যন্ত্র যেমন মানুষের প্রতিপক্ষ নয় যান্ত্রিক মানুষও মানুষের শত্রম্ন নয়। এরা এসেছে অনেক মানুষের কাজ একা করে দিতে। মানুষের কাজে সাহায্য করতে। বিশাল এক ঘরের ভেতর ঢুকে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। বিরাট আকৃতির কতগুলো যন্ত্র তাদের বড় রবারের গলা কোনো গাড়ির ফ্রেমের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কাজ করছে। ওগুলোর নাকের মধ্য দিয়ে আগুনের ফুলকি ঝরে পড়ছে আর মুখের ভেতর দিয়ে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার সময় হিস হিস শব্দ হচ্ছে। এ দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন আমেরিকার ডেট্রয়েট রাজ্যে ১৪৫ একর জমির ওপরে স্থাপিত জেফারসন পস্ন্যান্টে। এটি একটি মোটর গাড়ি নির্মাণ কারখানা। বর্তমানে পস্নাইমাউথ এবং জর্জ এরিস গাড়ি তৈরি করে এরা প্রচুর লাভ করছে। আগে ২০০ মানুষ এখানে কাজ করত কোম্পানি তখন লোকসানে চলত, এ কারণে ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজিয়ে এখানে ৫০টি যান্ত্রিক মানুষ নিয়োগ করা হলো। ফল হলো সন্তোষজনক এবং সবাইকে বিস্মিত করে উৎপাদন বেড়ে গেল আগের থেকে বেশি। ইতালির তুরিনে সেখানকার ডায়াটেল ইলেকট্রনিক্স ফার্ম তৈরি করেছে এক নতুন যান্ত্রিক মানুষ।
বিজ্ঞানীদের মতে যান্ত্রিক মানুষ এক ধরনের যন্ত্র, যা অনেক যান্ত্রিক কাজ একাই করতে পারে। এখন পর্যন্ত যান্ত্রিক মানুষ সংজ্ঞার সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যান্ত্রিক মানুষ নিয়ে আরো বেশি কিছু আশা করছেন। তারা চাইছেন দুই হাতে অনেক কাজের সঙ্গে যান্ত্রিক মানুষ কথাও বলবে এবং অবসর সময়ে বই পড়বে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু যান্ত্রিক মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলা ও বই পড়া শুরু করেছে। এ রোবট বা যান্ত্রিক মানুষের আবার স্মরণশক্তিও আছে। আছে দৃষ্টিশক্তি, স্বাদ গ্রহণের অনুভূতি এমনকি মানুষের চেয়ে বেশি অনুভূতি আছে এদের। ইনফ্রারেড লাইট ও আলট্রাসনিক সাউন্ড সম্পর্কে যান্ত্রিক মানুষ যত অনুভূতিশীল, মানুষ ততটা নয়। সামান্য ত্রম্নটিযুক্ত কোনো পার্টস যন্ত্রমানুষ গ্রহণ করবে না। এক নাগাড়ে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে প্রাগামা। ১০ জন মানুষ যে পরিমাণ কাজ একটি নির্দিষ্ট সময়ে করতে পারে প্রাগামা একাই এ কাজ অনেক আগে করে দিতে পারে। যা হোক, রোবট বা যান্ত্রিক মানুষের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে রোবট বিপস্নব। এ রোবট বাঁচিয়ে তুলেছে রুগ্ন শিল্পকে। উৎপাদনে করেছে গতির সঞ্চার।
গাড়ি রং করা, ফ্রিজ, টেলিভিশন সংযোজন করা ছাড়াও রোবট বিমান তৈরি ও খনিশিল্পে কাজ করে চলেছে। চেষ্টা করা হচ্ছে রোবটকে দিয়ে কীটনাশক ছিটানো, গভীর সমুদ্র থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ, মহাশূন্যের বিকল্প উপগ্রহে মেরামতসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করানোর। আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে রোবট দিয়ে নতুন নতুন রোবট পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে আধুনিক জীবন শুরুর সঙ্গে রোবটের সূচনা হলেও বিজ্ঞানীরা এখন রোবট বিপস্নব নিয়ে ভীষণ বিপদের আশঙ্কা করছেন। রোবট যদি মানুষের কাজ অতি দ্রম্নত ও কম খরচে করে দেয় তবে মানুষ কী করবে? আজ থেকে কয়েক শ' বছর পর পৃথিবীর সব মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।
আমেরিকায়ও রোবট বিপস্নবের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫-এ ১৯ বছরে আমেরিকায় উৎপাদন দক্ষতা শতকরা ৩.৪ হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পরবর্তী দশকেই তা নেমে দাঁড়ায় ২.৩ ভাগে। এরপর '৭০ সালের শেষের দিকে আরো কমে হয় ১ ভাগ। গত কয়েক বছরে তা হ্রাস পায় ৯ ভাগ। অথচ জাপানে উৎপাদন ক্ষমতা প্রতি বছর ৭.৩ ভাগ হারে বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিবিদরা বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন করার জন্য রোবটের কথা ভাবছেন। রোবট শুধু ২৪ ঘণ্টা কাজই করে না বরং এর জন্য বিরতিরও প্রয়োজন হয় না, অসুখে ছুটি দিতে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, এর জন্য কোনো বোনাস বা পেনশন দিতে হয় না। তবে আর মানুষের প্রয়োজন কী?
দুই দশক আগে একটি 'অ্যাসেম্বলিং লাইন রোবট' তৈরি করতে খরচ হতো ২৫ হাজার ডলার। আর পরিচালনার জন্য এর পেছনে প্রতি ঘণ্টায় খরচ হতো ৪২০ ডলার যা ছিল প্রত্যেক শ্রমিকের চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু আজ এ রোবটের মূল্য ৪০ হাজার ডলার এবং পরিচালনা খরচ ৪৮০ ডলার। অথচ বর্তমানে একজন শ্রমিকের পেছনে খরচের পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ ডলার। এ হিসেবে মানুষ দিয়ে কাজ করানোর চেয়ে রোবট দিয়ে কাজ করানো অনেক লাভজনক। আর এ জন্যই উন্নত বিশ্বে রোবটের ব্যবহার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বর্তমানে আমেরিকায় রোবট রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার। কানেকটিকাট রাজ্যের ইউনিমেশন ইনকরপোরেট আমেরিকার সবচেয়ে বড় রোবট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এটি প্রতি মাসে ৪০টি 'ইউনিমেট' ও ১৫টি 'পুমা' রোবট তৈরি করে।
রোবটের আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মতো করে কাজ করা। আর এর জন্য দরকার একটি 'গাইডিং ব্রেন' ও একটি যান্ত্রিক হাত। এ জন্য কম্পিউটারকে একটি বিদু্যতের পস্নাগের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এ বিদু্যতের তারের মধ্য দিয়ে রোবটের হাতে সঞ্চারিত হয় বিদু্যৎ। এ হাতের সাহায্যে কাজ করে রোবট। বড় বড় কাজের জন্য রোবটরা হাইড্রোলিক চাপের সাহায্য নেয়। আধুনিক রোবটদের আছে 'মেমোরি'। এগুলোকে একসঙ্গে অনেক কাজ দিলে এরা সঠিকভাবে তা করে দেয়।
এখন দিন দিন উন্নত ধরনের রোবট তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে নিজেরা যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। বর্তমানে রোবটদের দেখা এবং টেস্ট গ্রহণের জন্য ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। এগুলোর সামনে একটি ক্যামেরা থাকে। এ ক্যামেরার সাহায্যেই এগুলো দেখার কাজটি করে। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান বস্তুর আকার, উচ্চতা, কম্পন নির্ণয় করে হাতের সাহায্যে।
জেনারেল মোটরস এখন বিভিন্ন ধরনের রোবট তৈরি করছে; যা কনভেয়ার বেল্টের ওপর দিয়ে চলমান বিভিন্ন ধরনের পার্সের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় পার্সটি বেছে নিতে পারে।
রোবট যেহেতু কিছুটা মানুষের মতো দেখতে তাই এর সঙ্গে যেসব মানুষ কাজ করে তারা মানুষের মতো এরও একটি নাম দেয়া পছন্দ করে। কারখানা শ্রমিকরা রোবটের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে গিয়ে পুরুষ রোবটকে পছন্দ করে বেশি। কিন্তু জাপানের একটি পস্ন্যান্টে যে কটি রোবট আছে তাদের প্রত্যেকের চলচ্চিত্রের বিখ্যাত সব অভিনেত্রীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এভাবে রোবট বিশ্বের অর্থনীতি ও প্রযুক্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিরাট ও বিশাল ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশ্বের যে কটি রাষ্ট্র আজ প্রযুক্তি ও উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছে তাদের এ সাফল্যের পেছনে রোবটের অবদান কম নয়।