শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গিদের মাথায় আইএসের টুপি

নতুনধারা
  ২৭ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩৭
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় সাত আসামির মৃত্যুদ-ের রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণেই তাদের দুজনের মাথায় দেখা গেল কালো টুপি, সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি দল আইএসের পতাকার চিহ্ন।
বুধবার বিশ্বজুড়ে আলোচিত এ মামলার রায়ের পর পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামিদের কাছে কী করে ওই টুপি গেল, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ। কেবল টুপিতে নয়, রায়ের আগে, পরে এবং রায়ের সময় আদালতকক্ষেও আসামিদের আচরণ ছিল উদ্ধত।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলায় নিহত হন ২২ জন, যাদের সতের জনই বিদেশি। ১২ ঘণ্টা পর কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে সেই সংকটের রক্তাক্ত অবসান ঘটে।
হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই সেই সময় মারা পড়ে। হামলায় জড়িত আরও অনেকে পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার আটজনকেই কেবল বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়।
সেই বিচারের রায়ে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান বুধবার সাতজনকে মৃত্যুদ- দেন।
রায়ের আগে আসামিদের যখন হাজতখানা থেকে বের করে আদালত কক্ষে নেওয়া হচ্ছিল, আসামিদের একজন আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখান। কালো পাঞ্জাবি পরা জাহাঙ্গীর আলমের মুখে ছিল হাসি। মামুনুর রশীদ রিপনকে কিছুটা গম্ভীর মনে হলেও বাকিদের হাসতে ও আঙুল তুলে কথা বলতে দেখা যায়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, কাঠগড়ায় তোলার পরও আসামিরা বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছিলেন। নারায়ে তাকবীর স্লোগান দিয়ে বলছিলেন, বিচার হবে হাসরের ময়দানে।
সাতজনের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর তাদের একজন উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, “আল্লাহু আকবর, আমরা কোনো অন্যায় করিনি।”
রায় শেষে আসামিদের মহানগর দায়রা জজ আদালতের পঞ্চম তলায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এজলাস থেকে নামিয়ে আনার সময় আসামি রাকিবুল হাসান রিগ্যানের মাথায় দেখা যায় একটি কালো টুপি, সেখানে আইএস-এর পতাকার ঢঙে আরবি লেখা।
এ সময় তার পাশে পুলিশ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে কাউকে এ বিষয়ে ভ্রƒক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।
পরে আসামিদের কারাগারে নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধীর মাথাতেও একই ধরনের টুপি দেখা যায়। অথচ আদালতে নেওয়ার সময় ওই দুজনের মাথায় কোনো টুপি দেখা যায়নি।
আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কীভাবে ওই টুপি তারা পেলেনÑ সে বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে।
পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) জাফর আহমেদ বলেন, ‘এটা আমরা খেয়াল করতে পারিনি। ধর্মীয় টুপি বলেই মনে করেছিলাম। পরে বিষয়টি নজরে আসে। তবে আদালত থেকে এ ধরনের টুপি আসামিদের হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
অন্যদিকে জেলার মাহবুব আলম বলেন, ‘আসামিদের মধ্যে শুধু একজন আমাদের এখান থেকে সাদা টুপি পরে গেছে। বাকি সবার মাথা খালি ছিল। আমাদের এখান থেকে এ ধরনের কোনো টুপি পরে কেউ যায়নি।’
‘রায় ঘোষণার পর আসামিরা যখন কারাগারে এসেছে, তখনও তাদের কাছে কোনো কালো টুপি পাওয়া যায়নি।’
রায়ের পর প্রিজন ভ্যানে ওঠানোর পর আসামিরা চিৎকার করে বলতে থাকেÑ ‘খেলাফত শাসন প্রতিষ্ঠা হবেই। ‘আমরা আল্লাহর সৈনিক’, ‘আল্লাহর সৈনিকদের মৃত্যু হতে পারে না’, ‘২-৪ জনকে ফাঁসি দিয়ে জিহাদ দমন করা যাবে না’।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি বলতে পারব না, এটা জেল কর্তৃপক্ষ, যেখান থেকে এদেরকে আনা হয়েছে, এই টুপি কীভাবে পরল, এই জবাবটা তারা দিবে। টুপি তারা পরতে পারে, কিন্তু টুপিতে কালো কাপড় দিয়ে প্রতীকী টুপি পরা একটি সংগঠনের, এটা অন্যায়। এটা কোনোভাবে হওয়া উচিত না।’
বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের (জেল কর্তৃপক্ষের) অবহেলা বা গাফিলতি আমি এই মুহূর্তে বলব না। এটা সুষ্ঠুভাবে দেখতে হবে, এটার অবশ্যই তদন্ত হওয়া দরকার, জানা দরকার। আইএসের অনুরূপ কীভাবে এই টুপিটা তারা পরল?’
আব্দুল্লাহ আবু বলেন, নিরাপত্তার অনেকগুলো ধাপ পার করে আসামিদের আদালতে আনা হয়েছে। তার মধ্যে কীভাবে আসামিদের কাছে টুপি গেল, কীভাবে ফিতা লাগালÑ এটা অবশ্যই দেখা দরকার, কেননা বিষয়টি ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পিপি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, ‘আমি মন্তব্য করব না। তবে এর আগে আসামিরা যখনই আদালতে এসেছে এমন কোনো অভিযোগ পাইনি।’
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের হাতে ছিল। আসামিরা কে কী পরে এসেছে সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক নয়। এটা পুলিশের বিষয়।’
পরে প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় দেলোয়ার হোসেন বলেন, তার মক্কেলরা আইএস সমর্থক ‘হতেও পারে’।
গুলশানে হামলার রাতে হলি আর্টিজান বেকারির ভেতরে কী ঘটেছে সে বিষয়ে দেশের মানুষ যখন নিশ্চিত হতে পারছিল না, আইএস-এর মুখপত্র আমাক প্রথমে হামলাকারী পাঁচ তরুণের ছবি এবং পরে নিহত কয়েকজনের রক্তাক্ত ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করে।
আইএস গুলশান হামলার দায় স্বীকার করেছে বলেও সেদিন খবর আসে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা নাকচ করে বলেন, বাংলাদেশি জঙ্গিদের একটি সংগঠিত ধারাই এই হামলা চালিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নব্য জেএমবি’।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়Ñ হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিদের। ১. কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া; ২. বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো এবং ৩. দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা।
হলি আর্টিজান মামলার রায়ের পর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা আসামির মাথায় আইএস-এর টুপি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রশ্ন করেন।
জবাবে তিনি বলেন, “এই ব্যাপারটার তদন্ত হওয়া উচিত। এখনইতো বলতে পারব না কীভাবে তারা পেল। প্রেস কনফারেন্সের পরেই আমি এ ব্যাপারে খোঁজ নেব।”
পুলিশের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, রায় ঘোষণার পরে রিগ্যান আদালতের কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় আদালত ভবনের পঞ্চম তলাতেই কেউ একজন তাকে গেটের কাছে টুপি সরবরাহ করে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রসিকিউশন পুলিশের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন বলেন, তারা ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছেন। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই টুপি আসামিরা সঙ্গে করে এনেছে না আদালত চত্বরে কেউ তাকে দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে