বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারী শুধু বিনোদন দেয়ার ভোগ্যবস্তু নয় : লেডি গাগা

তারার মেলা ডেস্ক
  ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
লেডি গাগা

বিশ্বসংগীতে ঝলঝল এক তারা হয়ে জ্বলছেন মাকির্ন পপ তারকা-অভিনেত্রী লেডি গাগা। তার গান শ্রোতাদের মাঝে অদ্ভুত দ্যোতনা সৃষ্টি করে। শুধু গান দিয়েই নয়, স্বল্পবসনা হয়ে অদ্ভুত সব ছন্দ উপস্থাপনা করে তিনি একধরনের জাদুকরী মোহ সৃষ্টি করেন। গাগা তার অভিনব উপস্থাপনা আর গানের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্যের জন্য বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত। ছয়বার গ্র্যামিজয়ী মাকির্ন সংগীতশিল্পী লেডি গাগা, প্রশংসিত হন তার গানের কারণে। গাগাকে আন্তজাির্তক সংগীতাঙ্গনের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গান দিয়ে গিনেস বুক অব ওয়াল্ডর্ রেকডর্স থেকে শুরু করে বিলবোডর্, টাইম ও ফোবর্স সাময়িকীর ক্ষমতাবানদের তালিকায়ও উঠেছে তার নাম।

২০০৫ সালে গানের জগতে তার অভিষেক। মাত্র ৭ বছরের সংগীত ক্যারিয়ারে বাজিমাত করে দিয়েছেন তিনি। যা এক-দুই যুগের বাঘা বাঘা সংগীত তারকারাও পারেননি। স্টেজ পারফরম্যান্সের জন্য গাগা সবচেয়ে বেশি আলোচিত। গাগা নিজের মিউজিক ক্যারিয়ারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব পালনে তার জুড়ি নেই। এইডস ও বন্যাতের্দর সহযোগিতার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার অনুদানও দিয়েছেন। শুধু গানই নয়, ৩২ বছর বয়সী এ গায়িকা অভিনয়ের সঙ্গেও সম্পৃক্ত রয়েছেন। তিনি হলিউড ছবি ‘ম্যান ইন বøাক-৩’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে তাকে একাধিক ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গেছে। এগুলো হচ্ছেÑ‘ম্যাশেট কিলস’, ‘মাপেটস মোস্ট ওয়ান্টেড’ এবং ‘সিন সিটি : অ্যা ডেম টু কিল ফর’। এ ছাড়া ছোটপদার্র হররধমীর্ ‘আমেরিকান হরর স্টোরি: হোটেল’ পঞ্চম সিরিজে অভিনয় করেন গাগা। এতে তাকে একটি বিশেষ চরিত্রে দেখা গেছে।

চলতি বছরের শুরুতেই ঝলক দেখালেন লেডি গাগা। ‘অ্যা স্টার ইজ বণর্ ছবিতে ‘শ্যালো’ গানের জন্য মৌলিক সংগীত বিভাগে গোল্ডেন গেøাব পুরস্কার অজর্ন করেন তিনি। এ ছাড়া একই ছবিতে অভিনয়ের জন্য ব্রিটিশ একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আটর্স (বাফটা) অ্যাওয়াডের্র জন্যও মনোনীত হয়েছেন এ মাকির্ন গায়িকা। গান গেয়ে গ্র্যামিসহ অনেক পুরস্কার জিতেছেন, এজন্য মঞ্চে উঠে অনুভূতি জানানো তার জন্য নতুন কিছু নয়। তবে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার জিতে আনন্দাশ্রæ নিয়ে মনের কথা জানানোর অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম হলো ৩২ বছর বয়সী এই তারকার। এখানেই শেষ নয়, গত ১৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত ক্রিটিকস চয়েস অ্যাওয়াডের্সর এবারের আসরে ‘অ্যা স্টার ইজ বনর্’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী হয়েছেন লেডি গাগা।

কিন্তু এত কিছুর পরও নারী হওয়ার কারণে আক্ষেপ করেন লেডি গাগা। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে লম্বা এক বক্তব্য দেন এই আলোকিত নারী। সেখানে তিনি বলেন, কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমার জীবনটা কখনো এই পযাের্য় এসে পৌঁছাবে, কোনো দিন শুধুই নারী হওয়ার জন্য আমাকে বিশেষভাবে সম্মান জানানো হবে। এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। জীবনে এমন একটা দিনের কথা ভাবতেও পারিনি। সত্যিই আমি অনেক সৌভাগ্যবান এমন একটি ইন্ডাস্ট্রির অংশ হতে পেরে। তবে আমরা নারী শুধু বিনোদন দেয়ার কোনো ভোগ্যবস্তু নই। আমরা সাধারণ একটা ছবি নই, যা দেখলে কারও মুখে হাসি ফুটবে বা কারও উত্তেজনা বাড়বে। আমরা আজীবন চলতে থাকা কোনো সুন্দরী প্রতিযোগিতার অংশও নই, যারা সব সময় সৌন্দযর্ নিয়ে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই থাকবে। আমরা হলিউডের নারীরা একেকটা স্বতন্ত্র কণ্ঠ। আমাদের চিন্তাধারা গভীর, আমাদের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী, বিশ্বাস দৃঢ়। আমাদের সেই সময়ও কথা বলার আর প্রতিবাদ করার শক্তি রাখি, যখন আমাদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়।

প্রায় ১০টার মতো জামা বদলের পর প্রচÐ খারাপ লাগা নিয়ে যখন আমি ভাবছিলাম যে এসবের পরও দিন শেষে লালগালিচায় আমি কী পরলাম, কীভাবে সাজলাম এগুলোই হবে আলোচনার বিষয়, ঠিক সেই সময়ে আমার চোখে পড়ল আলমারির একপাশে পড়ে থাকা মাকর্ জ্যাকবের নকশা করা একটা স্যুটের দিকে। এই পোশাকটা ছেলেদের স্যুটের মতো, তবে ঢিলেঢালা, মেয়েদের জন্য নকশা করা। আমি সেটাই পরলাম কতগুলো উৎসুক চোখের বিস্মিত দৃৃষ্টি দেখার জন্য। এরপর ‘রিডাটেের্ত তোমাকে দারুণ লাগত!’, একজন বললেন। ‘কেলভিন ক্লেইনের রাফ সিমনসে কিন্তু বেশ মানাতো তোমাকে’, এটা বললেন আরেকজন। ‘আচ্ছা ব্র্যান্ডন ম্যাক্সওয়েল বা ডিওরের ব্যাপারে ভেবে দেখেছিলে?’ লালগালিচায় এভাবে একের পর এক প্রশ্ন আমার দিকে তেড়ে আসছিল। তখন আমি কেঁদে ফেললাম। এসব তো নিতান্তই পোশাক! হ্যঁা, গাউন পরিনি, আমি পরে এসেছি ছেলেদের মতো ঢোলা স্যুট-প্যান্ট।

লেডি গাগা বলেন, আমি আজ আমার সব ক্ষমতা ফেরত চাই। এই বিনোদন জগতেরই প্রভাবশালী একজনের দ্বারা আমি যৌন নিযার্তনের শিকার হয়েছিলাম। এখনো একজন নারী হিসেবে সেই নিযার্তনকারীর নাম বলার মতো সাহস আমার হয়নি। আমি আজও এ কারণে প্রচÐ যন্ত্রণায় ভুগি, কোনো শক্তি পাই না, সাহস পাই না। কিন্তু আজ আমি ঠিক করেছি, আর না, আমি আমার হারানো সেই শক্তি ফেরত চাই। তাই আজ আমি ছেলেদের জন্য তৈরি এই উদ্ভট স্যুট-প্যান্ট পরেছি। আমি সবাইকে বোঝাতে চাই যে আমার শক্তি এই পোশাকের চেয়েও অনেক ঊধ্বের্। ১৯ বছর বয়সে যৌন নিযার্তনের শিকার হওয়ার পর আমি একেবারে বদল যাই। আমার ভেতরের একটা অংশ মরে যায় সেদিনই। এর কথা আমি কাউকে বলতে পারিনি। আমি সেই বদলে যাওয়াকে সবসময়ই এড়িয়ে গেছি। নিজেকে লজ্জায় কুঁঁকড়ে রেখেছি। ভেবেছি, দোষটা বুঝি আমারই ছিল। এমনকি আজও অনেক সময় সবার সামনে দঁাড়াতে আমার লজ্জা লাগে। মনে হয়, আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, সবই আমার দোষে। এমনও অনেক দিন যায়, যখন নিজেকে অপরাধী ছাড়া আমি আর কিছুই ভাবতে পারি না। এই অনুভূতিগুলো আমি হলিউডের প্রভাবশালী কিছু পুরুষের কাছে অনেকবারই প্রকাশ করেছি, কিন্তু কেউ আমাকে কখনো সাহায্য করেনি। কিভাবে ন্যায়বিচার পেতে পারি আমি, সেই পথ কেউ কখনো আমাকে দেখায়নি। এমনকি আমার বিপযর্স্ত মানসিক অবস্থায়ও কেউ আমাকে চিকিৎসার পরামশর্ দেয়নি। তারা ভয়ে লুকিয়েছিল।

ভেবেছিল, আমাকে ন্যায়ের পথ দেখালে হয়তো তাদেরও অনেক গোমর ফঁাস হয়ে যাবে। তারা লুকিয়েছিল, তাই আমিও নিজেকে একটা সময় লুকিয়ে রাখতে শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, আমি অনেক দিন নিজেকে দাবিয়ে রেখেছিলাম। তবে একটা সময় যৌন নিযার্তনের মানসিক যন্ত্রণা ও অপরাধবোধ আমার শারীরিক ব্যথা আর অনেক রোগের কারণ হতে শুরু করে। সেই শারীরিক ব্যথা নিয়ে বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হয় চিকিৎসকের কাছে। সেই সময়ই প্রথম জানতে পারি, আমি পিটিএসডি (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅডার্র) আর ফিব্রোমিয়ালজিয়ায় ভুগছি। এই রোগ তোমার ভেতরের দুশ্চিন্তার ঝড়কে এতই বাড়িয়ে দেয় যে এটা তোমার শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথার জন্ম দিতে শুরু করে। সেই ব্যথাকে কোনো ভাষা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

অবসাদ, হতাশা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক আঘাতÑএসবই সেই দুঃসহ ব্যথার সূত্রপাত ঘটায়। আমি প্রচÐ ভাগ্যবান যে আমার সুযোগ ছিল এই ভয়ংকর রোগ শনাক্ত করার। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষেরই সেই সুযোগ আর সাধ্য নেই। তাই আমি চাই, মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকায় উঠে আসুক।

এই সময়ে বিশ্বে প্রতি চারজনে একজন মানসিক রোগে ভুগছে। এর মধ্যে ৩০ কোটি মানুষ ভুগছে অবসাদ ও হতাশায়। ছয় কোটি মানুষ বেঁচে আছে বাইপোলার ডিজঅডার্র নিয়ে। সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগা মানুষের সংখ্যা এখন ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছেছে। আর প্রতি বছর বিশ্বের ৮ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে আত্মহত্যা করে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে মানসিক রোগে ভোগা ৭৬ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষই কোনো ধরনের চিকিৎসার সুযোগ পায় না। এমনকি ধনী দেশগুলোতেও ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ মানসিক রোগীর এই একই সমস্যা, তারা চিকিৎসার সুযোগ পায় না। আমার স্বপ্ন, প্রতিটি দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শিক্ষক বা থেরাপিস্ট থাকুক। তাই চলুন আমরা আওয়াজ তুলি। শুধু নারী বা পুরুষ আলাদা করে নয়। মানুষ হিসেবে আমরা একে অপরের হাত ধরে এগিয়ে যাই, সমতা আর সুস্থতার দিকে। এই সমতা আর সুস্থতা নারী, পুরুষসহ সব পরিচয়ের সব শ্রেণির মানুষের জন্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<32442 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1