শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টেলিকমিউনিকেশনে পরিবতর্ন

আল-আমিন হোসেন
  ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে বেশ কিছু পরিবতর্ন আসছে ছবি : ইন্টারনেট

রবি-এয়ারটেল একীভ‚ত হওয়ার পর আলোচনা চলছে বাংলালিংকের প্রস্থান নিয়েও। ক্রেতা হিসেবে কেউ রবি, কেউ গ্রামীণফোন, কেউ আবার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাও দেখছেন।

নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিবতর্ন আসছে বৈশ্বিক টেলিকম বাজারেও। অলিগোপলি বাজার ডুয়োপলিতে রূপ নিচ্ছে। ব্যবসা গুটিয়ে কিংবা একীভ‚তকরণের মাধ্যমে অপারেটরের সংখ্যা কমছে। প্রতিবেশী ভারতের টেলিকম বাজারও ডুয়োপলির দিকে যাচ্ছে। দেশটিতে চার সেলফোন অপারেটর কাযর্ক্রমে থাকলেও প্রতিযোগিতা সীমিত হয়ে পড়েছে মূলত দুই অপারেটরের মধ্যে। চীনে অপারেটরের সংখ্যা তিনটি থেকে দুটিতে নেমে আসছে। পঞ্চম প্রজন্মের (ফাইভজি) নেটওয়াকর্ ব্যবস্থার উন্নয়নে একীভ‚ত হচ্ছে চায়না ইউনিকম ও চায়না টেলিকম। অপারেটরের সংখ্যা কমে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক শুরু থেকেই বেসরকারি খাতের তিন অপারেটরের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। আর রবির সঙ্গে এয়ারটেলের একীভ‚তকরণের পর বাংলালিংকও পিছিয়ে পড়েছে শীষর্ দুই অপারেটরের চেয়ে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আথির্ক লোকসানে থাকা অপারেটরটি এখন ক্রেতা খুঁজছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীর খেঁাজে দেশের বাইরে বৈঠকও করেছে অপারেটরটি।

সম্প্রতি বাংলালিংকের মূল প্রতিষ্ঠান গেøাবাল টেলিকম হোল্ডিং (জিটিএইচ) অধিগ্রহণের প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ভিওন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে থাকা গেøাবাল টেলিকম হোল্ডিংয়ের সম্পদ অধিগ্রহণের প্রস্তাব গত ১১ অক্টোবর বাতিল করে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে গত জুলাইয়ে প্রস্তাবটি দিয়েছিল ভিওন। বতর্মানে জিটিএইচে ভিওনের ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গত এক দশকের বেশি সময়েও মুনাফা অজর্ন করতে পারেনি বাংলালিংক। ২০১৫ সালে একটি প্রান্তিকে মুনাফা হলেও সামগ্রিকভাবে বছরটিতে মুনাফা করতে পারেনি বাংলালিংক। গত বছরও প্রতিষ্ঠানটির আয় কমেছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ভিওনের ২০১৭ সালের আথির্ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বাংলালিংকের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৪ হাজার ৮৭০ কোটি। বছরটিতে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করেছে ৮২০ কোটি টাকা। আবার চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে অনুষ্ঠিত নিলামে তরঙ্গ কিনতে বাংলালিংক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

২০০৫ সালে ১০ লাখ গ্রাহকসংখ্যা অজর্ন করে বাংলালিংক। গ্রাহকসংখ্যার ভিত্তিতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেলফোন অপারেটর হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির আবিভার্ব ঘটে ২০০৭ সালে। ২০০৮ সালে ১ কোটি গ্রাহকের মাইলফলক অজর্ন করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ২০১৬ সালের শেষদিকে রবি-এয়ারটেলের একীভ‚তকরণের পর গ্রাহকসংখ্যার ভিত্তিতে দীঘির্দন দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলালিংক নেমে এসেছে তৃতীয় স্থানে।

গ্রাহকপ্রতি আয়ের বিবেচনাতেও দুবর্ল অবস্থানে রয়েছে বাংলালিংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সাল শেষে গ্রামীণফোন ছাড়া অন্য দুই বেসরকারি সেলফোন অপারেটরের গ্রাহকপ্রতি আয় (এআরপিইউ) কমেছে। বছরটির শেষে গ্রামীণফোনের গ্রাহকপ্রতি আয় ছিল ১৬৭ টাকা, রবির ১২৩ ও বাংলালিংকের ১১১ টাকা। রবি ও বাংলালিংকের গ্রাহকপ্রতি ওই আয় গত পঁাচ বছরের মধ্যে ছিল সবির্নম্ন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) গ্রামীণফোনের গ্রাহকপ্রতি আয় দঁাড়িয়েছে ১৫৬ টাকা। আর রবি ও বাংলালিংকের গ্রাহকপ্রতি আয় হয়েছে যথাক্রমে ১১৭ ও ১০৯ টাকা।

চলতি মাসে মোবাইল নম্বর পোটেির্বলিটি (এমএনপি) সেবা চালু হয়েছে। এতে নম্বর অপরিবতির্ত রেখে অপারেটর পরিবতের্নর সুযোগ পাচ্ছেন গ্রাহকরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার হিসাবে, সেবাটি চালুর পর প্রথম সপ্তাহে অপারেটর পরিবতর্ন করেছে ৪ হাজার ১৮১ জন। এর মধ্যে বাংলালিংক ১ হাজার ৮৯ জন গ্রাহক পেলেও হারিয়েছে ১ হাজার ২৭৬ জন।

বাংলালিংকের করপোরেট কমিউনিকেশনস বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার আংকিত সুরেকা বলেন, বতর্মানে টেলিকম খাতের কিছু ক্ষেত্রে একাধিপত্য বিরাজ করছে। একটি ছাড়া বাংলাদেশের কোনো মোবাইল অপারেটরই এ মুহূতের্ লাভজনক অবস্থানে নেই। অপারেটরদের এ অসম অবস্থানের কারণে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে গ্রাহকরা অনেক ক্ষেত্রে মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা আশা করি, টেলিকম খাতের পরিস্থিতি ও সবোর্পরি গ্রাহকদের সুবিধা বিবেচনা করে সরকার এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যা ছোট অপারেটরগুলোকে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে গ্রাহকদের উন্নতমানের সেবা দিতে সাহায্য করবে। বতর্মান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের টেলিকম খাতে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত বোধ করবেন। এর ফলে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা টেলিকম খাতের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

দীঘির্দনের পুঞ্জীভ‚ত লোকসানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বড় অংকের ঋণের বোঝাও। তহবিল সংগ্রহে ২০১৪ সালে আন্তজাির্তক বাজারে পঁাচ বছরমেয়াদি ৩০ কোটি ডলার মূল্যের বন্ড ছাড়ে বাংলালিংক। সংগৃহীত অথর্ দিয়ে ঋণ পরিশোধ ও মূলধনি ব্যয় নিবাের্হর লক্ষ্য ছিল বাংলালিংকের। এটির মেয়াদ পূণর্ হবে ২০১৯ সালের মে মাসে। এর বাইরে আরও ৫০ লাখ ডলার ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। গত প্রায় দুই বছরে বিপুল কমীর্ ছঁাটাইয়ের পাশাপাশি নানা ধরনের ব্যয়সংকোচনের পথে হঁাটছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৬ সাল থেকে একাধিক পযাের্য় কমীর্ ছঁাটাইয়ের এ কাযর্ক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক পুনগর্ঠন কাযর্ক্রমের অংশ হিসেবেই উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে এর পরও আগামী বছরগুলোতে বড় ধরনের আথির্ক চাপ প্রতিষ্ঠানটির জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।

এ অবস্থায় বাংলালিংকের প্রস্থানের সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা হিসেবে গ্রামীণফোন কিংবা রবিকে এগিয়ে রাখছেন তারা। এ দুই অপারেটরের বাইরের কোনো ক্রেতার সম্ভাবনাও তারা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। গ্রাহকসংখ্যার ভিত্তিতে বাজারদখলও কমছে বাংলালিংকের। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে তিন মাসই গ্রাহক হারিয়েছে অপারেটরটি। গ্রাহকসংখ্যার বিবেচনায় আগস্ট শেষে সেলফোন অপারেটরটির বাজার দখল দঁাড়িয়েছে ২১ দশমিক ৭১ শতাংশ। ২০১০ সালের পর এটিই বাংলালিংকের সবির্নম্ন বাজার দখল।

২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে সেবা টেলিকমের শতভাগ শেয়ার কিনে নেয় মিসরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওরাসকম টেলিকম হোল্ডিংস (ওটিএইচ)। পরের বছর বাংলালিংক ব্র্যান্ড নামে সেবা চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সালে ওটিএইচের সিংহভাগ শেয়ার কিনে নেয় ভিম্পেলকম। আর ২০১৩ সালে ওটিএইচের নাম পরিবতর্ন করে গেøাবাল টেলিকম হোল্ডিংস (জিটিএইচ) এবং ওরাসকম বাংলাদেশ লিমিটেডের নাম বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড রাখা হয়। চলতি বছরের আগস্ট শেষে অপারেটরটির গ্রাহকসংখ্যা দঁাড়িয়েছে ৩ কোটি ৩৪ লাখ।

রবিতে ৩০ শতাংশ মালিকানা ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা অপারেটর এনটিটি ডোকোমোর। এ মালিকানা এখন কমে দঁাড়িয়েছে ৮ শতাংশে। আবার আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করছে ভারতী এয়ারটেল। অথচ রবির সঙ্গে একীভ‚তকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিনিয়োগকারীরা এ দেশে ব্যবসা করতে আসে। তাদের লক্ষ্যই থাকে ব্যবসা থেকে মুনাফা অজর্ন। মানসম্মত সেবাদান ও বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের জন্য যে ধরনের নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা প্রয়োজন, দেশে তার অভাব রয়েছে। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে সেলফোন অপারেটরদের এরই মধ্যে নানা ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে। অপারেটরদের বিনিয়োগও তাই সংকুচিত হয়ে এসেছে। ফলে তাদের সহজেই চলে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<24887 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1