শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অদৃশ্য আততায়ী কোভিড-১৯ অধ্যক্ষ

অবস্থা খারাপ বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে কোভিড চিকিৎসা দেয় এরকম হাসপাতালে যেতে হবে। অসুখের শুরুতেই একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে রাখতে পারলে ভালো। ভুলে কোনো সন্দেহযুক্ত কাজ করে ফেললে ২-১৪ দিন নিজেকে পর্যবেক্ষণ করুন। এর ভেতরে রোগ প্রকাশ না পেলে আপনি নিরাপদ। কোভিড হয়তো খুব তাড়াতাড়ি বিদায় নাও নিতে পারে। তাই সঙ্গত কারণেই স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মগুলো আমাদের মেনে চলতে হবে।
ডা. হাফিজ উদ্দীন আহমদ
  ০২ জুন ২০২০, ০০:০০

কোভিড-১৯ করোনা ভাইরিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস। ভাইরাস এক ধরনের প্রাণহীন বস্তু যা জীবিত দেহের কোষের ভিতরে ঢুকতে পারলেই বৃদ্ধি পেতে পারে। এদের কোনো প্রাণকোষ (নিউক্লিয়াস), কোষ রস (সাইটোপস্নাজম), রাইবোজোম, কোষ প্রাচীর বা সেল ওয়াল থাকে না এবং ইলেক্ট্রোন মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না। এটা বেশ বড়, ব্যাস ৮০-১৬০ ন্যানোমিটার তাই বলে বাতাসে ভাসতে পারে না তা নয়। আর দেখতে কদমফুলের মতো কেননা গস্নাইকোপ্রোটিনগুলো ফুলের পাপড়ির মতো সাজানো থাকে। মানুষের শরীরে নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে ঢোকে তাই বারবার হাত ধুতে হয় ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত সাবান দিয়ে; কারণ এসব স্থান আমরা মনের অজান্তে ঘন ঘন স্পর্শ করি। সাবানের ক্ষার তাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

দেহের বাইরে ভাইরাসটি জীবিত না থাকলেও দেহ থেকে বের হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ সক্রিয় থাকতে পারে, যথা- (সূত্র : নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন): কপার বা তামা- ৪ ঘণ্টা, কার্ড বোর্ড- ২৪ ঘণ্টা, কাঠ ও কাপড়- দুদিন, স্টেনলেস স্টিল- ২-৩ দিন, পলিপ্রোপাইলিন পস্নাস্টিক- ৩ দিন, কাঁচ- ৪ দিন, কাগজের মুদ্রা- ৪ দিন, সার্জিকাল মাস্কের বহিঃপার্শ্ব- ৭ দিন।

রোগ সংক্রমণের ২-১৪ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয় যথা- জ্বর, শরীর ব্যথা, শুকনো কাশি, গলা ব্যথা, স্বাদ ও গন্ধ বিলুপ্তি, শ্বাসকষ্ট। সব উপসর্গ একই সঙ্গে একজনের দেহে নাও থাকতে পারে। শুকনো কাশি এ রোগের সবচেয়ে কষ্টদায়ক উপসর্গ। রোগী জোরে হাঁচি বা কাশি দিলে লাখ লাখ সূক্ষ্ণ জলকণা ঘণ্টায় ৬০০ মাইল বা জেট পেস্ননের বেগে নিঃসরিত হয়ে বাতাসে ভাসতে থাকে। এই বাতাসের সংস্পর্শে কেউ এলে বা তার তিন ফিট দূরত্বের মধ্যে থাকলে শ্বাসের সঙ্গে নাক দিয়ে ঢুকে বংশ বৃদ্ধি শুরু করবে। এই উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তাই জনসমাগম এড়িয়ে চলা উচিত, সঙ্গ নিরোধ করতে হবে ও প্রয়োজনে বিশেষত বাইরে গেলে তিন পরতের মুখোশ বা মাস্ক পরতে হবে। এমনভাবে তা পরতে হবে যেন মুখমন্ডল ও মাস্কের মধ্যে কোনো ফাঁক না থাকে। যেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সরাসরি রোগীর সেবায় নিয়োজিত তারা এন-সিরিজের মাস্ক পরবেন। এ ধরনের মাস্কে রেস্পিরেটর থাকে যা কঠিন ও তরল বায়বীয় পদার্থ ও ধুলো আটকাতে পারে। ৯৫,৯৯,১০০ মাস্ক যথাক্রমে ৯৫%, ৯৯% এবং ১০০% ভাসমান পদার্থ আটকাতে পারে। বাজারের সবজি ও ফলমূল দীর্ঘক্ষণ পানিতে ডুবিয়ে রেখে পরিষ্কার করলেই চলবে।

