তে আমরা সবাই পীর সাহেবের কাছ থেকে কেটে পড়লাম। পরে দেখা গেল পীর সাহেব ছাড়া আমরা সবাই উপরে খাওয়া আরম্ভ করলাম।' তাহলে, দেখা যাচ্ছে মানুষের আচরণের স্বাভাবিক গতি প্রকৃতির কারণেই ভারতীয় বাঙালি মনোজ বসুর দেওয়া তথ্যের সাহায্যে সেবারে চীন সফরের সময় বঙ্গবন্ধু খাবার সমস্যার সমাধান হয়েছিল।

'আমার দেখা নয়াচীন' বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি। এই দিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী বইমেলা উদ্বোধনের সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। পরদিন ২ ফেব্রম্নয়ারি ২০২০ চীনের রাষ্ট্রীর বার্তা সংস্থা শিনহুয়া 'বাংলাদেশি পিএম আনভেইলস ফাউন্ডিং ফাদার-অথোর্ড বুক অ্যাবাউট চায়না' শিরোনাম দিয়ে একটি সংবাদ পরিবেশন করে। এই সংবাদে বলা হয়, 'পলিটিক্যাল ভেটেরানস ছেইড দ্যা সিড অব বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ হ্যাড বিন পস্নান্টেড বাই দ্যা ভেটেরান লিডারস অব টু কান্ট্রিজ লং বিফোর ডিপেস্নাম্যাটিক টাইস অয়্যার অ্যাস্টাবিস্নসড'। অর্থাৎ রাজনীতি অভিজ্ঞ মহল বলছেন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে দুই দেশের অভিজ্ঞ নেতারা বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্বের বীজ রোপণ করেছিলেন। শিনহুয়ার এই বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এই বার্তা সংস্থা হচ্ছে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের একটি প্রতিষ্ঠান যেটি সে দেশের স্টেট কাউন্সিলের অধীনে এবং পিপলস ডেইলির পাশাপাশি এটি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গণমাধ্যম। শিনহুয়ার প্রেসিডেন্ট সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। শিনহুয়া যা বলছে সেটিকে চীন সরকারের বক্তব্য হিসেবেই ধরে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর 'আমার দেখা নয়া চীন' প্রকাশনার সংবাদ পরিবেশন প্রসঙ্গে যতটুকু মন্তব্য সিনহুয়া করেছে তা দেখে বোঝা যাচ্ছে এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের 'বন্ধুত্বের বীজ' যে কয়জন নেতা রোপণ বা বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাদের মধ্যে একজন, একমাত্র নন। আরও অনেক নেতা আছেন সিনহুয়া যাদের কথা বলে নাই। কিন্তু চীনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এমন আরও নেতা আছেন। আমরা জানি, এ প্রসঙ্গে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নামও আসে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যদি মওলানাকে 'সর্বদলীয় পরামর্শক কমিটি'র প্রধান করে বিশেষভাবে সহযোগিতা করা না হতো তাহলে চীনের সেই সময়ের অবস্থানের প্রতি একাত্ম হয়ে তিনি কি করতেন তা বলা মুশকিল!

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ১৯ বছর আগে ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানের একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে সে সময়ের 'নয়াচীন' গিয়েছিলেন। 'আমার দেখা নয়াচীন'-এর ৭৫ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন, '... চীনা শান্তি কমিটি ও সরকার ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন, আমরা পাকিস্তান থেকে যারা গিয়েছি তারা কমিউনিস্ট না এবং কমিউনিস্ট ভাবাপন্নও না। অনেকে এর মধ্যে কমিউনিস্টবিরোধীও আছেন। তাই বোধ হয় প্রাণ খুলে আমাদের সঙ্গে আলাপ করছেন না অনেকেই। ইলিয়াসও মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করছে। ২/১টা কথার উত্তর মাঝেমধ্যে দিয়েছেন।' নয়াচীন সফরকালে একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু, খোন্দকার ইলিয়াস এবং তাদের চীনা দোভাষী একই গাড়িতে উঠেছিলেন। সেই দোভাষীর কাছে অনেক প্রশ্ন করার পর মাঝেমধ্যে দু'একটি প্রশ্নের উত্তর দিতেন। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে চীনে সব কিছুই অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গোপন করে তখন যেমন রাখা হতো এখনো তার কোনো পরিবর্তন হয় নাই। এখনো চীন সম্পর্কে বেশির ভাগ তথ্য শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহির্বিশ্বে নয় দেশের ভিতরে জনগণকে জানতে দেওয়া হয় না। এবারে গালওয়ান উপত্যকাকে ঘিরে ভারত-চীন সংঘাতের সময়েও ভারত তার নিহত সেনাদের নাম ও সংখ্যা প্রকাশ করলেও নানা অজুহাতে কতজন চীনা সেনা হতাহত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা চীন প্রকাশ করেনি। ভারত তার নিহত সৈনিকদের জাতীয় বীরের মর্যাদায় সম্মান জানালেও চীনে কিন্তু সেটা হয়নি। এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে চীনাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ আছে। কিন্তু ভয়ে বা আতঙ্কে তা প্রকাশ করে না। চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর সময় উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের যে চিকিৎসক, ড. লি ওয়েন লিয়াং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন তাকে চীনের পুলিশ শাস্তি দিয়েছিল। এভাবে চীনা কর্তৃপক্ষ করোনা সংক্রমণের খবর প্রায় দুই মাস গোপন করে রেখেছিল। ফলে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সমগ্র দুনিয়াব্যাপী বিস্তার লাভ করতে থাকে।

দুটি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র, ভারত ও চীনের মধ্যে গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘটিত হাতাহাতি সংঘাতের পর থেকে যে উত্তেজনা শুরু হয়েছিল তার উত্তাপ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র দুটির সীমানা অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, গালওয়ান উপত্যকা থেকে ২ কিলোমিটার পিছনে সরে গিয়েছে চীনের বাহিনী। ভেঙে ফেলা হয়েছে চীনের পিপলস আর্মির তাঁবু, মেটাল ব্রিজ এবং বাঙ্কার। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং চীনের স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই-র মধ্যে রোববার ৫ জুলাই ২০২০ দীর্ঘক্ষণ টেলিফোন আলাপের পর এই সমঝোতার কথা জানানো হয়। দোভাল এবং ই দুজনই যথাক্রমে ভারত ও চীনের সীমান্তসংক্রান্ত ইসু্যর স্পেশাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। গলওয়ান উপত্যকায় চীনের আগ্রাসন ও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার অদূরে দুই দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের পর থেকে ১৩ বার স্থানীয়ভাবে সেনাস্তরে এবং তিনবার লেফটেন্যান্ট জেনারেলদের মধ্যে বৈঠকেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, চীন পিছিয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই বিশ্বাসভঙ্গ করেছিল চীন। এর বিপরীতে, নতুন নতুন সেক্টরে সেনা মোতায়েন হয়েছে।

রোববার ৫ জুলাই থেকেই শুরু হয়েছিল বর্ডার পয়েন্ট ভেরিফিকেশন। অর্থাৎ সর্বশেষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্তরের বৈঠকের পর গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাস্তবে চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখাকে মেনে নিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে কিনা, তা যাচাই করা। সেই যাচাই পর্বেই জানা গিয়েছে, তিনটি পয়েন্ট থেকে চীন সত্যিই পিছনে সরছে। দোভাল এবং ই স্বীকার করেছেন যে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছিল (অর্থাৎ মোদি এবং শি জিন পিংয়ের মধ্যে), সেই ঐক্যমত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সম্পূর্ণভাবে দু'পক্ষ সরে যাবে পিছনে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দোভাল এবং ওয়ান ই স্থির করেছেন, এবার সামগ্রিক শান্তি ফেরানোই হবে দু'পক্ষের একমাত্র লক্ষ্য। এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বে ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার কারণেই কি চীন কিছুটা নরম সুর তুলছে? গালওয়ান সংঘাতের পর থেকেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে ক্রমাগত কোণঠাসা হচ্ছিল চীন। আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি ন্যাটো জোট চীনকে সতর্ক করে দিয়েছে। আমেরিকা তো রণতরীও পাঠিয়ে দিয়েছে। ইউরোপ থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিয়ে আসছে এশিয়ায়। সেই সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ তৎপর। ক্রমাগত এই যুগপত চাপের মুখে, শেষ পর্যন্ত সুর নরম করতে বাধ্য হয় বেজিং। সোমবার ৬ জুলাই ২০২০

দক্ষিণ চীন সাগরে আগ্রাসন নিয়ে চীনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ভিয়েতনামও। করোনা বৈশ্বিক মহামারিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ে দীর্ঘদিন ধরেই চীনের ওপর আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্ব ক্ষুব্ধ। এর ওপর শিন জিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিমদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, হংকংবাসীদের প্রতিবাদ দমনে চীনের কঠোর নীতির কারণে সমগ্র বিশ্ব এখন এমনিতেই চীনের ওপর ক্ষুব্ধ।

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: 'ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থের লেখক, পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105646 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1