মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে বদলে যাচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজ

হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকের মৃতু্যবরণের মতো ঘটনাও ঘটেছে। মানুষ করোনা আক্রান্ত স্বজনদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। করোনা ও অন্য রোগীদের সেবায় মানবিক হতে হবে। মহামারিকালে মানুষ এতটা নিষ্ঠুর ও আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে, ভাবা যায় না। মৃতু্যভয়ে ফেসবুকে অনেকেই ক্ষমা চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকেই দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। অনেকেই চাকরি, ব্যবসা হারিয়েছেন। এ সংকটে একাধিক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকেই। রাজধানী ছেড়ে যারা গ্রামে গিয়েছেন, সেখানেও স্বস্তি-স্থিতি নেই। মানুষের মনোজগতেও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে, তীব্র হচ্ছে অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সংকট।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০৮ জুলাই ২০২০, ০০:০০

করোনাভাইরাস এক মহাতঙ্কের নাম। এ এক অদৃশ্য আততায়ী। করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বের ৫ লাখ ৪১ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ১৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশেও করোনার উচ্চ সংক্রমণ চলছে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৪৫ জন এবং মারা গেছে ২ হাজার ১৫১ জন। এই পরিস্থিতিতে করোনাকালে ব্যক্তি ও সমাজ বদলে গেছে। সবকিছু প্রায় এককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। মহামারি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও জীবন ও জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে অফিস-আদালত ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আগের মতো স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিদিনই রাস্তা-ঘাটে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে নগরজীবন। গত মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পরবর্তী দুই মাস সাধারণ ছুটি শেষে ১ জুন সীমিত পরিসরে প্রায় সবকিছু খুলে দেওয়া হয়। এরপরও জুন মাসে ভীতির কারণে রাস্তা-ঘাটে সীমিত সংখ্যক মানুষ ও যানবাহন দেখা যেত। প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ঘরে বসে থাকায় আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় শপিংমল ও মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশপথে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রসহ জীবাণুমুক্তকরণ মেশিন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রেখে করোনা প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে। যারা বাইরে বের হচ্ছেন তারা মুখে মাস্ক, হাতে গস্নাভস, ফেসশিল্ডসহ বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে তবেই বের হচ্ছেন। কিন্তু মানুষের মধ্যে আগের মতো উৎফুলস্ন ভাব নেই। ব্যক্তি আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। করোনাকালে বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতা। করোনাকে কেন্দ্র করে সমাজও আগের চেয়ে নিষ্ঠুর হয়েছে। যে বাড়ি বা বাসায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, করা হচ্ছে একঘরে। করোনাকালের সম্মুখসারির যোদ্ধা ডাক্তার নার্সরাও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। যেন তারা মহাঅপরাধ করে ফেলেছে।

এটা ভাবতে বিস্ময় জাগে, কোনোভাবেই আমাদের সমাজ যেন আলোর দিকে অগ্রসর হতে পারছে না, কেবল অন্ধকারে খাবি খাচ্ছে। মানসিক সংকীর্ণতা, অবক্ষয় আমাদের সমাজকে দিন দিন গ্রাস করছে। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি, যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এই সঙ্কট করোনাকালে এসব আরও তীব্র হচ্ছে। জনজীবন হয়ে পড়েছে বিষাদময়। মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে নেই বিন্দুমাত্র মানবিকতার ছাপ।

দিন দিন মানুষ মানুষের প্রতি হয়ে উঠছে অমানবিক ও নিষ্ঠুর। আর এই নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার সব থেকে বেশি শিকার হচ্ছেন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা। যেখানে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের প্রতি মানুষের আচারণ হওয়ার কথা ছিল সহানুভূতিশীল ও মানবিক। যে সময়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মনোবল বা সাহস বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টি প্রদান করার কথা ছিল ঠিক তখনই আমাদের সমাজে ঘটছে তার বিপরীত। করোনাকালে ব্যক্তির আচরণ ও মানসিকতা বিস্ময়কর। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা না পাচ্ছে প্রিয়জনের ছোঁয়া, না সম্মানজনক শেষ বিদায়। সম্প্রতি রাজশাহীতে করোনায় মারা যাওয়া এক ব্যক্তির মরদেহ ফেলে পালিয়েছেন তার ভাই এবং ভাবী। আজাদ আলী (৩০) নামের ওই ব্যক্তি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাত দেড়টার দিকে তার মৃতু্য হয়। আজাদ আলীর বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার জামগ্রামে। তিনি করোনা পজিটিভ রোগী ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। রামেক হাসপাতালে ছিলেন তার বড় ভাই এবং ভাবী। তবে মৃতু্যর পর তারা দুজনেরই মোবাইল ফোন বন্ধ করে পালিয়ে গেছেন। তারা মরদেহ নিতে চাননি। করোনায় আক্রান্ত বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনকে রাস্তায় ফেলে রাখা। তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা, এমন ঘটনা অহরহরই ঘটছে। আবার অনেকেই মৃতু্যকে পরোয়া না করে করোনা আক্রান্ত রোগীর সেবা দিয়েছেন। তবে অবজ্ঞা, অবহেলা, নিষ্ঠুরতার ঘটনাই বেশি। যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।

করোনাভাইরাস মানুষের জীবনযাপনকে বদলে দিয়েছে। মানুষ আগের চেয়ে সুশৃঙ্খল ও সতর্ক হয়েছে। জীবনযাপনে এসেছে পরিমিতিবোধ। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভীতিও সঞ্চার করেছে। কে কখন আক্রান্ত হয়, কে কখন মারা যায় সে ভয় সবার মধ্যে কাজ করছে। যতই দিন যাচ্ছে দেশে আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা বাড়ছে। যারা ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছে তারাও যেমন ভয় পাচ্ছে, আর যারা জরুরি কাজে বাইরে আসছে তাদের ভয়টা আরও বেশি। কারণ তারা যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতভাগ। ফলে মানুষের মনোজগতে বিষাদ কাজ করছে। মানুষ নিজেকে নিয়ে মৃতু্যকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এত ভাবেনি কখনো। যেন ভাবনা আর মন খারাপ থাকার মৌসুম শুরু হয়েছে। পরিবারের শিশুরাও এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে তাদের বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে শিশুরাও ভালো নেই। তারা কতক্ষণ ঘরে থাকবে। ফলে তারা লেখাপড়ার পরিবর্তে টিভি-মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। শিশুর মানসিক বিকাশে এটা বড় ধরনের বাধা।

আরও একটি ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করছে না। অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে না। শরীর ঘেঁষে চলাফেরা করছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে। যেন দেশে কোনো মহামারিই আসেনি। এর ফলে বিপদ ডেকে আনছে তারা। সামাজিক দূরত্ব বলতে যা বোঝায় তা বেশির ভাগ মানুষই মানছে না। ফলে দেশব্যাপী সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।

হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকের মৃতু্যবরণের মতো ঘটনাও ঘটেছে। মানুষ করোনা আক্রান্ত স্বজনদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। করোনা ও অন্য রোগীদের সেবায় মানবিক হতে হবে। মহামারিকালে মানুষ এতটা নিষ্ঠুর ও আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে, ভাবা যায় না। মৃতু্যভয়ে ফেসবুকে অনেকেই ক্ষমা চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকেই দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। অনেকেই চাকরি, ব্যবসা হারিয়েছেন। এ সংকটে একাধিক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকেই। রাজধানী ছেড়ে যারা গ্রামে গিয়েছেন, সেখানেও স্বস্তি-স্থিতি নেই। মানুষের মনোজগতেও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে, তীব্র হচ্ছে অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সংকট।

ঘুমের বড়ি সেবন করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে মারা যাওয়ার শঙ্কাও করছেন। যা খুবই বেদনাদায়ক। মানুষকে একদিন মরতে হবেই। এই নশ্বর পৃথিবীতে আসা আর যাওয়া এ দুটোই চরম সত্য। এই সত্যকে মেনে নিয়ে আমাদের বাকি জীবন চলতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনা খুব সহজে মানুষের জীবন থেকে যাবে না। এটা মেনে নিয়েই পথ চলতে হবে। উপরন্তু করোনাসহ অন্যান্য মহামারিও জেঁকে বসতে পারে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো। সুতরাং চরম বিভীষিকাময় অবস্থায় ভবিষ্যৎ জীবন কাটাতে হবে, না হয় মরে যেতে হবে। হতাশার কথা হচ্ছে, আগের পৃথিবীকে মানুষ হয়তো বা আর কোনোদিনই ফিরে পাবে না। মৃতু্য ও বেদনা পেরিয়ে, শোক কাটিয়ে নতুন পৃথিবীতে নতুন স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকবে, তৈরি হবে অহিংস মানবিক বিশ্ব।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<105121 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1