দেহে প্রতি ঘনলিটার রক্তে ৪০০০-১১০০০ শ্বেত কণিকা আছে। ভাইরাস দেহে ঢোকার পর এরা এ শত্রম্ন থেকে দেহকে বাঁচাতে রীতিমতো সৈন্যের মতো কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে যায়। প্রথম কাতারে থাকে ঝাড়ুদার বা স্ক্যাভেঞ্জার কোষ যার অন্তর্গত বহুকেন্দ্রিক শ্বেত কণিকা বা পলিমর্ফ এবং বৃহৎ কোষ বা ম্যাক্রোফেজ। দ্বিতীয় কাতারে থাকে লসিকা কোষ বা লিম্ফোসাইটস (টি ও বি এবং টির উপবিভাগ টি ৪ সহায়ক কোষ এবং ঘাতক টি কোষ) মুখ্যত টি কোষ রক্তের মাধ্যমে সারা দেহে টহল দিয়ে বেড়ায় এবং রাসায়নিক পরিচিতি দিয়ে শত্রম্ন (যথা ভাইরাস/জীবাণু) শনাক্ত করতে পারলেই বি কোষকে নির্দেশ দেয় সুনির্দিষ্ট আমিষ বা প্রতিরক্ষিকা অর্থাৎ এন্টিবডি তৈরি করতে। রোগী সুস্থ হয়ে গেলে এই প্রতিরক্ষিকা সংবলিত তার রক্ত রস বা পস্নাজমা দিয়ে নতুন আক্রান্ত কোনো রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যায়। ভাইরাস ফুসফুসে এলে আমাদের অনাক্রম্যতা (ইমুইন) ব্যবস্থা তৎপর হয়। ম্যাক্রোফেজ কোষগুলো সাইটোকাইনিন ও কেমোকাইনিন নির্গত করে বিশেষত ইন্টারলিউকিন-৬ ও ৮ খুবই ভয়ঙ্কর। এরা শরীরের টি লসিকা কোষকে (সিডি ৪ ও ৮) সক্রিয় করে। লসিকা কোষ রক্ত থেকে ঝাঁক বেঁধে ফুসফুসে চলে আসে ফলে রক্তে তাদের সংখ্যা হ্রাস পায়। এক দারুণ প্রদাহ শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য হলো- আক্রান্ত তন্তকে ঘেরাও করে ফেলা। কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণে ঘটলে ক্ষতি হয়। এটাকে সাইটোকাইনিন স্টর্ম বা ঝড় বলে। ভাইরাস রক্তনল ও হৃৎপিন্ডের ভিতরের দেওয়াল মুড়ে রাখা আন্তর্ঝিলিস্নক বা এন্ডোথেলিয়াল কোষগুলোকে আক্রমণ করে। ফুসফুসের ধমনিগুলো প্রদাহ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের দেয়ালজুড়ে রক্ত জমাট বাঁধে। ছোট ছোট বায়ুথলিগুলোও এর শিকার হয়। স্বাভাবিকভাবেই রক্তে অম্স্নজান বা অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে না। তাই শরীরের অন্যান্য অংশগুলোতেও তা যেতে পারে না। ফলে হৃৎপিন্ড প্রদাহ বা মায়োকার্ডাইটিস, বুকব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও প্রদাহের কারণে জ্বর হয়। কখনো আন্ত্রিক প্রদাহ বা কলাইটিস দেখা দেয়। জমাট বাঁধা চলমান রক্তপিন্ড রক্ত স্রোতে ভেসে ভেসে ফুসফুসের ধমনিতে আটকে পালমোনারি অ্যাম্বোলিজম বা মস্তিষ্কের ধমনিতে আটকে স্ট্রোক হতে পারে। এমনকি বৃক্কেও অম্স্নজানের অভাব ঘটিয়ে তীব্র বৃক্ক বিকলতা বা অ্যাকুট রেনাল ফেইলর ঘটাতে পারে। আসলে সারা শরীরজুড়ে এক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়।

কোভিড-১৯ কীভাবে রক্ত জমাট বাঁধায় স্পষ্ট নয় তবে শরীর যখন জমাটবদ্ধতাকে ভাঙে তখন ডি-ডাইমার নামে একটি আমিষ তৈরি হয়। রক্তে ডি-ডাইমারের (সাইট্রেট পস্নাজমা) মান দেখে তাই কোভিড রোগীটির অবস্থা কতটা মারাত্মক তা বুঝতে পারা যায়। অন্যান্য যা থাকে তা হলো শ্বেতকণিকা, এলডিএইচ, ফেরিটিন ও সি-প্রতিক্রিয়াশীল আমিষ বৃদ্ধি এবং লসিকা কোষ হ্রাস তথা বুকের রঞ্জন ছবি (এক্স-রে ) বা সিটি স্ক্যানে ফুসফুসে ঘষা কাচের মতো অস্বচ্ছতা (গ্রাউন্ড গস্নাস অপাসিটি) দেখতে পাওয়া। নিশ্চিত রোগ নির্ণয় করতে মুখের লালা, নাকের শ্লেষ্মা বা রক্তের নমুনা নিয়ে পিসিআর (পলিমারেজ চেইন রিয়্যাকশন) পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া গণস্বাস্থ্য আবিষ্কৃত কিট দিয়ে স্বল্প খরচে মাত্র ১৫ মিনিটে ৯০% নিশ্চয়তার সঙ্গে রোগ নির্ণয় করা যায় বলে দাবি করা হয়েছে। বর্তমানে এজিথ্রোমাইসিন বা ডক্সিসাইক্লিন, ইভারমেকটিন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, প্যারাসিটামল, স্টেরোয়েড এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় অক্সিজেন তথা ভেন্টিলেটর সহযোগে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার না করার জন্য সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উপদেশ দিয়েছে। কোথাও কোথাও ভাইরাসবিরোধী ওষুধ ফ্লাভিপিরাভির বা রেমডেসিভির দেওয়া হচ্ছে তবে এটাও খুব কার্যকর নয়। ইন্টারন্যাশন্যাল সোসাইটি অন থ্রম্বোসিস অ্যান্ড হিমোস্টেসিসের মতে কোনো কোভিড ১৯ রোগী চিকিৎসার্থে ভর্তি হলে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি পরীক্ষা করে রক্ত পাতলা করার ওষুধ এবং প্রয়োজনে জমাট নিরোধী হেপারিন বা এনেক্সপেরিন দেওয়া উচিত। কোভিড রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া অনেক রোগীর ময়নাতদন্ত করে রক্তে জমাটবদ্ধতা পাওয়া গেছে। আসলে শুরু থেকে এটা করলে অনেক জটিলতা কমে যাবে কেননা করোনা কেবল ফুসফুসের নয় তা রক্ত নলেরও রোগ। মিডিয়ার বেশ কিছু ভুয়া উপদেশ থেকে সতর্ক থাকবেন। বলা হচ্ছে রসুন সেবন, গরম পানি দ্বারা গড়গড়া বা ভাপ নেওয়া অথবা পানি খেলে ভাইরাস পেটে গিয়ে হজম হয়ে যাওয়া এগুলো কোনোটিই সত্য নয়। যে উচ্চতাপে ভাইরাস মরে সে তাপে কেউ গড়গড়া করতে পারবে না তবে গড়গড়ায় গলায় আরাম পাওয়া যাবে। এমনকি যা বলা হচ্ছে ছোট শিশুদের এ রোগ হয় না এটাও ডাহা মিথ্যা।

সাবধানে থাকুন। লকডাউনে থেকে অযথা ভয়ভীতি দ্বারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন না। এতে আপনার অনাক্রম্যতা বা শরীর রক্ষাকারী ইমিউনিটি দুর্বল হয়ে পড়বে ও সহজেই রোগের শিকার হবেন। এমনকি সারাক্ষণ মিডিয়া দেখে মনকে ভারাক্রান্ত করবেন না। শরীর ও মনকে শিথিল রাখুন। পড়াশোনা, শিল্পকর্ম, লেখালেখি, ঘর গোছানো, ঘরোয়া খেলাধুলা (ক্যারম, লুডু, ডমিনো), ধর্মকর্ম বা ঘরে থেকে যারা অফিস করেন সেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। জনসমাবেশ এড়িয়ে চলুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। অযথা বাইরে যাবেন না। গেলে অবশ্য এমনভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরবেন যাতে মুখমন্ডল ও মাস্কের মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর না থাকে এবং হাতে দস্তানা পরবেন বা হাত দিয়ে যথা সম্ভব কিছু স্পর্শ করবেন না। আগেই বলা হয়েছে সাধারণরা তিন পরতের বা সার্জিকাল মাস্ক আর সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকরা এন সিরিজের মাস্কগুলো পরবেন। কোনো মাস্কই পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেয় না। ঘরে এসে এগুলো বর্জন করতে হবে এবং হাত এলকোহলযুক্ত দ্রবণ বা সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধুতে হবে। আসলে কোনো সন্দেহযুক্ত কিছু ধরার পরই হাত এভাবে ধোয়া উচিত। জুতা খুলে ঘরের বাইরে রাখতে হবে। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার (মুখ ঢাকা ও রাস্তাঘাটে থুতু-শ্লেষ্মা না ফেলা) মেনে চলতে হবে। ০.১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট অর্থাৎ বিস্নচ (প্রতি গ্যালোনে ৫ টেবিল চামচ) ছিটিয়ে পরিবেশ দূষণমুক্ত করা যেতে পারে। এসবের পরেও যদি আক্রান্ত হন ভয় না পেয়ে যথা সম্ভব ঘরে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঙ্গ নিরোধ মেনে চিকিৎসা নিন।

অবস্থা খারাপ বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে কোভিড চিকিৎসা দেয় এরকম হাসপাতালে যেতে হবে। অসুখের শুরুতেই একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে রাখতে পারলে ভালো। ভুলে কোনো সন্দেহযুক্ত কাজ করে ফেললে ২-১৪ দিন নিজেকে পর্যবেক্ষণ করুন। এর ভিতরে রোগ প্রকাশ না পেলে আপনি নিরাপদ। কোভিড হয়তো খুব তাড়াতাড়ি বিদায় নাও নিতে পারে। তাই সঙ্গত কারণেই স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মগুলো আমাদের মেনে চলতে হবে।

অধ্যক্ষ ডা. হাফিজ উদ্দীন আহমদ: কবি ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<100933 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1