বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুক: সাইবার অপরাধের আঁতুড়ঘর

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ও ইতিবাচক ব্যবহারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা সময়ের দাবি। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ সচেতনতা ও সতর্কতা কাম্য। তবেই ত্বরান্বিত হবে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার স্বপ্নের প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন।
আবু ফারুক
  ০৬ জুলাই ২০২০, ০০:০০

বিশ্বের মানুষ যখন জীবনের সব ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দারুণ সব সাফল্যের সুফল ভোগ করছে তখন পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। অন্য অনেক ক্ষেত্রের তুলনায় তথ্য ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভাবনীয় উৎকর্ষতার সাক্ষী বর্তমান সভ্যতা। আর সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন সহজলভ্য মাধ্যম পুরো বিশ্বকে অনেকটা হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বিশ্বায়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে এসব মাধ্যম যেমন, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রাম ইত্যাদির ভূমিকা ও ব্যবহার দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। সাদামাটা স্মার্ট ফোন এবং ইন্টারনেটের স্বল্পমূল্যের সুবিধায় 'ফেসবুক' এখন সবার নাগালে। দিন দিন বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ফেসবুক ব্যবহারের দিক থেকে ঢাকা পৃথিবীর ২য় অবস্থানে।

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। ফেসবুকের একচ্ছত্র আধিপত্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডাকঘরের ব্যবহার স্মৃতি রোমন্থনের কাতারে চলে গেছে। সেইসঙ্গে পড়ালেখা, ব্যবসাবাণিজ্য, দাপ্তরিক সভা, অনলাইনভিত্তিক চিকিৎসা, গবেষণা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুশীলন ও বিনিময়, সামাজিক কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই চলছে ফেসবুকের তুমুল ব্যবহার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত প্রদান এবং যে কোনো অনিয়ম, বিশৃখলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার ও ভূমিকা ক্রমশ বাড়ছে। কিশোর থেকে বয়স্ক পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের মধ্যে সিংহভাগই তরুণ।

একই মুদ্রার দুই পিঠের মতো দারুণ সব প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি ফেসবুকে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ। আইনের ভাষায় যা 'সাইবার ক্রাইম' বলেই পরিচিত। বর্তমানে সাইবার ক্রাইম বাংলাদেশে অনেক বড় একটি সমস্যা। সাইবার বুলিং, ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল আইডি বা পেজ হ্যাক করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ড, অনলাইন ব্যবসা ও চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, যৌন হয়রানি, পর্নোগ্রাফি, গুজবসহ আরো অনেক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। আর সাইবার অপরাধের শিকার হওয়াদের অধিকাংশই নারী।

১। সাইবার বুলিং: ইন্টারনেট বা অনলাইনে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াসে মানহানিকর তথ্য উপস্থাপন ও কটূক্তি করার নাম সাইবার বুলিং। এটার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়।

২। হ্যাকিং: ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত আইডি, একাউন্ট বা পেজের গোপন নম্বর (পাসওয়ার্ড) চুরি করে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনবিরোধী, অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, ছবি বা ভিডিও প্রচার করার ব্যাপারটি এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে। সেইসঙ্গে হ্যাকার ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা আদায়ও করার চেষ্টা করে।

৩। যৌন হয়রানি: সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বর্তমান আধুনিক সময়ে এসেও থামেনি সমাজের বিভিন্ন বয়সি নারীদের হয়রানির মতো জঘন্য কর্মকান্ড। অনলাইনের সহজলভ্যতায় নারীদের যৌন হয়রানি নতুন রূপ পেয়েছে। একশ্রেণির বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ নারীর ম্যাসেঞ্জারে অশ্লীল ও যৌনাবেদন সংবলিত বার্তা, ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে যৌন লালসা চরিতার্থ করে। এছাড়া বিকৃত ছবি বা একজনের সঙ্গে অন্যজনের ছবি জোড়া লাগিয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে সংশ্লিষ্ট নারীকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। আবার বায়ুবীয় জগতে অচেনা মানুষের সঙ্গে আবেগী সম্পর্ক গড়ে পরিণতিতে অনেক নারী তাদের সম্ভ্রম হারাচ্ছে।

৪। অনলাইন ব্যবসার নামে প্রতারণা: তুমুল প্রতিযোগিতার যুগে ই-কমার্স এখন সারাবিশ্বেই জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও দিন দিন এর ব্যবহার ও উপযোগিতা বাড়ছে। আর একশ্রেণির অসাধু চক্র মানুষের সরলতা ও বিশ্বাসকে পুঁজি করে অনলাইন ব্যবসার নামে প্রতারণার রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন ও মানসম্পন্ন পণ্য দেখিয়ে স্বল্পমানের বা দামের পণ্য সরবরাহ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পণ্যের আগাম মূল্য আদায় করে পরে পণ্য সরবরাহ না করার ঘটনা এখন অহরহ। লটারি নিয়েও চলছে অভিনব সব প্রতারণা।

এসব ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং জনস্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে ভিত্তিহীন তথ্য ও গুজব রটনা প্রতিদিনের ঘটনা। ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে সমাজে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিল করছে এক শ্রেণির অপরাধীরা। এ রকম আরো অনেক অপরাধের গোড়াপত্তন হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। সাইবার ক্রাইমের নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগে বেড়ে গেছে শিশু ও নারী পর্নোগ্রাফির মাত্রা। ফলে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কিশোর ও তরুণদের নৈতিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ততার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। ঘটছে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও। এভাবে চলতে থাকলে অল্পসময়েই সাইবার ক্রাইম মহামারি আকার ধারণ করবে।

সাইবার অপরাধ নির্মূল করে ব্যবহারকারীদের ইতিবাচক স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার 'তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩)', 'পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২' এবং 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮' ইত্যাদির বিভিন্ন ধারায় অপরাধীদের জেল ও জরিমানার মতো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রেখেছে। ২০১৪ সালে চালু করা হয় 'সাইবার নিরাপদ হেল্প ডেস্ক'। রয়েছে সাইবার ক্রাইম ট্রাইবু্যনালও। তবে এ ক্ষেত্রে নানাবিধ কারণে অপরাধের সংখ্যার তুলনায় অপরাধী আটকের সংখ্যা কম। প্রচলিত আইন সম্পর্কে জনসাধারণের অজ্ঞতাই মূল কারণ। আবার অনেক ভুক্তভোগী বিশেষ করে সিংহভাগ নারী তথাকথিত সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে অনাগ্রহী। অনেক সময় উপযুক্ত প্রমাণের অভাবেও প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।

২০২১ সালের মধ্যে দেশকে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' করার প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী উদ্যোগ এবং ঈর্ষণীয় অগ্রযাত্রাকে মন্থর করছে লাগামহীন সাইবার অপরাধ। অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগকে একশ্রেণির মানুষ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে ব্যবহার করছে। ফলে প্রযুক্তির ভুল ব্যবহারে ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে সাইবার অপরাধের পরিধি। তবে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সচেতনতা নিশ্চিত করা গেলে সিংহভাগ বিড়ম্বনা ও অপরাধ শুরুতেই প্রতিরোধ করা যায়। এ ক্ষেত্রে অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত ছবি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান না করা, আইডির গোপন নম্বর শক্তিশালী করা ও একান্তই গোপন রাখা, অপরিচিত কারো সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আলাপ বা সখ্যতা না গড়া, বাছবিচারহীনভাবে গ্রম্নপ বা কোনো লিংকে প্রবেশ না করা, লটারি বা উপহার সংক্রান্ত তথ্য এড়িয়ে যাওয়া, পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারে সতর্ক থাকা, অশ্লীল ও রাষ্ট্রবিরোধী তথ্য লাইক বা শেয়ার না করা ইত্যাদি ব্যাপারে সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন থাকা উচিত।

ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন কিশোর বয়সিদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারি। সেই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানো উচিত। দুর্ভাগ্যক্রমে অনলাইনে প্রতারণা বা হয়রানির শিকার হলে প্রমাণপত্র (ছবি, স্ক্রিনশট, ভিডিও, তথ্য) নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ থানার পুলিশকে জানানো উচিত। এ ক্ষেত্রে আইডি ডিলিট করাটা বোকামি। কারণ, তখন অপরাধীকে ধরা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে যায়। সাইবার অপরাধ দমন ও নির্মূলে সরকারের কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য। সম্ভাব্য সব মাধ্যম ব্যবহার করে ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহারে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া সাইবার অপরাধ দমনে প্রশিক্ষিত জনবল ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে অমিত সম্ভাবনার সুফল উপভোগ করে দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য উন্নয়নে অনলাইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি সাইবার অপরাধকে সমূলে ধ্বংস করা আবশ্যক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপদ ও ইতিবাচক ব্যবহারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা সময়ের দাবি। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ সচেতনতা ও সতর্কতা কাম্য। তবেই ত্বরান্বিত হবে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার স্বপ্নের প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন।

আবু ফারুক : কলাম লেখক ও সহকারী শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<104923 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1