বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিবিয়ায় বাংলাদেশি নিহত এবং আমাদের দায়িত্ব

আমাদের মনে আছে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে অবৈধ অভিবাস প্রত্যাশীদের গণকবর আবিষ্কার করা হলে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়েছিল। তার পরপরই বিষয়টি আবার চাপা পড়ে যায়। আমাদের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের অবদান বিশাল। জনশক্তি রপ্তানি খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর হলে অবৈধ উপায়ে, অবৈধ পথে বিদেশ গমনের প্রবণতা ও সংখ্যা কমে যাবে। আর বাড়বে রেমিট্যান্সপ্রবাহ।
মাছুম বিলস্নাহ
  ০১ জুন ২০২০, ০০:০০

মানব পাচারসংক্রান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহ পত্রিকা, টিভির পর্দাসহ অন্য সব যোগাযোগ ও সামাজিক মাধ্যমগুলোর বিশাল এক অংশজুড়ে থাকে প্রায় সারা বছর; কিন্তু কোথাও থেকে কোনো সমাধান নেই দু'চারটি বিবৃতি ছাড়া। হুহু করে বেড়ে যাওয়া বেকারত্বের এই দেশে জন্ম নেওয়া হাজার লাখ তরুণ ভাগ্যের অন্বেষণে কোথাও বেরিয়ে পড়বে, এটি বিচিত্র কিছু নয়। ইংরেজ বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে অজানা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছিল। বিশ্বের সব প্রান্তে গিয়ে বাণিজ্য করে কায়েম করেছিল তাদের রাজত্ব। অজানা সমুদ্রের উদ্দেশে যাত্রা করা একদিকে দারিদ্র্য যেমন তাদের বাধ্য করেছিল দ্বিতীয়ত মানুষের এটি সহজাত প্রবৃত্তি। আমাদের দেশের লক্ষ তরুণ শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত সবাই চায় নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে। দেশের এই সীমিত পরিসরে যখন সেটি সম্ভব হয় না তখন তারা পাড়ি জমাতে চায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে- বৈধ, অবৈধ, ঝুঁকিপূর্ণ সব পথেই। এটি করতে গিয়ে যখন তাদের বিশাল আকারে সলিল সমাধি কিংবা বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন দু'চারটি বিবৃতি, কমিটি গঠন ইত্যাদির কথা শোনা যায়। কিন্তু এই বিষয়টি যে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের দাবিদার সে দিকে কিন্তু খুব একটা গড়ায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে সিঙ্গাপুর নামক ছোট্ট ও উন্নত দেশটি ছিল একটি জেলেপলস্নী। সেখানকার জনগণও কিন্তু অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করত। সেই বিষয়টি তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোকে সেদেশে কাজ করার সহজ সুযোগ করে দিয়েছে যার ফলে সিঙ্গাপুরে তৈরি হয়েছে সেখানকার তরুণদের জন্য বিশাল কাজের ক্ষেত্র। পরে তাদের বিদেশে গিয়ে অর শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়নি। সিঙ্গাপুর সরকার জনগণের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ট্যাক্স নিয়ে জনগণকে নিজস্ব ফ্ল্যাটের মালিক বানিয়ে দিচ্ছে। যতটা জেনেছি প্রায় আশি শতাংশ মানুষের রয়েছে নিজস্ব ফ্ল্যাট। সরকারের পস্ন্যান হচ্ছে প্রতিটি মানুষ তার নিজের ফ্ল্যাটে বসবাস করবেন। এসব দেশের মানুষ সরকারকে ট্যাক্স দেওয়ার জন্য হাতে টাকা নিয়ে বসে থাকেন। আর আমাদের দেশে ট্যাক্স দিয়ে মনে হয় আমাদের টাকা দিয়ে হর্তাকর্তারা কোন দেশে টাকা জমাচ্ছেন, কানাডায় নাকি সুইজারল্যান্ডে, নাকি নিজের ঘরেই ব্যাংক তৈরি করছেন? যাদের ট্যাক্স দেওয়ার কথা তারা ট্যাক্স দেন না, বরং তারা ভোগ করেন 'ট্যাক্স হলিডে'। ট্যাক্স দিচ্ছি আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, দেশের রেমিট্যান্সের পালস্না ভারী করছেন বৈধ ও অবৈধ উপায়ে জীবন বাজি রেখে বিদেশে কাজ করা মানুষ। কিন্তু আমরা তাদের কি দিচ্ছি? বিদেশি কোনো কোম্পানি এলে তাদের লাইসেন্স পেতে, লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে নাভিশ্বাস উঠে যায়। তারপর কমিশন বাণিজ্য, মাস্তান, চাঁদাবাজি এসব বিষয় তো রয়েছেই। কোনো তরুণ, নতুন কোনো উদ্যোক্তা কিছু একটা শুরু করবেন- পার্টির মাস্তান, এলাকার মাস্তান, উটকো মাস্তান সবাই এসে আপনার কাছে চাঁদা দাবি করবে। কোথায় যাবে আমাদের তরুণরা? তখন তারা নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। যারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ করেন আর আমরা তার ক্রেডিট নিতে থাকি। কিন্তু তারা কীভাবে, জীবনকে বাজি রেখে বিদেশে গেলেন, পরিবারের সব মানুষের কান্নার বিনিময়ে যে তারা বিদেশে গেলেন সে খবর কেউ রাখি না। আমরা শুধু বলি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি কিন্তু নিজেকে জিজ্ঞেস করি না এর পেছনে কতটুকু অবদান রয়েছে আমাদের? আমাদের বিদেশি মিশনগুলো যদি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উপযুক্ত শ্রমবাজার সৃষ্টি করতে পারত তাহলে তো এসব তরুণদের ওই দালালদের মাধমে বিদেশে যেত হতো না, মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হতো না। আমরা কি আসলে বিষয়টির ওপর প্রয়োজনীয় গুরুত্বারোপ করতে পেরেছি? যারা বিদেশে আছেন তারা সবাই জানেন আমাদের মিশনগুলোর সেবাদানের চিত্র। কি সেবা তারা দিচ্ছেন অভিবাসীদের? কতটুকু সহায়তা তারা করছেন অভিবাসীদের? বহুবার ফোন করেও কোনো ফোনের উত্তর পাওয়া যায় না, তারা ফোন ধরেন না। এর প্রতিকার কি আছে? কে দেখবে এগুলো? এগুলো গল্প নয়- বাস্তব।

ঈদ যেতে না যেতেই লিবিয়ার মানব পাচারকারী এক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা ৩০ অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশি। কত বড় মর্মান্তিক ঘটনা! লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরত্বে মিজদা শহরে ঘটনাটি ঘটেছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিজদা শহরের নিরাপত্তা বিভাগকে দোষীদের গ্রেপ্তারে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা জানি গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত লিবিয়া। যার অর্থনীতি তেলনির্ভর। কাজের সন্ধানে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ থেকেই তরুণরা অবৈধ পথে দেশটিতে পাড়ি জমায় যাতে ভবিষ্যতে তারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের কোনো দেশে যেতে পারেন। আর কাজগুলো হয়ে থাকে অবৈধ পথে, এ সুযোগগুলো নেন দেশি-বিদেশি দালালরা। কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে বর্তমানে একজন লিবিয়ানের আশ্রয়ে আত্মগোপন করে আছেন আমাদের এক বাংলাদেশি। তিনি জানিয়েছেন ১৫ দিন আগে বেনগাজী থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে মানব পাচারকারীরা তাদের লিবিয়ার ত্রিপোলি শহরে নিয়ে আসার পথে তিনিসহ ৩৮ জন বাংলাদেশি মিজদা শহরে দুস্কৃতিকারীদের হাতে জিম্মি হন। জিম্মি অবস্থায় তাদের অত্যাচার, নির্যাতন করার একপর্যায়ে অপহৃত ব্যক্তিরা মূল অপহরণকারী লিবিয়ান ব্যক্তিকে হত্যা করেন এবং এর জের হিসেবে অন্য দুস্কৃতিকারীরা আকস্মিকভাবে তাদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি করে। ফলে ২৬ বাংলাদেশি এতে নিহত হন। আর ১১ বাংলাদেশি হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিহত ২৬ জনের লাশ তার পরিবারের সদস্যরা ফিরে পাবেন কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। যারা হাসপাতালে আছেন তারা আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। লিবিয়ায় বাংলাদেশি মিশন থেকে এখনো সেভাবে কিছু জানা যায়নি। এটিই একটি বড় প্রমাণ যে, আমাদের মিশনগুলো প্রবাসী শ্রমিকদের কতটা গুরুত্বসহকারে দেখেন।

বিদেশে কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে, সরকারকে। গুরুত্ব শুধু কথায় নয়, কাগজে নয়, গুরুত্ব দিতে হবে কাজে। যে কোনো বিষয় সামনে এলেই আমরা একটি সাধারণ কথা শুনি। সেটি হচ্ছে- এ বিষয়ে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এ ধরনের ভেইগ কথা বলে কোনো লাভ নেই। কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিসের আলোকে নেওয়া হয়েছে। কাদের পরামর্শে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেখানে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ মত, বিশেষজ্ঞ সিদ্ধান্ত। ফলে সমস্যা থেকেই যায়। আর একটি বিষয় হচ্ছে, অভিবাসন সমস্যা, বিদেশে নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা একদিকে যেমন জাতীয় বিষয়, একই সঙ্গে এটি বৈশ্বিক বিষয়ও। তাই, বৈশ্বিক মন্ডলে যথাযথ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া, চাপ, প্রয়োগ করার বিষয়টি ভাবতে হবে। মানব পাচার অবশ্যই একটি আন্তঃদেশীয় সমস্যা, কাজেই একটি দেশের একার পক্ষে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়, তাই বিষয়টিকে বৈশ্বিক মন্ডলে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এ কাজটি করতে হবে সরকারকেই। এ বিষয়ে আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশ্বের অনেক দেশে কর্মরত আছেন, তাদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

আমাদের মনে আছে থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে অবৈধ অভিবাস প্রত্যাশীদের গণকবর আবিষ্কার করা হলে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়েছিল। তার পরপরই বিষয়টি আবার চাপা পড়ে যায়। আমাদের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের অবদান বিশাল। জনশক্তি রপ্তানি খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর হলে অবৈধ উপায়ে, অবৈধ পথে বিদেশ গমনের প্রবণতা ও সংখ্যা কমে যাবে। আর বাড়বে রেমিট্যান্সপ্রবাহ।

\হআমরা এই কল্যাণকর বিষয়টি আসলেই চাই কিনা চিন্তা করতে হবে। আর তা করতে হলে বিদেশে অবস্থানরত মিশনগুলোকে সত্যিকার অর্থে গতিশীল করতে হবে। তাদের রুটিনমাফিক কাজ আর ট্র্যাডিশনাল দায়িত্ব পালন করলেই হবে না। বিদেশে শ্রমবাজারকে প্রসারিত করার জন্য যা যা দরকার তাই করতে হবে।

মাছুম বিলস্নাহ : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<100816 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1