শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি

দেশের জনগণ শুধু ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজি রোধ করলেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় তা মনে করে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি মূলোৎপাটনে কঠোর নজরদারি ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তাহলেই সময়ের দাবি পূরণ করে সরকারের রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৩০ ও ২০৪১-এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কেবল মুখে শুদ্ধি অভিযানের কথা বললেই হবে না। কর্মক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান হতে হবে। সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সীমাহীন লোভের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক সরকারের সুনাম। সুতরাং প্রশাসন থেকে শুরু করে সব সেক্টরে স্বচ্ছতা আনতে হলে সরকারকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। এটাই এখন সবচেয়ে বড় কর্তব্য ও দায়িত্ব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'কাউকে ছাড় নয়, সবার আমলনামা আমার কাছে'। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে গেছেন তিনি। আমরা তার এই হার্ডলাইনে যাওয়াকে স্বাগত জানাই। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের শ্রদ্ধেয়া প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবেন এবং অবশ্যই শুদ্ধি অভিযানে দেশ সুন্দর থেকে সুন্দরময় হয়ে উঠবে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে- যারা যে বিষয়ের ওপরে শুদ্ধি অভিযান চালাবেন, সেই শুদ্ধি অভিযানের শুদ্ধতার কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারবেন কি না? যদি ব্যর্থ হন তাহলে জাতির পরাজয় হবে অনিয়ম, দুর্নীতি, অপরাধের কাছে। একবার একটু ভেবে নিন- দয়া নয়, মায়া নয়, ছেড়ে দেয়া নয় এই প্রতিজ্ঞা করে সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, জবর-দখলকারী, খুনি, ধর্ষণকারী, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে শুদ্ধি অভিযানটি জনগণ এখন দেখতে চায়। প্রয়োজনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে শুদ্ধি অভিযান চালালেই জাতি নিরাপদ থাকবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, রাষ্ট্রের বড় শক্তি হচ্ছে জনগণ। সরকারের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা ভালো। এতে জনসাধারণ কিছুটা হলেও সতর্কতা অবলম্বন করে চলে। আর ছিনতাইকারী, জোরজুলুমকারী, রাহাজানি, ধর্ষণ, দখলদার, চাঁদাবাজের মতো অপরাধীরাও সাময়িকভাবে কিছুদিনের জন্য আত্মগোপন করে থাকে। ফলে দেশের মানুষ শান্তিশৃঙ্খলা ও স্বস্তিতে বসবাস করেন। কাজেই দেশের জন্য এটি একটি সুখবরও বটে। মোটকথা এ ধরনের অভিযান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। তবে সেই শুদ্ধি অভিযান যেন নিছক ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক বা ব্যক্তি বিশেষকে শায়েস্তা করার জন্য যেন না হয়। সেদিকে কঠোর স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। শুদ্ধি অভিযানের কথাকে এখন বাস্তবে রূপ দিতে হবে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে মূল কথা। এর শুরু করতে হবে এবং ফলাফলও আমরা সুন্দরভাবে দেখতে চাই। স্বাধীনতা লাভের পর আজ প্রায় ৪ যুগ পার করেছে বাংলাদেশ। বিগত ৩ যুগ ছিল অনেক কণ্ঠকাকীর্ণ। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কথাটা সত্য এবং তাই শুদ্ধি অভিযানের পদক্ষেপ সময় উপযোগী। প্রাপ্ত তথ্যমতে ঢাকায় ৬০টি অবৈধ ক্যাসিনো চলে। বিভিন্ন ক্লাব ও ক্রীড়া সংগঠনের আড়ালে রমরমা জুয়াবাণিজ্য ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে এই শুদ্ধি অভিযানকে আমরা স্বাগত জানাই। শুদ্ধি অভিযান সবার জন্য সমানভাবে চালিয়ে যেতে হবে। সে রাজনীতিবিদ হোক কিংবা চাকরিজীবী কিংবা নির্বাচিত প্রতিনিধি। সবাইকে সমান নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। আর তখনই শুদ্ধি অভিযানের সঠিক ফলাফল আমরা পাব। সর্বক্ষেত্রে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। ইদানীং রাজধানী ও দেশের অন্যান্য স্থানে খুন, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্নীতি, অনিয়ম অনেক বেড়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও নজরদারিতে আনা এবং পুলিশের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে শুদ্ধি অভিযান দৃশ্যমান হবে এবং দেশের মানুষ স্বস্তি পাবে। শুদ্ধি অভিযানের কথা অনেক সময় শোনা যায়। কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখা যায় না। অনিয়ম, অব্যস্থাপনা, ঘুষ দুর্নীতি, জবর-দখলদারি, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন অনেক বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাই শুদ্ধি অভিযানের কথা আবারও শোনা যাচ্ছে। আমরা এবার এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেখতে চাই। বর্তমানে শুদ্ধি অভিযানের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু অনেক শুদ্ধি অভিযান এখন দৃশ্যমান। দেশে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনেক। অপরাধীকে যখন ধরা হয় তখন বলা হয় তদন্ত হবে। বিচার হবে। কিন্তু পরে দেখা যায় তদন্ত, বিচার বা শাস্তির খবর আর পাওয়া যায় না। ফলে জবাবদিহির বাইরে শাস্তির ব্যত্যয়কে পাশ কাটিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলে। তাহলে শুদ্ধি অভিযান হবে কীভাবে? সর্বস্তরে শুদ্ধি অভিযান দ্রম্নত শুরু করা উচিত। দীর্ঘদিন ধরে দেশজুড়ে শুদ্ধি অভিযান না থাকায় সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ফিরে আসবে। সমাজ ও দেশ থেকে বিতাড়িত হবে অপকর্ম, কুকর্ম, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম স্বজনপ্রীতি, রাজনীতিতেও থাকবে না দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মী। শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে সবক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মূল করা হোক। শুদ্ধি অভিযানে শুদ্ধি আসবে তখনই যখন অভিযান পরিচালনার সময়ে রাজনৈতিক বা দলীয় কোনো প্রভাব থাকবে না। বিগত সময়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রশাসনের সহায়তায় সারা দেশব্যাপী যখন শুদ্ধি অভিযান চালায় তখন টেকনাফের একজন গডফাদারের নাম বারবার চলে এসেছিল বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত রিপোর্টে; কিন্তু কিছুই হয়নি। তার বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানে তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারে নাই অভিযান কর্তৃপক্ষ। সুতরাং জনগণ এমন শুদ্ধি অভিযানই দেখতে চায় যেখানে কোনো রাজনৈতিক বা দলীয় প্রভাব থাকবে না। শুদ্ধি অভিযানের ফলে অনেক অপরাধীরা ধরা পড়ে আবার অনেকে অপরাধপ্রবণতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। তাই সব শুদ্ধি অভিযান সবার কাম্য। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে নানামুখী শুদ্ধি অভিযান যদি সফলতার সঙ্গে অব্যাহত থাকে, তাহলে সমাজ থেকে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। পাশাপাশি নদী দখল ও দূষণ রোধ করাও সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যে জঙ্গি দমনে সফল হয়েছে। অন্যান্য সামাজিক অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেও সরকারের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। সরকারের ইতিবাচক কাজের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে তা হলে বাংলাদেশ অচিরেই উন্নত, নিরাপদ ও সুখীসমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। শুদ্ধি অভিযানে যদি কোনো শুদ্ধতা না আসে সরকারের জন্য তা হবে বড় চ্যালেঞ্জিং ও কঠিন অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কেন্দ্রীয় নেতা এবং সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং সেই সঙ্গে তাদের আমলনামা পর্যবেক্ষণ করে, যত তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিয়ে এই শুদ্ধি অভিযানের সমাপ্তি ঘটাতে পারবেন তাই হবে বর্তমান সরকারের অর্জনের ধারাবাহিক সফলতা। অন্যথায় সরকারের এ পর্যন্ত সব অর্জন ম্স্নান হয়ে যাবে। শুধু সাংগঠনিক ব্যবস্থা নয়- আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হবে। তৃণমূলে যাদের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দলেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজদের মদদ না দিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নেতাকর্মীদের কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছেন তিনি। রাজনীতির নামে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তি প্রয়োগ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন শেখ হাসিনা। দুর্নীতি, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফলাও প্রচার ও এর বিরুদ্ধে সরকারের অ্যাকশনে নেমে যাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পর্যালোচনা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। সাদা চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তার অন্তরালে আরও কিছু আছে কিনা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। কেউ কেউ বলছেন, রাষ্ট্রকাঠামোয় লুটপাট কিংবা দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে আশ্রয়-প্রশ্রয়ের বিস্তার ঘটে দলীয় সন্ত্রাসের। কিন্তু রাজনীতির অনুপস্থিতিতে হঠাৎ করে এসব ইসু্য শক্তভাবে জায়গা করে নেয়ার পেছনে ভিন্ন কোনো কারণ থাকতে পারে। অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির চিত্র ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে আসবাবপত্রসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্য কেনায় ব্যাপক দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে মাস দুই আগে। ওই প্রকল্পের ভবনের জন্য ১ হাজার ৩২০টি বালিশ কেনা হয়েছে। এদের প্রতিটির মূল্য দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। আর সেই প্রতিটি বালিশ নিচ থেকে ভবনের উপরে তুলতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। শুধু বালিশের বিষয়েই নয়- ওই প্রকল্পে আসবাবপত্র কেনা ও তা ফ্ল্যাটে তোলার ব্যয়ে ৩৬ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা এখন 'বালিশ কান্ড' নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ ছাড়া ঘর মেরামতের কাজে একটি ঢেউটিনের দাম এক লাখ টাকা, রেলওয়ের প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্পে ৪১ কর্মকর্তা পানি বিশুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণের নামে আনন্দ ভ্রমণে গিয়েছেন উগান্ডায়- এমন সব অনিয়ম, দুর্নীতি ও হরিলুটের খবর একের পর এক বেরিয়ে আসছে সাম্প্রতিক সময়ে; যা সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে অনেকে মনে করেন। বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, রাষ্ট্রীয় খাতে ক্ষমতার অপব্যবহারে এই দুর্নীতির ঘটনাগুলো ঘটছে। জবাবদিহি না থাকায় লাগামহীন অবস্থায় চলে গেছে দুর্নীতি। সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ খাতে ক্রয়, নিয়োগ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। কাগজের সঙ্গে বাস্তব কাজের মিল নেই। টিনের দাম কিংবা বালিশকান্ড- প্রতিটি দুর্নীতিই যোগসাজশে হয়। উন্নয়নের নামে লুটপাট করে পরে চলে ভাগবাটোয়ারা। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন নানা উইং থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী চাঁদাবাজি, মাদক ও সন্ত্রাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সেক্রেটারি রব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান এমনি এমনিতেই ঘটছে না। কারণ ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেনে সরকার এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হচ্ছে। প্রথাগত রাজনীতির অনুপস্থিতিতে লুটপাট, সন্ত্রাসের মতো এমন ইসু্য সামাজিক আন্দোলনের সূচনা ঘটাতে পারে- এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও ন্যায়-নৈতিকতার ভিত্তিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের আন্দোলনকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ বছরের একটি দিনকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আজ এই দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনাকে অবমাননা করছে। সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আদর্শ ও নৈতিকতা। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে এ দেশের যুবসমাজ সবচেয়ে বড় শক্তি এবং অপার সম্ভাবনা। অদম্য আগ্রহ, সৃজনশীলতা এবং সুন্দর বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তাদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ আজ সময়ের দাবি। প্রাজ্ঞ ও প্রবীণরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাদের অভিজ্ঞতা, সততা, দক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কিন্তু জাতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ভর করে দেশের তরুণ প্রজন্মের ওপর। বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের যে জোয়ার আজ সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলেও রয়েছে তরুণ শিক্ষার্থী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আমাদের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছে। আত্মশক্তি বিকাশের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীসমাজ তথা তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হতে বাধ্য। ছাত্রসমাজ আগামী দিনে যেমন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে, তেমনি আজকের বাংলাদেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সুশাসন ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। সব অন্যায়-দুর্নীতিকে 'না' বলার দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে সর্বাত্মক নৈতিকতা চর্চার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি দমনের জন্য সামাজিক আন্দোলন তথা শুদ্ধি অভিযানের বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, দেশপ্রেম এবং তারুণ্যের অঙ্গীকার। তরুণ ও যুবকদের দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের যুবসমাজ অসততা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরোধিতা শুরু করলেই কেউ কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করার সাহস পাবে না। আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে পারি, তবে এর সুফল দেশের প্রতিটি নাগরিক ভোগ করবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। দুর্নীতি কোনো রাষ্ট্রের একক সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির প্রকোপের কারণে দারিদ্র্য বিমোচন এবং কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না। তাই সারা বিশ্বে জাতিসংঘের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালিত হচ্ছে। গত বছর থেকে দুদকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারিভাবে দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজি একটি আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজির মূল হোতারা দেশ ও জাতির শত্রম্ন। কোনো অবস্থাতেই এই চক্রের কাছে সাধারণ প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসন তাদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে ব্যবহৃত হতে পারেন না। তাহলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুদূর পরাহত হবে। এহেন অবৈধ ক্যাসিনো চক্র ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানে নেমে কঠোর আইনি প্রয়োগের বিধান নিশ্চিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে এসব অনিয়ম ও অনাচার রোধকল্পে নিবিড় পর্যবেক্ষণ দল গঠন করতে হবে। প্রতিটি পর্যবেক্ষণ দলকে কাউন্টার বা পাল্টা পর্যবেক্ষণব্যবস্থা তৈরি করে এমন কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে হবে। তাহলেই শুদ্ধি অভিযান কার্যকর ও ফলপ্রসূ অভিধায় আখ্যায়িত হবে বলে দেশের সাধারণ জনগণ মনে করে। দেশের জনগণ শুধু ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজি রোধ করলেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় তা মনে করে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি মূলোৎপাটনে কঠোর নজরদারি ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তাহলেই সময়ের দাবি পূরণ করে সরকারের রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৩০ ও ২০৪১-এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে