শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাগামহীন চিকিৎসা খাত

বাংলাদেশের ওষুধ একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। জাতীয় ওষুধ নীতিমালায় কিছু দিক সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কাযর্কর, নিরাপদ ও মানসম্পন্ন ওষুধ। তাই নকল, ভেজাল, নিম্নমান, মেয়াদোত্তীণর্ ওষুধ ফামেির্সতে মজুদ, প্রদশর্ন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে নীতিমালায় এসেছে। তা সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি। শুধু নীতিমালা বা আইন করলেই চলবে না তার যথাথর্ প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
মোহাম্মদ নজাবত আলী
  ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৫৩

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় দেখা গেছে দেশের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতে কমিশনভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এই খাতে বাণিজ্যকরণের প্রবণতা প্রকট। সরকারের যথাযথ মনোযোগের ঘাটতি থাকায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। অথচ সেবা গ্রহীতারা ব্যাপকভাবে আথির্ক ও শারীরিক ক্ষতির শিকারের পাশাপাশি মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অতিস¤প্রতি টিআইবি কাযার্লয়ে ‘বেসরকারি চিকিৎসাসেবা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীষর্ক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিবন্ধিত ১১৬টি বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

চিকিৎসা এক মানবিক সেবা ও পেশার নাম। মানব সেবার নামে এ সেবায় অথর্, মুনাফা বা অন্য কিছু অজের্নর চেয়ে মানবসেবাই মুখ্য হওয়া উচিত। মানবসেবার মধ্যে নাকি সৃষ্টিকতাের্ক পাওয়া যায়। জ্ঞানী-গুণীর মুখ থেকে আমরা বহুবার এরকম সত্য নীতিবাক্য আগেই শুনেছি। তাই টাকা পয়সা সব কিছুর ঊধ্বের্ থেকে কায়মনোবাক্যে হৃষ্টচিত্তে মানব সেবা প্রাধান্য পাওয়া উচিত। যুগ যুগ ধরে চিকিৎসার এ মানব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে আসছে চিকিৎসকরা। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কালের বিবতের্ন চিকিৎসায় মানুষের সেবার ক্ষেত্রে সে সত্যবোধ নীতিবাক্য হারিয়ে গিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে অথর্ বাণিজ্য। যার কারণে বতর্মানে হাজার বছরের চিকিৎসায় মানবসেবার দিকটা আজ উপেক্ষিত। আমাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা একটি। তাই আমাদের সংবিধানেও মানবসেবায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকে অন্তভুর্ক্ত করে নাগরিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ৪৭ বছরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি দেশে সরকারি-বেসরকারি পযাের্য় বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। চিকিৎসাকে প্রকৃত অথের্ই মানবসেবায় পরিণত করতে বেসরকারিভাবে আরও হাসপাতাল ক্লিনিক স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। মানুষ বেকায়দায় বা সমস্যায় না পড়লে পুলিশ বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। সাধারণ নাগরিক স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা করে চিকিৎসা সেবাকে প্রকৃত অথের্ই মানবিক সেবা ও পেশা হিসেবে বেছে নেবে এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। দেশে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিক মানব সেবার হাত বাড়িয়ে দিলেও বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ভূমিকা যথাথর্ নয়, প্রশ্নবিদ্ধ। মানবসেবার নামে যে চিকিৎসা শাস্ত্রের তৈরি হয়েছে, ডাক্তার তৈরি হয়েছে কিন্তু অধিকাংশ ডাক্তারের আচার আচরণ সন্তোষজনক নয়। সেবার মানও প্রশ্নবিদ্ধ। অথর্ অজের্নর জন্য ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে পযার্প্ত ডাক্তার নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রীর যথেষ্ট অভাব। এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিকরা যা ইচ্ছে তাই করেন। সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না।

অথচ, স্বাস্থ্য চিকিৎসাকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সংবিধানে। দেশে সরকার অনুমোদিত ও অননুমোদিত অনেক চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। অধিক ব্যয় সাপেক্ষ এসমস্ত চিকিৎসা কেন্দ্রে সবার পক্ষে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। সমাজে যারা অথর্ বিত্তশালী তাদের চিকিৎসা অধিক ব্যয় সাপেক্ষ হলেও নিম্ন মধ্য হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যের চিকিৎসা নেয়া অনেকটা কঠিন। উপরন্তু ভুল চিকিৎসা ও প্রতারণার মাধ্যমে অথর্ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি এসব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে দেশের প্রায় ৬৮ ভাগ মানুষ চিকিৎসা নেয়। কিন্তু সমাজের এ সিংহভাগ মানুষরা প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সরকারের তদারকি না থাকায় মালিকরা কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেন না। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে সরকার কতৃর্ক অনুমোদন পেয়েছে। দেশের হাসপাতাল ক্লিনিক, কমিউনিটি সেন্টারগুলো গড়ে উঠেছে মূলত জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে। বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা হাসপাতাল-ক্লিনিক, পরিচালনা করতে গেলে যে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ওষুধের প্রয়োজন পড়ে তা বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। এসব চিকিৎসাসামগ্রী বা ওষুধের জন্য বেসরকারি উদ্যেক্তারা সরকারি ভতুির্কও পেয়ে থাকেন। কিন্তু তারা অধিকাংশ সময়ই রোগীরা সঠিক চিকিৎসা ও সেবা পান না। যেটুকুই পান তা অথের্র বদৌলতে। পযার্প্ত ওষুধ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, উপযুক্ত প্যাথলজি নেই। আবার কখনো কখনো অপচিকিৎসা বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে লঙ্কাকাÐ শুরু হয়, চিকিৎসা ফি-ও অনেক, যা গরিব মানুষের পক্ষে জোগান দেয়া অনেকটা কঠিন। অভিযোগ রয়েছে ডাক্তারদের সাটিির্ফকেট ও দক্ষতা নিয়েও। কোনো রোগী এলেই তাকে প্যাথলজি, রক্ত বা অন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় তাদের মনোনীত কোনো ক্লিনিক বা ল্যাবরেটরিতে। কারণ সেখান থেকেও ডাক্তাররা আথির্ক সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাই জনগণের স্বাস্থ্যসেবার নামে যা চলছে তাতে সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ওষুধের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বতর্মান ওষুধের গুণগত মান এতটা নিম্নমুখী যে তাতে রোগীর রোগ ভালো তো হয় না বরং রোগ আরও বেড়ে যায়। বাংলাদেশে যেভাবে ওষুধ শিল্পের প্রসার ঘটেছে তা অভাবনীয় এবং ইতিবাচক। স¤প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ওষুধ শিল্পের প্রসার ও নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ওষুধনীতি-২০১৬ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখা উচিত ওষুধ হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী একটি গুরুত্বপূণর্ উপাদান। বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ পৃথিবীর ১৫০টি দেশে রপ্তানী হচ্ছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। তাই ওষুধের যেন গুণগত মান বজায় থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা অবশ্যই উচিত। ভেজাল ও মানহীন ওষুধ মানব জীবনে ক্ষতিকর যেমন ক্ষতিকর ভেজাল খাদ্য। পত্রপত্রিকার রিপোটর্ থেকে জানা যায় বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন মাকেের্ট অভিযান চালিয়ে প্রচুর পরিমাণ অনিবন্ধিত নকল ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়। এক শ্রেণির অসাধু অতি মুনাফালোভী চক্র রয়েছে যাদের কাজই হচ্ছে মানুষকে ঠকানো এবং এরাই নকল ভেজাল ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। তবে ভেজাল নকলের তালিকায় শীষের্ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক ওষুধ। স¤প্রতি সরকার ১০টি ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে। পাশাপাশি ২৩টি কোম্পানির এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন, বিপণনে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। তবুও কিছু কিছু কোম্পানি সরকারের নিদের্শ উপেক্ষা করে মানহীন ওষুধ উৎপাদন বিপণন অব্যাহত রেখেছে বলে জানা যায়। সঙ্গত কারণেই বিষয়টি আমলে নিতে হবে এবং আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কারণ সরকারী নিদের্শ উপেক্ষা, মানহীন নকল ভেজাল ওষুধের ব্যবহার মানুষের জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ যেন মানুষের জীবন নিয়ে খেলা।

ওষুধের গুণগত মান নিণের্য়র দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র দুটি ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি রয়েছে। এগুলোতে বছরে সাধারণত ৪ থেকে ৫ হাজার ওষুধের নমুনা বা গুণগত মান পরীক্ষা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন ওষুধ কারখানাগুলোতে ২৭ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হয়। যদি তাই হয়ে থাকে ২২ হাজার ওষুধ কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বাজারে চলে যাচ্ছে, বিক্রিও হচ্ছে অবাধে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, ওষুধের মধ্যে যে হারে বিভিন্ন উপাদান থাকার কথা সেগুলো না থাকলেই ওই ওষুধ মানহীন। আর মানহীন ওষুধই হচ্ছে বিষ। তাহলে মান নিণের্য়র পযার্প্ত ল্যাবরেটরি না থাকায় এসব ওষুধ সেবনের নামে মানুষ বিষ পান করছে! নকল ভেজাল মানহীন ওষুধ রোগ নিরাময়ের পরিবতের্ রোগকে আরও বাড়িয়ে দেবে। তাছাড়া প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন ওষুধও বাজারে আসছে। কি পরিমাণ ওষুধ বাজারে আসছে তার সঠিক কোনো তথ্য যেমন নেই তেমনি ওষুধের মান নিণর্য় ও যথাযথ হচ্ছে না। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ শিল্পকে আরও গতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা মান নিণের্য় ল্যাবের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশের ওষুধ একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। জাতীয় ওষুধ নীতিমালায় কিছু দিক সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কাযর্কর, নিরাপদ ও মানসম্পন্ন ওষুধ। তাই নকল, ভেজাল, নিম্নমান, মেয়াদোত্তীণর্ ওষুধ ফামেির্সতে মজুদ, প্রদশর্ন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে নীতিমালায় এসেছে। তা সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি। শুধু নীতিমালা বা আইন করলেই চলবে না তার যথাথর্ প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভাল করার জন্য ‘স্বাধীন কমিশন’ গঠন করা দরকার। এখাতে অনিয়ম, দুনীির্ত বন্ধ ও সেবার মান বাড়াতে তদারকির কোনো বিকল্প নেই। শুধু বেসরকারি নয় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতেও চলে বিভিন্ন অনিয়ম দুনীির্ত। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তাই উৎপাদিত ওষুধের মানের দিকে নজর অব্যাহত রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষকে। প্রত্যাশা থাকবে, নকল ভেজাল নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার ও সরকারি বেসরকারি চিকিৎসাসেবার খাতটি যেন প্রকৃতপক্ষেই জনগণের সেবায় পরিণত হয়।

মোহাম্মদ নজাবত আলী: শিক্ষক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<17473 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1