শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
জনমনে চাপা ক্ষোভ

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরেনি চলছে ঝুঁকি নিয়ে ওঠানামা

নৈরাজ্য ঠেকাতে দিন দশকের সঁাড়াশি অভিযান ও সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:১৮
গণপরিবহনে নৈরাজ্য ঠেকাতে পুলিশের সঁাড়াশি অভিযানেও সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা। ছবিটি রাজধানীর ফামের্গট এলাকা থেকে তোলা Ñফাইল ছবি

নিরাপদ সড়কের দাবিতে খুঁদে শিক্ষাথীের্দর আন্দোলনের মুখে গণপরিবহনে নৈরাজ্য ঠেকাতে দিন দশকের সঁাড়াশি অভিযান ও সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমনকি গণপরিবহনের বেপরোয়া মালিক-শ্রমিক-নেতা, কাউকেই সরকার সামান্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। অথচ নৈরাজ্যকারীদের বিরুদ্ধে শিক্ষাথীের্দর গড়ে ওঠা কঠোর আন্দোলন সরকার নানা কৌশলে পÐ করে দিয়েছে। ফলে গণপরিবহন খাতের অরাজকতাকারীরা ফের আগের মতোই দঁাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চলছে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী ওঠানামা। এর ধারাবাহিকতায় গণপরিবহন যাত্রীদের ভোগান্তি-হয়রানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল দ্রæত দীঘর্ হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী পরিবারের পাশাপাশি সবর্স্তরের মানুষের মাঝে চাপা ক্ষোভ বাড়ছে। যার প্রভাব আগামী দিনের ভোটের রাজনীতিতে পড়বে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পযের্বক্ষকরা। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, নিরাপদ সড়কের দাবিতে জুলাইয়ের শেষভাগের উত্তাল আন্দোলন সরকার নানা কৌশলে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হলেও এ ইস্যুটিই আগামী নিবার্চনে বুমেরাং হয়ে দঁাড়াবে। বিশেষ করে তরুণ ভোটাররা তাদের ব্যালটে প্রশাসনের এ ব্যথর্তার শক্ত জবাব দেবে। যা নিয়ে তারা এরইমধ্যে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এমনকি কেউ কেউ ছোট-ছোট গ্রæপ করে এর পক্ষে জনমত আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। যা আপাতদৃষ্টিতে সামান্য উদ্যোগ মনে হলেও এর অন্তনিির্হত গুরুত্ব ব্যাপক বলে মনে করেন তারা। রাজনৈতিক পযের্বক্ষক ও সুধীজন প্রতিনিধিদের ভাষ্য, গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নৈরাজ্যে সাধারণ মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ তা সড়ক আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফ‚তর্ অংশগ্রহণ ও জোরালো সমথের্ন স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে তাদের তাৎক্ষণিক নিবৃত্ত করা গেলেও এর চাপা ক্ষোভ ফের বিস্ফোরণের অপেক্ষায় রয়েছে। নিবার্চনী উত্তাপের ডামাডোলে সড়ক আন্দোলন নতুন করে চাঙ্গা হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন অনেকেই। এদিকে সড়ক আন্দোলন প্রতিহত করতে ওইসময় ক্ষমতাসীন দলের মুষ্ঠিমেয় নেতাকমীর্ সরাসরি মাঠে নামলেও খোদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা এ আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে দাবি করেছে। পরিবহন সেক্টরের চলমান নৈরাজ্য নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। তারা পরিবহনের বিশৃঙ্খলার জন্য সরাসরি নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকে দায়ী করে বলেন, পরিবহন সেক্টর একজন ব্যক্তির কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে থাকলে যে কোনো সময় সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে। এর সুরাহা হওয়া উচিত। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসনের ব্যথর্তার প্রভাব আগামী নিবার্চনে সরাসরি পড়বে বলেও মনে করেন শরিক দলের নেতারা। গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় ১৪ দলের এক বৈঠকে ন্যাপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, দীঘির্দন ধরে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য চলে আসছে, নিজেদের খেয়াল খুশিমতো চলছে। মানুষকে মানুষ মনে করছে না। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। তাই সাধারণ ছাত্ররা যে প্রতিবাদ করেছে, তা যৌক্তিক। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের ওয়াকার্সর্ পাটির্র পলিটব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। যে যেভাবে পারছে এ সেক্টরকে নিজেদের স্বাথের্ ব্যবহার করছে। এ সেক্টর নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এজন্য সরকারকে বলব সজাগ থাকার জন্য।’ বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমাদের সরকারের আমলে কিছু অব্যবস্থাপনার কারণে এ পরিবহন সেক্টরে যারা কাজ করে, যারা শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেয়Ñ তারা কিন্তু দল-মত নিবিের্শষে একই স্বাথের্ কাজ করে। বাম বলেন, ডান বলেন, এ শ্রমিক পরিবহনের নেতৃত্বে যারা আছে তাদের সরকারি দল, বিরোধী দল বলে কিছু নেই। তারা দীঘর্ কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যেখানে মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। এখান থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে।’ সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষাথীর্রা যে ৯ দফা দাবি দিয়েছে, সেটাই শেষ নয়। শিক্ষাথীর্রা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এখানে বিআরটিএ কাজ করে না, পুলিশ তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিচালনা করে না, মালিক ও পরিবহনের গডফাদাররা বরাবরই ধরাছেঁায়ার বাইরে থাকে। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, চোখ খুলে দিয়েছে। তিনি যদি সেটা সত্যিই অথর্পূণর্ভাবে বলে থাকেন, তাহলে তা কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। শুধু একটা ঝটিকা ট্রাফিক সপ্তাহ করলেই এর সমাধান হবে না। সড়কে অরাজকতার জন্য দায়ী প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সড়কে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে আমি, আপনি এমনকি মন্ত্রীরাও একটা সংখ্যা হয়ে যোগ হতে পারেন।’ অরাজকতা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এর বিরুদ্ধে আবার আন্দোলন হলে তখন কেউই আর সরকারকে বিশ্বাস করবে না বলে মনে করেন এই সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। তার এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষ করে সড়ক দুঘর্টনায় হতাহতদের স্বজনরা এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের অভিযোগ, সরকারের আশ্বাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষাথীর্রা শ্রেণিকক্ষে ফিরলেও সড়ক-মহাসড়কে কোথাও শৃঙ্খলা ফেরেনি। পুলিশের সামনেই একই পথের ভিন্ন কোম্পানির বাসের মধ্যে যাত্রী তোলা নিয়ে রেষারেষি হচ্ছে। বাসের পাদানিতে অতিরিক্ত যাত্রী ঝুলছে। চালকরা আগের মতোই চলন্ত গাড়িতে মুঠোফোন ব্যবহার করছেন। সড়ক-মহাসড়কে আগের মতো আনফিট যানবাহন চলছে। অথচ বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশ এ ব্যাপারে দায়সারা ভূমিকা পালন করলেও সরকার সড়ক নিরাপত্তার আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। আগামী নিবার্চনে সাধারণ ভোটাররা সরকারের এ ভূমিকার উপযুক্ত জবাব দেবে বলে ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন তারা। এদিকে সড়ক পথের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যথর্তা, গণপরিবহনের গডফাদারদের হাতে জিম্মিদশা এবং সবোর্পরি এ নিয়ে সরকারের দায়সারা ভূমিকায় সাধারণ জনগণ কতটা ক্ষুব্ধ ও হতাশ সে চিত্র তুলে ধরেছে গোয়েন্দারা। তারা জানিয়েছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকার পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যথর্ হলে আগামী একাদশ জাতীয় নিবার্চনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। আপাতদৃষ্টির ‘ছোট্ট’ এ ইস্যুটি ‘বড় ফ্যাক্টর’ হয়ে দঁাড়াতে পারে বলে সরকারকে সতকর্ করেছেন গোয়েন্দারা। অন্যদিকে এ নিয়ে খোদ সরকারের নীতি-নিধার্রকদের অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, পরিবহন খাতের নৈরাজ্য যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তাতে তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তারা এক সময় উল্টো সরকারকেই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। পরিবহন খাতের নৈরাজ্যকারীদের কোনোভাবেই আর বাড়তে দেয়া উচিত নয় বলে মনে করেন তারা। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একাধিক নেতাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, নিয়ন্ত্রণহীন গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের বেপরোয়া ভূমিকায় দেশে সড়ক দুঘর্টনা ও প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। আর এ কারণে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তারা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ। তাই আগামী নিবার্চনের আগে তা নিয়ন্ত্রণে সরকার বিশেষ ভূমিকা রাখতে না পারলে ভোটের রাজনীতিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এ ইস্যুটি আগামী সংসদ নিবার্চনে আওয়ামী লীগের জন্য বিষফেঁাড়া হয়ে দঁাড়াতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, সড়ক দুঘর্টনার কারণে যত না মানুষ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তার চেয়ে বেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের মুষ্ঠিমেয় পরিবহন গডফাদারের এ সংশ্লিষ্ট নৈরাজ্যে সম্পৃক্ততার কারণে। যা দলীয় হাইকমান্ডের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া জরুরি। যদিও পরিবহন খাতের পযের্বক্ষকদের অভিমত, গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ে সরকারের নীতি-নিধার্রকরা নানাভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তা এখনো অনেকটা রাজনৈতিক বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নিদেের্শর পরও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বাস্তবমুখী তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে