বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এখন কাশ্মীরে চলছে ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থা!

যাযাদি ডেস্ক
  ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
পার্কে বেড়াতে আসছেন কাশ্মীরের লোকজন

ভারতশাসিত কাশ্মীর থেকে বড় কোনো বিক্ষোভের খবর এখনো নেই। সেখানকার পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হয়ে আসছে? নাকি এটা ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থা? কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরে এখন যে দম-আটকে আসা অবরুদ্ধ অবস্থা চলছে, এর মধ্যে মনটাকে একটু হালকা করার নানা উপায় বের করে নিয়েছে সেখানকার লোকজন। প্রধান শহর শ্রীনগরের পার্কগুলোতে দেখা যাচ্ছে, লোকের ভিড় বেড়ে গেছে। ছবির মতো সুন্দর ডাল লেকের পার ধরে অনেকে বসে গেছে মাছ ধরতে। অনেকে গাড়ি চালিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। অনেককে দেখা যায় রাস্তায় জটলা করতেও।

শ্রীনগর শহরের অনেক জায়গা থেকেই নিরাপত্তা ব্যারিকেড আর কাঁটাতারের বেষ্টনী সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বস্ন্যাকআউট বা রেশনে খাবার বিক্রিও আর নেই। দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য খুলছে ছোট বাজারগুলোও। মনে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন বিজেপি কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়ার মাসখানেক পর মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটি যেন ধীরে ধীরে এক ধরনের 'স্বাভাবিক অবস্থায়' ফিরে আসছে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে 'জাতীয় স্বার্থ এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে' কাশ্মীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে। সরকার জোর দিয়ে বলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো কাজ করছে, ওষুধের দোকানগুলো খোলা। খাদ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে, ক্যাশ মেশিনগুলো কাজ করছে। স্কুল খোলা, ল্যান্ডলাইন ফোন আবার কাজ করতে শুরু করেছে। সরকার, এমনকি আপেলচাষিদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ফল কিনতে রাজি হয়েছে, স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপন- যাতে সোনালী ভবিষ্যৎ, কাজ ও উন্নয়নের প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এরপরও মনে হতে পারে, এই 'স্বাভাবিক অবস্থা' যেন একটা বিভ্রম।

ল্যান্ডলাইন ফোন এখন আবার চালু হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগ লোকই এখনো ফোন সংযোগ পাচ্ছে না। কিছু সরকারি অফিস খোলা, কিন্তু এতে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। সহিংসতার ভয়ে অভিভাবকরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। বেসরকারি স্কুলগুলো অভিভাবকদের বলছে, তারা যেন ফ্ল্যাশড্রাইভে করে পাঠদানের ভিডিও এবং পড়ার বইপত্র সংগ্রহ করে নেন।

ফলে এই অঞ্চলের শিশু-কিশোররা এখন বাড়িতে বসে টিভি দেখছে, বাড়ির বাগানে 'পাথর ছোড়া' খেলছে। 'ভারত কাশ্মীরের প্রতি যে অন্যায় করেছে' তা নিয়ে চমৎকার কথা বলতেও শিখেছে তারা। একজন স্কুলশিক্ষক বললেন, 'আমাদের জীবনের পরিসর ছোট হয়ে গেছে, আমাদের মনটাই যেন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।'

রাস্তায় বেরুলে দেখা যায়, ওষুধের দোকান ছাড়া অন্য দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। কড়া নিষেধাজ্ঞার কারণে স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে এখন যেন চেনাই যায় না। রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী এবং অধিকারকর্মীসহ প্রায় তিন হাজার লোক এখন কারারুদ্ধ। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তবে ভারত এসব অভিযোগকে 'ভিত্তিহীন' বলছে।

পুরো রাজ্যই কড়া নিরাপত্তার চাদরে মোড়া এবং এতে এটা নিশ্চিত হয়েছে যে, বড় আকারের কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা নিয়ে পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া যাচ্ছে, 'স্বাভাবিক অবস্থার' আবরণের নিচে টগবগ করে ফুটছে হতাশা আর ক্ষোভ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'লোকজন ক্রুব্ধ, অপমানিত এবং বিচ্ছিন্ন। এমন কোনো নেতা নেই যে, তাদের কিছু করার নির্দেশ দেবে। আর ভারতের কথা এখন ভুলে যান। ভারতের ওপর আর কোনো আস্থাই অবশিষ্ট নেই।' তার কথায়, 'এখন যে অবস্থা দেখছেন, এতে আমার মনে হচ্ছে, ঝড়ের আগের শান্ত পরিস্থিতির মতো। তবে তফাৎ হলো, পরবর্তী প্রতিরোধ আন্দোলন ঠিক কোথা থেকে সৃষ্টি হবে- সেটা আমরা বুঝতেও পারছি না।'

'দ্য জেনারেশন অফ রেজ' বইয়ের লেখক ডেভিড দেবাবাস বলেন, এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে, ২০০৮, ২০১০ এবং ২০১৬ সালে কাশ্মীরি তরুণরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, যা অনেক সহিংসতা এবং অনেক মৃতু্য ডেকে এনেছিল। তিন বছর আগের বিক্ষোভের সময় জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর জনগণের ক্রোধ নতুন জঙ্গিবাদকে অনুমোদন দিয়েছিল।' তার কথায়, '২০১০ সালের বিক্ষোভ ছিল নিরপরাধ মানুষের হত্যার বিরুদ্ধে, কিন্তু ২০১৬ সালে রাষ্ট্রের বৈধতাকে প্রত্যাখ্যান করাটাই ছিল বিক্ষোভে মূল সুর।'

তবে এবার যে বিক্ষোভের খবর গোপন করা যায়নি, সেটা ছিল শ্রীনগরের সুরা এলাকার। সে সময় হাজার হাজার লোক রাস্তায় বিক্ষোভ করে এবং তার ওপর পুলিশ গুলি চালায়, টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। কয়েক সপ্তাহ পর আরেক দফা সহিংসতা হয়।

ভারতের রাজধানী দিলিস্নতে অনেকে মনে করেন, কাশ্মীরিরা সহিংসতায় ক্লান্ত হয়ে গেছে এবং এক সময় তারা মোদির কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের অঙ্গীকারকেই স্বাগত জানাবে। কিন্তু কাশ্মীরে খুব কম লোকই এ কথা সমর্থন করে। কাশ্মীরে ১৯৯০ সালের পর থেকে বিদ্রোহে নিহত হয়েছে ৪০ হাজার লোক। এই বিদ্রোহের কি এখন সমাপ্তির দিন শুরু হলো? নাকি এখন আবার নতুন করে আরেক দফা রক্তাক্ত বিদ্রোহ শুরু হতে যাচ্ছে?

আশিক হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, 'বিক্ষোভের সুনামি আসছে, আমাদের ভেতরে আগুন জ্বলছে। ভারত আমাদের মর্মাহত করেছে, প্রতারণা করেছে। আমরা স্বাধীনতা চাই। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, কাশ্মীরে এই আজাদী বা স্বাধীনতা কথাটার অনেক রকম অর্থ হতে পারে।

কাশ্মীরের ছয়টি জেলায় যুবকদের ওপর ২০১১ সালে এক জরিপ চালিয়েছিলেন নভনিতা চাধা বেহরা- যিনি ব্রম্নকিংস ইন্সটিটিউশনের একজন ভিজিটিং স্কলার। 'ডিমিস্টিফাইং কাশ্মীর' নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। তিনি দেখেছেন, সেখানকার ৫৪ শতাংশ লোক 'আজাদি' চায়। তাদের বেশির ভাগই বলেছে, তারা চায় স্ব-শাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, নিজস্ব সরকার এবং স্বায়ত্তশাসন। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় মাত্র এক শতাংশ লোক। কাশ্মীরে এরপর এমন কিছু হয়নি, যাতে এই মনোভাব পাল্টে গেছে বলে মনে করা চলে। আগামীতে কাশ্মীরে কি ঘটবে, সেটা বলা কঠিন। অতীতে দেখা গেছে, কাশ্মীরে কোনো একটা ঘটনা ঘটার বেশ কয়েক বছর পর বড় মাত্রার অভু্যত্থান ঘটে থাকে। যেমন ১৯৬৩ সালের বিদ্রোহ ঘটেছিল ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা শেখ আবদুলস্নাহর বরখাস্ত এবং গ্রেপ্তারের ১০ বছর পর। তেমনি, ১৯৮৯ সালের জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয়েছিল বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের দুই বছর পর।

লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্সের আন্তর্জাতিক ও তুলনামূলক রাজনীতির অধ্যাপক সুমন্ত বোস বলেন, কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির বিস্ফোরক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আগেকার ঘটনাগুলোর চেয়ে বেশি। সত্যি তাই হয় কিনা, সেটা শুধু সময়ই বলতে দিতে পারবে। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67797 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1