শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
গোয়েন্দা প্রতিবেদন

বেতন নিয়ে পোশাকশিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের শঙ্কা

বর্তমানে দেশে পোশাক কারখানা আছে প্রায় ৪ হাজার ৬২১টি। এর মধ্যে সরাসরি রপ্তানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় আড়াই হাজার। এ খাতে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন
তানভীর হাসান
  ২৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০
বেতন-ভাতার দাবিতে রোববার বিকালে রাজধানীর মালিবাগে পোশাক শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় যানজটের সৃষ্টি হয় -যাযাদি

দেশের তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আগামী ঈদুল ফিতরের আগে গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও বোনাস সময়মতো পরিশোধ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। এজন্য এখন থেকেই এ বিষয়ে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি বলে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। চলতি মাসের মাঝামাঝি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে গার্মেন্ট শিল্প, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার, শেয়ারবাজারের দরপতন, সীমান্ত হাট বন্ধ, গণপরিবহণে চলাচলে ভীতি, গুজব ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদের নেতিবাচক প্রভাবসহ বর্তমান দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি যায়যায়দিনের কাছে সংরক্ষিত আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গার্মেন্ট শিল্পের যন্ত্রপাতি, ফেব্রিক্স, সুতা, বোতাম, রঙের কেমিক্যাল ও কাঁচামালের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশের রপ্তানিকারক দেশ চীন থেকে আমদানি বন্ধ রয়েছে। এসব সরঞ্জামাদির সংকটের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি গার্মেন্ট কারখানার উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। এতে অর্থনীতির পাশাপাশি ওইসব কারখানায় কর্মরতরা বিপাকে পড়বেন। এতে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে পোশাক কারখানা আছে প্রায় ৪ হাজার ৬২১টি। এর মধ্যে সরাসরি রপ্তানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় আড়াই হাজার। এ খাতে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ১ করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশের পরিমাণ প্রতিদিনই বাড়ছে। গত বুধবার পর্যন্ত ৮৪ পোশাক কারখানার ১০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৮৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। পোশাক রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় আরও ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। চীনে গত বছরের নভেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সর্বশেষ ভাইরাসটি দেড় শতাধিকের ওপরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসটির কারণে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। অনেক পোশাকের ব্র্যান্ড তাদের শত শত বিক্রয়কেন্দ্র ঘোষণা দিয়ে বন্ধ রেখেছে। এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের দাবি, করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো বাংলাদেশি পোশাকের বড় বাজার। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে ৬১ দশমিক ৯১ শতাংশ বা ২ হাজার ১১৩ কোটি ডলারের পোশাকের গন্তব্য ছিল ইইউভুক্ত দেশ। আর যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ৬১৩ কোটি ডলারের পোশাক। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'ইউরোপের ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন কারখানার ৭৩ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ স্থগিত করছে। সেটি বেড়ে ১ কোটি ডলারে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্র্যান্ডগুলো বড় ব্যবসা করে থাকে। তার আগেই করোনা আঘাত হেনেছে। ইউরোপে এইচঅ্যান্ডএমের ৬২ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ। সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এ শ্রমিকদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। সরকারের ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছরই অনেক গার্মেন্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নের ঘটনা ঘটে থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে উৎপাদন সরঞ্জামাদির অভাবে এ বছর গার্মেন্ট কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী অর্ডার না পাওয়ায়, উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব আগামী ঈদুল ফিতরে পড়তে পারে। যথাসময়ে বেতন-বোনাস পরিশোধ না করলে তারা আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটাতে পারেন। এ কারণে পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শ্রমঘন এলাকা বিশেষ করে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, অন্যান্য কল-কারখানা, বস্তি এলাকা, বিহারি ক্যাম্প এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাবান, হ্যান্ডওয়াশ, সেনিটাইজার, টিসু্য পেপার, মাস্ক উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ভাইরাসে আক্রান্তের তুলনায় মৃতু্য ঝুঁকি কম। যা গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ। অন্যদিকে মার্স ভাইরাসে মৃতু্যর হার ৩৪ এবং সার্স ভাইরাসে মৃতু্যর হার ৯.৬ শতাংশ। এছাড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্তত্ম ও মৃতু্যর ক্ষেত্রে বয়স একটি কারণ হিসেবে কাজ করে। ৮০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সিদের আক্রান্তের হার ২১.৯ শতাংশ এবং মৃতু্য হার ১৪.৮ শতাংশ। ৭০-৭৯ বছর বয়সিদের মৃতু্যর হার ৮ শতাংশ। ৬০-৬৯ বছর বয়সিদের মৃতু্যর হার ৩.৬ ও ৫০-৫৯ বছর বয়সিদের মৃতু্যর হার ১.৩ শতাংশ। ৪০-৪৯ বছর বয়সিদের মৃতু্যর হার ০.৪ ও ২০-৩৯ বছর বয়সিদের মৃতু্যর হার ০.২ শতাংশ। বয়স্করা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে বার্ধক্যজনিত নানা রোগের কারণে তাদের সংক্রমণ প্রকট হচ্ছে। কিশোর-যুবক থেকে মধ্য বয়সিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকায় আক্রান্ত হলেও নিরাময় লাভ করছে। পরিসংখ্যান দৃষ্টে অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় করোনাভাইরাসকে ভয়ানক আতঙ্কগ্রস্ত ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত না করে বরং যথাযথ সচেতনতা অবলম্বন করলে ভাইরাস মোকাবিলা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে মোবাইল ফোন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি করা এবং নেতিবাচক প্রচারণার মাধ্যমে মানুষ যেন আতঙ্কিত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকা। মার্স ও সার্চ ভাইরাস অপেক্ষা করোনাভাইরাস তুলনামূলক কম বিপজ্জনক এবং মৃতু্যর হারও কম। বিষয়টি মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করা। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও স্বার্থান্বেষী মহল দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি এবং সরকারের প্রতি গণমানুষের আস্থা বিনষ্টের চেষ্টায় সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মৃতু্যকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্য হয়েছে বলে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। এ বিষয়ে নজরদারিপূর্বক দোষিকে দ্রম্নত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। গার্মেন্ট কারখানাসহ শ্রমঘন কলকারখানা এলাকায় প্রতিদিনই সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। অফিস-আদালত, বাসা-বাড়িতে সমষ্টিগতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গার্মেন্টে বেতন-ভাতা পরিশোধে এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ কমপেস্নক্সগুলোতে কোয়ারেন্টিন বেড প্রস্তুত রাখা এবং ফোকাস পয়েন্ট নির্ধারণ করে মোবাইল ফোন নম্বর প্রচার করতে হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পীরের দরবার ও মাজারগুলোতে বার্ষিক ওরস অনুষ্ঠানে অধিক লোক সমাগম হয়, এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি না দেওয়া, দেশের সব বন্দরের চেকপোস্টে ভাইরাস পরীক্ষা কার্যক্রম নিবিড় নজরদারির জন্য প্রয়োজনীয় জনবল পদায়ন করা, জুমার নামাজে খুতবার আগে বয়ানে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়গুলো সম্পর্কে ইমামদের নির্দেশনা দিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া এবং করোনাভাইরাস ইসু্যতে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী মাস্ক, হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজার, টিসু্য পেপার ও থার্মমিটার অস্বাভাবিক মূল্যে বিক্রি করছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা আরও জোরদার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে