শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খেলা দিয়ে বিশ্ব জয়, আর কল্পনা নয়

আব্দুল খালেক মন্টু পাবনা
  ১৫ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

মানুষের দুটি সত্তা, দৈহিক ও মানসিক। এই দুটি সত্তার বিকাশ সমান না হলে পরিপূণর্ মানুষ হওয়া যায় না। কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার জন্য বলা হয়, এটা কোনো ছেলাখেলা নয়। ছেলেমেয়ে বা যুবকযুবতীরা খেলাধুলা করে সত্য, কিন্তু তাই বলে বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। ছেলেমেয়েদের মানসিক উৎকষর্ লাভের জন্য যেমন শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রয়োজন, তেমনি দৈহিক উৎকষর্ লাভের জন্য খেলা ও খেলার মাঠ প্রয়োজন। তাই আগের যুগে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান শতর্ ছিল খেলার মাঠ। লেখাপড়া ও খেলাধুলা মন ও শরীর গঠনের জন্য অপরিহাযর্ অনুষঙ্গ। স্বাস্থ্য শাস্ত্রের মতে, শরীরের সঙ্গে মনের গভীর সম্পকর্। শরীর ভালো না থাকলে মন ভালো থাকে না। আবার মন ভালো থাকার অন্যতম শতর্ হলো স্বাস্থ্য ভালো থাকা। তাই খেলাকে ছেলেখেলা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং খেলার গুরুত্ব মানুষের জন্য অপরিসীম। খেলাধুলা, শরীর চচার্ বা ব্যায়াম-যোগব্যায়াম, পিটিপ্যারেট, স্পোটের্সর বিভিন্ন ইভেন্ট, সঁাতার, সাকার্স ও জিমন্যাস্টিকসের আবশ্যকতা লেখাপড়া বা জ্ঞানাজের্নর মতো শিশুকাল থেকে মৃত্যু পযর্ন্ত সমানভাবে প্রয়োজনীয়। রাজনীতি ও ধমর্ যা করতে পারছে না, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা তা পারছে। রাজনীতি, সাহিত্য ও ধমর্, সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। কিন্তু প্রচলিত রাজনীতি নিমোর্হ বা নীতির মধ্যে সেরা বা রাজা হতে পারছে না। তাই রাজনীতির নামে মানুষে মানুষে ঐক্যের পরিবতের্ বিভেদবিভ্রান্তির জন্ম হচ্ছে। মারামারি, খুনাখুনি, যুদ্ধবিগ্রহ ও দখল বাণিজ্য ছাড়া কল্যাণকর কিছু হচ্ছে না। তাই রাজনীতি দিয়ে বিশ্ব জয় সম্ভব হচ্ছে না। ধমের্র উদ্দেশ্য মানুষের মানবতার জয়গান গাওয়া। ধমের্র সেই আসল উদ্দেশ্য আজ বিকৃক হয়ে যাচ্ছে। ধমের্ ধমের্ কোনো বিরোধ না থাকলেও তথাকথিত ধামিের্ক ধামিের্ক বিরোধ হচ্ছে। ধমীর্য় প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদ, মন্দির, গিজার্ বা উপাসনালয়গুলোকে জঁাকজমকপূণর্, আকষর্ণীয়, সুন্দর ও আরামদায়ক করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষের মন বা হৃদয়কে তা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। বরং ধমের্ক কুৎসিত করার জন্য ধমীর্য় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানো হচ্ছে। ধমের্র নামে হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি ও খুনাহত্যা পযর্ন্ত করা হচ্ছে। তাই ধমর্ দিয়ে বিশ্বমানবতার কোনো কল্যাণ সাধন হচ্ছে না। সুতরাং ধমর্ দিয়ে বিশ্ব জয় সম্ভব হচ্ছে না। সাহিত্য মানুষের হৃদয়কে রঞ্জিত করে। মানুষের মহত্ত¡গুলোকে উদ্বোধিত করে। কিন্তু সেখানেও দুবর্লতা আছে। অনেক সময় সাহিত্য সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বিভেদবিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। সাহিত্যের সৃজনশীল শক্তি তাই আশানুরূপ কাজ করতে পারছে না। তাছাড়া সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাহিত্যের ধারেকাছেও নেই। সৃজনশীল সাহিত্য কমর্ যারা উপহার দিচ্ছেন, তারা মননচচ্চা করলেও অনেকে শরীর চচার্ করছেন না। তারা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবল হলেও দৈহিকভাবে দুবর্ল থাকছেন। তাছাড়া বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা অবদান রাখছেন, তারা অনেক সময় অবিচার বা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু খেলা, একমাত্র খেলা দিয়েই বিশ্ব জয় করা সম্ভব হচ্ছে। মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা এনে দিচ্ছে খেলা। একজন খেলোয়াড়কে অবশ্যই শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট হতে হয়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আজ খেলার অবদানই অধিক। বিশ্ববাসীকে এক কঁাতারে এনে দঁাড় করাচ্ছে খেলা। দেশ-জাতি, ধমর্-বণর্ ও শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ আজ খেলার আসরে একাকার হয়ে যাচ্ছে। খেলার কাছে হিংসা-বিদ্বেশ ও বৈষম্যের উপাসকরা হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। সারা পৃথিবীর মানুষের মন বা হৃদয় জয় করছে খেলা। সুতরাং একমাত্র খেলাই যে বিশ্ব জয় করতে সক্ষম হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া পৃথিবীতে যেসব জাতি মানসিক ও শারীরিকভাবে উন্নত, তারাই সুন্দর ও উন্নত জাতি। খেলায় হারজিৎ থাকবেই। একজনের কাছে বা একদলের কাছে অন্যরা বা অন্য দলের হার অবধারিত। কিন্তু অন্য বিষয়গুলোর মতো খেলায় কোনো বিরোধ বা বিতকর্ হয় না। হেরে যাওয়ারা বা দল বিনাবাক্যে তা মেনে নেয়। তারপর পরস্পর হাত ধরাধরি ও কোলাকুলি করে বিদায় নেয়। অসম্ভব সুন্দর এই সৌহাদর্্য। বিলু কবীরের ভাষায় - ‘ভাবে-অন্তরে, নৈপুণ্য-দক্ষতার, আনন্দে-উচ্ছ¡াসে, ভ্রাতৃত্বে-ভ্রাতৃত্বে, অঞ্চলে-অঞ্চলে, প্রীতিতে-ভালোবাসায় এমন কি রাজনৈতিক-ক‚টনৈতিক ক্ষেত্রে পযর্ন্ত এক অসাধারণ মানবিক বিশ্ব মঙ্গলের এ যেন এক বিস্ময়কর মিথক্রিয়া। এ যেন বন্ধুত্বের নবায়ন, দেশে দেশে সখ্য গড়ার অতি বৃহত একটি আনন্দমুখর সোপান। ‘খেলার প্রতি, স্বদেশের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি, আমাদের যে প্রেম-শ্রদ্ধার বহি:প্রকাশ ঘটে, তার মূল্য কি খুবই সামান্য? নাকি বোধের, বিশ্বপ্রেমের নানা বঁাকে দুযোের্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তা আমাদের সাহায্য করে -আন্দোলিত করে। বিলাসিতার মতো মনে হলেও গভীরে তার নানা গুরুত্বপূণর্ হিসাব কিন্তু রয়ে গেছে। এসব কারণে খেলা শুধুই খেলামাত্র নয়। ’ মানুষের বুদ্ধিমত্তা এ জগতে একমাত্র। চেতনা বা বোধে মানব জ্ঞানই এ পযর্ন্ত একক ও অনন্য। একাগ্র চিত্তে মানুষ যদি কিছু পেতে চায় এবং পাওয়ার জন্য সাধনা চালায় অবশ্যই তা পায়। যেমন -মানুষ কিশোর বয়স হতে শরীর গঠনের ব্রতী হলে সুঠাম দেহের অধিকারী হতে পারে। সেরূপ বিদ্যান বা জ্ঞানী হওয়া, ধামির্ক বা ধমর্প্রাণ হওয়া এবং ধনবান বা সম্পদশালী হওয়াও অসম্ভব নয়। এরূপ প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভের জন্য সাধনার কোনো বিকল্প নেই। একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় হওয়ার জন্য নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়, কঠোর সাধনার প্রয়োজন হয়। তারপরই কেবল ওই খেলোয়াড়ের পক্ষে শিল্পসম্মত ও নান্দনিক খেলা উপহার দেওয়া সম্ভব হয়। যে খেলোয়াড় বা দল যত বেশি পারদশীর্ হয়ে ওঠে এবং ছন্দময়-নান্দনিক খেলা উপহার দিতে পারে, জয় তার বা তাদের কাছেই ধরা দেয়। যে খেলোয়াড় যত দুদার্ন্ত, শিল্পসম্মত ও নান্দনিক খেলা উপহার দিতে পারেন, তার সুনাম ও মূল্য তত বেড়ে যায়। সাম্প্রতিককালে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তজাির্তক পরিমÐলে নিয়মিত বিভিন্ন খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ক্রিকেট, হকি, ফুটবল, অলিম্পিকসহ বিভিন্ন আসর আন্তজাির্তকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। অঘোর মÐলের লেখার সারকথা- বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা মানে একমাসের যুদ্ধ। আবার বিশ্বকাপ খেলা মানে গেঁাা পৃথিবীর খেলাপ্রেমিদের এক মহা মিলনমেলা। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় এবার অংশ নিয়েছে ৩২টি দেশ। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়েছে পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ। দেখা গেছে বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে সীমাহীন আবেগ-উত্তেজনা-উন্মাদনা। যে আবেগে অনেকেই ভুলে গেছেন, নিজেদের ভৌগোলিক পরিচয়, নিজেদের জাতীয় পরিচিতি। বিশ্বের কয়েকশো কোটি মানুষ লীন হয়ে যান এক আতœায়, ফুটবল আবেগে ভাসতে থাকেন এক সাগরে, সবাই হয়ে যান ফুটবলপ্রেমিক। বিশ্বের এক গোলাধের্র মানুষ আরেক গোলাধের্র মানুষের পরম আত্মীয় হয়ে যান। কি অসম্ভব ক্ষমতা ফুটবল খেলার, গোটা বিশ্বের মানুষকে একবিন্দুতে এনে দঁাড় করাতে পারে ভালোবাসা দিয়ে। আর সে ভালোবাসার নাম বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা। অন্যায়ের চোখ রাঙ্গানী দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে বিশ্বজয় করা যায়। ফুটবল খেলাকে ভালোবেসে কোটি কোটি মানুষ আজেির্ন্টনা- ব্রাজিলকেই ভালোবেসে ফেলেছে। আজেির্ন্টনা নামের দেশটির যে জনসংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি সমথর্ক রয়েছে বাংলাদেশে। আর ব্রাজিল বলে তো এদেশের সমথর্করা অন্ধ-পাগল। আবার পঁাচবার বিশ্বকাপজয়ী দলটির নামও ব্রাজিল। গত শতাব্দীতে শুধু নয়, এই শতাব্দীতেও তারা কাপ জিতেছে। কিন্তু কাপ তো জামাির্নও জিতেছে দুই শতাব্দী মিলে চারবার। ইতালি জিতেছে চারবার। কিন্তু বাঙালির হৃদয় স্পশর্ করতে পারেনি দেশদুটি সেভাবে। মাত্র দুবার বিশ্বকাপ জিতেছে আজেির্ন্টনা, তাও গত শতাব্দীতে। অথচ ওই দেশটির সমথর্ক এ দেশে সবচেয়ে বেশি। তারা জানেন পেলে নামের একজন ফুটবল সম্রাটের কথা, তার দেশ ব্রাজিল। সেই সম্রাটের সাম্রাজ্যের অধের্ক মালিক এখন ম্যারাডোনা নামের এক আজের্ন্টাইন। পেলের খেলা দেখার সৌভাগ্য না হলেও ম্যারাডোনার খেলা অনেকেই দেখেছেন গত শতাব্দীর শেষের দিকে। যাকে পেলে পরবতীর্ প্রজন্ম ফুটবলের রাজপুত্র বলে মনে করেন। হাজার হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থ লিখে ব্রাজিল বা আজেির্ন্টনা যা করতে পারবে না অথবা কোটি টাকার বিজ্ঞাপন প্রচার করে ল্যাটিন আমেরিকার ওই দেশদুটি যা করতে পারবে না, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি তুলে ধরতে পেরেছে পেলে ও ম্যারাডোনা। দুভার্গ্যবশত এবার ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের মহারণে দেশ দুটি টিকে থাকতে পারেনি। কোটি কোটি সমথর্ককে হতাশ করে বিদায় নিয়েছে আগেই। তাই শেষের খেলাগুলো অনেকটা পানসে বলে মনে হয়েছে এ দেশের উন্মাতাল দশর্কদের কাছে। পরিবতর্নশীল বিশ্বে ফুটবল খেলায়ও যে পরিবতর্ন আসবে এটাই স্বাভাবিক। এখন দেখা যাক -পেলে -ম্যারাডোনা পরবতীর্ ফুটবল বিশ্বের সম্রাট - রাজপুত্র হন কারা। মেসি-রোনালদো-নেইমার-পরবতীর্ নক্ষত্র হন কারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে